শিল্পকলায় প্রত্ননাটক ‘মহাস্থান’
আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের যে প্রাচুর্যময় সম্ভার রয়েছে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো তার মধ্যে অন্যতম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই নির্দশনগুলোর মধ্যে বগুড়ার মহাস্থানগড় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি প্রাচীন পুরাকীর্তি। প্রসিদ্ধ এই নগরী একসময় বাংলার রাজধানী ছিল। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এখানে জনপদ গড়ে উঠেছিল। বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত মহাস্থানগড়কে ২০১৬ সালে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণা করা হয়।
বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রত্ননাটক করছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। এরই ধারাবাহিকতায় আড়াই হাজার বছরের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে প্রত্ননাটক ‘মহাস্থান’ মঞ্চায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ড. সেলিম মোজাহারের রচনায় এবং লিয়াকত আলী লাকীর নির্দেশনায় দীর্ঘ ছয় মাসের মহড়া শেষে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা প্লাজায় প্রত্ননাটক ‘মহাস্থান’-এর কারিগরি মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একডেমি প্রযোজিত এই প্রত্ননাটকে কাজ করেছেন তিন শতাধিক শিল্পী ও কলাকুশলী।
প্রাচীরবেষ্টিত এই নগরীর ভেতর রয়েছে বিভিন্ন সময়ের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এ স্থান পরাক্রমশালী মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন শাসকবর্গের প্রাদেশিক রাজধানী ও পরবর্তীকালে হিন্দু সামন্ত রাজাদের রাজধানী ছিল। তৃতীয় খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে দশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্য হিন্দু রাজা ও অন্যান্য ধর্মের রাজা এখানে রাজত্ব করেছিল। ‘মহাস্থান’ প্রত্ননাটকের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন সময়ের শাসন-শোষণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ঐতিহাসিক এই স্থানটি একসময় ধর্মীয় তীর্থস্থান হিসেবেও পরিণত হয়েছিল। ধর্মের বাণী বুকে নিয়ে কেউ মানবতার কথা বলেছেন, কেউ আবার মানুষের অধিকার নষ্ট করেছেন। এসব কীর্তি, কৃষ্টি ও সভ্যতার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে ‘মহাস্থান’ নাটকে।
মহাস্থান নাটকে আমাদের জাতিসত্তার ইতিহাসকে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। মহাস্থানগড়ের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে সময়ের পরম্পরায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পর্যন্ত সময়কালকে একক গ্রন্থনায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই নাটকে প্রাচীন শিকার যুগ থেকে শুরু করে বৈদিক যুগ, আদিবাসী পর্ব, রামায়ণের গীত, কালিদাসের কাব্য, চর্যাপদ, সুফিসামা, বৈষ্ণব পদাবলী, ব্রাহ্মসংগীত, লোকগান, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ব্রতচারীদের গান, কবির গান, ভাষা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাস, কাব্য-গীত ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা পালাগানরূপে প্রকাশিত হয়েছে।
নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাস-ঐতিহ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি আমাদের যে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের আলোকিত অধ্যায় রয়েছে, সেটাই মহাস্থান নাটকের মধ্য দিয়ে প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে।