বার্বি মুভি দেখার পূর্বে জেনে নিন কিছু চমকপ্রদ তথ্য

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : বার্বি মুভির ইনস্টাগ্রাম পেজ থেকে নেওয়া

চলতি বছরের ২১ জুলাই মহাসমারোহে মুক্তি পেল যুগের সব থেকে সেরা সিনেমা বার্বি। শুধুমাত্র প্লাস্টিকের একটি পুতুল থেকে পুরো একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা পর্যন্ত আসার মাঝে দুর্দান্ত এক সময় পাড়ি দিয়েছে বার্বি।

১৯৫৯ সালে সূচনা হওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষের হৃদয় দখল করা এই বার্বি পুতুল বিক্রি হয়েছে ১০০ কোটিরও বেশি। স্বতন্ত্র শিল্প ও সংস্কৃতির এই বিখ্যাত প্রতিনিধিকে ঘিরে পুরো একটি জগত সৃষ্টি হয়েছে বার্বিল্যান্ড নামে।

চলুন, বার্বি মুভি দেখার আগে ঐতিহাসিক এই পুতুলটির পেছনের কিছু চমকপ্রদ তথ্য জেনে নেই।

বার্বি পুতুলের ইতিহাস

এই ফ্যাশন পুতুলটির স্রষ্টা আমেরিকান ব্যবসায়ী রুথ হ্যান্ডলার। যেটি ১৯৫৯ সালের ৯ মার্চে বাজারে নিয়ে আসে ম্যাটেল নামের কোম্পানি। ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে খেলনার বাজারে বিপ্লব ঘটিয়ে একটি সপ্রতিভ ব্র্যান্ডে পরিণত হয় বার্বি। ১০০ কোটিরও বেশি সংখ্যক বিক্রি হওয়ায়, বার্বি ম্যাটেলের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে লাভজনক পণ্যে পরিণত হয়।

বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই পুতুলটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ক্যারিয়ারে নিজের রূপ বদলেছে। পরিবর্তনশীল সামাজিক নিয়মগুলোর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে নতুনভাবে হাজির হয়েছে প্রতিটি প্রজন্মের শিশুদের সামনে। ফ্যাশন মডেল থেকে মহাকাশচারী, ব্যালেরিনা থেকে ব্যবসায়ী প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠিত বার্বি অনুপ্রাণিত করে গেছে শিশুদের বাড়ন্ত মনকে।

সেই ধারাবাহিকতায় ফ্যাশন নারী পুতুল হিসেবে প্রথমে খ্যাতি পেলেও পরবর্তীতে কেন নামে এর পুরুষ সংস্করণও বের হয়। এটিও খ্যাতি পায় বিশ্বজোড়া; এমনকি বার্বি ও কেন এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পুতুল কাপল। খেলনা ব্যবসার মূল চালিকা শক্তি তো ছিলই, কিন্তু পরবর্তীতে আনুষঙ্গিক ও পোশাকের মতো পণ্য বিক্রির বাহনেও পরিণত হয় বার্বি। জেনে নিন বার্বি নিয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য।

বার্বি ও কেনের নামকরণ

বার্বি ও কেন খেলনার জগতে দুটি বিখ্যাত জুটি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু যাদের নামে এদের নাম রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে সম্পর্কটা সম্পূর্ণ আলাদা। বার্বির প্রতিষ্ঠাতা রুথ হ্যান্ডলার নিজের মেয়ে বারবারা মিলিসেন্ট রবার্টসের নামানুসারে ফ্যাশন পুতুলটির নামকরণ করেছিলেন। পুরুষ সংস্করণ কেনের নাম রাখা হয়েছিল তারই ছেলে কেনেথের নামে। অর্থাৎ বাস্তব জগতে তারা পরস্পরের ভাই-বোন।

২০০ টিরও বেশি ভিন্ন ক্যারিয়ার 

বার্বির সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক দিকগুলোর মধ্যে একটি হলো– তার বহুমুখিতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সেই ১৯৫৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বার্বি প্রায় ২০০ টিরও বেশি ভিন্ন ভিন্ন ক্যারিয়ারে আবির্ভূত হয়েছে। তার ক্যারিয়ারের জগত প্রসারিত ছিল মহাকাশচারী থেকে পাইলট, ফায়ার ফাইটার থেকে সাংবাদিক ও উদ্যোক্তা থেকে র‌্যাপার পর্যন্ত।

