সালমান শাহ ছাড়া যা পারেনি অন্য কোনো নায়ক

Looks like you've blocked notifications!
বিভিন্ন স্টাইলে সালমান শাহ। ছবি : সংগৃহীত

মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে ২৭ সিনেমার নায়ক সালমান শাহ। আর এই ২৭ সিনেমায় সালমান শাহ ফ্যাশন নিয়ে যা করে গিয়েছেন, দীর্ঘ ২৪ বছরে ঢাকাই সিনেমার আর অন্য কোনো নায়ক সেটা করতে পারেননি বলে মত অনেকের। সালমান শাহর মৃত্যুর পর সিনেমার আর কোনো তারকা এখনো ভক্তদের ‘ফ্যাশন আইকন’ হয়ে উঠতে পারেননি, যেটা পেরেছিলেন শুধু সালমান শাহ।

১৯৯৩ সালে প্রথম ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমাতেই ফ্যাশনে ভিন্নতা দেখিয়েছিলেন সালমান। এ সিনেমায় তিনি মাথায় ভিন্ন স্টাইলের ক্যাপ পরেছিলেন।

এ ছাড়া বিভিন্ন সিনেমায় সালমানের ফ্যাশনের তালিকায় ছিল মাথায় রং-বেরঙের টুপি, স্ট্রিচ জিন্স প্যান্টের হাঁটুতে রুমাল বাঁধা, ছোট চিপের ব্যাকব্রাশ করা চুলের ডিজাইন, চুল ঝুঁটি করা, কানে দুল, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, টি-শার্টের সামনের দিকে ইন করে পেছনের দিকে একটু খুলে রাখা, বড় বকলেসওয়ালা বেল্ট পরা, ডান হাতে ঘড়ি পরা, কপাল ঢেকে রাখা ব্যান্ডেনা, গলায় আরবীয় রুমাল প্যাঁচানো, পুলিশি পোশাক ও টুপিতে রোদচশমা আর গোঁফ, দাঁত দিয়ে নখ কাটা, বড় চুলে ঠোঁটের কোণে সিগারেট রাখাসহ এমন অসংখ