ক্যারিয়ারের এই বৈচিত্র্য টিনেজার মেয়েদের উদ্দেশ্যে একটি শক্তিশালী প্রতীকী বার্তা ছিলো। বার্বির মত করে তারাও ভাবতে শুরু করে, পুরুষের মত তারাও যে কোনও পেশায় নিয়োজিত হতে পারে।

জার্মান পুতুল লিলি থেকে অনুপ্রেরণা

বার্বির ধারণাটি প্রাথমিকভাবে লিলি নামের একটি জার্মান পুতুল থেকে উদ্ভব হয়েছিল। বিল্ড-জেইটুং নামক একটি জার্মান কমিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক কমিক গল্পের উচ্চমানের এক কল গার্লের নাম ছিলো লিলি। রুথ হ্যান্ডলার, ইউরোপে ভ্রমণ করার সময় এই পুতুলটি তার চোখে পড়ে। আর সেই থেকে তার মাথায় অল্পবয়সী মেয়েদের জন্য একটি ফ্যাশন পুতুল তৈরির ধারণাটা আসে। পরবর্তীতে এই ধারণার অঙ্কুরেই জন্ম হয় বার্বির।

প্রথম বার্বির দাম

১৯৫৯ সালের ৯ মার্চে নিউইয়র্কে খেলনা মেলায় প্রবেশের মাধ্যমে রাজকীয় অভিষেক ঘটে বার্বি খেলনার। তখন এর ড্রেস ছিল কালো–সাদা ডোরাকাটা সাঁতারের পোশাক। আর প্রথম আবির্ভূত বার্বির এই সংস্করণটির দাম ছিল মাত্র তিন আমেরিকান ডলার। তারপর থেকে বার্বির গোলাপি রঙ ধারণ করে, যেটি বার্বি পিঙ্ক (পিএমএস-২১৯) বা বার্বি গোলাপি নামে বিশ্ববিখ্যাত হয়।

বার্বির মহাকাশ ভ্রমণ

মানুষের প্রথম চাঁদে অবতরণেরও চার বছর আগে, ১৯৬৫ সালে মহাকাশ ভ্রমণ করেছিল বার্বি। এই স্পেস মিশনটির অবতারণা করা হয়েছিল মূলত ১৯৬৩ সালে প্রথম মহাকাশচারি নারী ভ্যালেনতিনা তেরেস্কোভার সম্মানে। এটি খেলনার জগতে অগ্রগামী করে তোলে বার্বিকে। পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং গণিতে ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠায় নারীদের সাহস যোগাতে বিরাট ভূমিকা পালন করে।

বার্বির প্রেসিডেন্ট হওয়া 

১৯৯২ সালে বার্বির প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটা ছিল অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। সেই থেকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী বছরেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে থাকে বার্বি। এই আলোড়ন সৃষ্টিকারি ঘটনাটি পুরনো ধ্যান-ধারণায় এক বিশাল পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে। পাশাপাশি রাজনীতিতে নারীদের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততার এক শক্তিশালী বার্তা প্রচার করে।

চিরকুমারি বার্বি

বার্বি চির তরুণ এবং চিরন্তন স্বাধীনতার প্রতীক। একদম শুরুর দিকে আদর্শ গৃহিণী বা ঘরকন্যার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও কখনই অন্তঃসত্ত্বা হিসেবে আবির্ভাব ঘটেনি বার্বির। শিশুদের সঙ্গী হিসেবে প্রদর্শন করা হলেও বার্বির সন্তান নিয়ে কখনোই ভাবা হয়নি। বরং তার ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে চির নবীন থেকে স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভরতার পথ পাড়ি দেবার দিকেও বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা

বার্বি ফ্যাশন পুতুল বিশ্বব্যাপী এতটাই জনপ্রিয় যে, সারা বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১০০ টিরও বেশি বার্বি পুতুল বিক্রি হয়। প্রতিটি প্রজন্মের শিশুদের কাছে সমান আগ্রহের খোরাক যোগানোর ফলে সর্ব যুগের সাংস্কৃতিক প্রতীক এই বার্বি।

বার্বি ও কেনের সম্পর্কের টানাপোড়েন

বার্বি কাল্পনিক ইউনিভার্সে নানা ক্লাইমেক্সে অবতারণা ঘটে নানা টুইস্টের। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতার হলো–বার্বি ও কেনের সম্পর্কের টানাপোড়েন। ৪৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে একসঙ্গে থাকার পর ২০০৪ সালে ভালোবাসা দিবসে বার্বি এবং কেনের সম্পর্ক ভেঙে যায়। অবশ্য ২০১১ সালের ভালোবাসা দিবসে তাদের সম্পর্ক আবার জোড়া লাগে।

বার্বির যে বিষয়টি নজর এড়িয়ে গিয়েছিল

চরিত্র বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে প্রথম থেকেই বার্বি ছিল বেশ প্রগতিশীল। তবে যে কারণেই হোক, প্রথম থেকে এই মেয়ে পুতুলটির কোন নাভি ছিলো না। ৪০ বছরেরও বেশি সময় পরে অবশেষে ২০০০ সালে পুতুলের কাঠামোতে নাভি সংযুক্ত করা হয়। দেরিতে হলেও এই সংযোজনটি পুতুলটিকে আরও বেশি বাস্তবসম্মত ও নারীসুলভ পূর্ণতা দিয়েছিলো।

বার্বি পুতুল যখন চলচ্চিত্রের মধ্যমণি

বার্বির বিভিন্ন চরিত্রগুলো নিয়ে কার্টুন অনেক আগে থেকেই বিখ্যাত ছিল। কিন্তু ফ্যাশন পুতুলটির ফ্র্যাঞ্চাইজিকে পূর্ণতা দিতেই এর গভীর থিমগুলো নিয়ে আয়োজন করা হয়েছে পূর্ণদৈর্ঘ্য লাইভ–অ্যাকশন চলচ্চিত্রের। যুগান্তকারী এই পটভূমিকে চলচ্চিত্ররূপ দেয়ার ভার পড়ে অস্কার মনোনীত পরিচালক গ্রেটা গারউইগের উপর। আরেক অস্কার মনোনীত নোয়া বাউম্বাচ গারউইগের সঙ্গে যৌথভাবে বার্বির জীবনচরিত্রকে চিত্রনাট্যে বন্দি করেন। তারা গোটা কাল্পনিক বারবিল্যান্ডকে ঢালাও করে পুনঃনির্মাণ করেন, যেখানে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে লালিত নারীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত।

ডিসি ইউনিভার্সের হার্লে কুইন–খ্যাত মার্গট রবি অভিনয় করেছেন বার্বির ভূমিকায়। তার বিপরীতে কেন-এর ভূমিকায় রয়েছেন দ্যা নোটবুক ও লা লা ল্যান্ড–খ্যাত অভিনেতা রায়ান গসলিং।

গল্পের শুরুতে অস্তিত্ব সংকটের মাঝে ধীরে ধীরে নিজেকে খুঁজেকে পাওয়ার যাত্রা শুরু হয়। এভাবে বার্বির রূপান্তর এবং আত্মদর্শন সামাজিক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে কাটিয়ে নিজের সীমাবদ্ধতাকে উতড়ে যাওয়ার উৎসাহ দেয়।

কমেডি, ফ্যান্টাসি ও অ্যাডভেঞ্চারের মোড়কে ম্যাটেলের খেলনাগুলো সব যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে একসঙ্গে। সেইসঙ্গে বার্বি ও কেনের সম্পর্কের বিভিন্ন স্তরে উন্মোচিত হতে থাকে বার্বি ইউনিভার্সের চরিত্রগুলো। পরিশেষে নাটকীয় পরিবেশন বার্তা রেখে যায় প্রথাগত ধ্যান-ধারণা ভেঙে নতুনকে সাদরে গ্রহণ করার।

সবশেষ, বার্বি মুভির চিত্তাকর্ষক ভিজ্যুয়াল পরিবেশনাকে ছাপিয়ে গেছে বিগত কয়েক যুগ ধরে বার্বির খ্যাতি। সেই সূত্রে, নস্টালজিয়ায় গা ভাসিয়ে সব বয়সের মানুষ আগ্রহ ভরে বসে গেছে সিনেমার সামনে। বার্বির সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের সঙ্গে শিল্প ও বাণিজ্যের মেলবন্ধনের দৃশ্যায়ন এক নজরে ভেসে উঠেছে বায়োস্কোপের মত। লিঙ্গ, পরিচয় ও স্বপ্ন পূরণ নিয়ে নানা সামাজিক ট্যাবুর নির্যাসে এই অভিজাত বিনোদনটি নিশ্চিতভাবেই বার্বির নামের প্রতি সুবিচার করেছে।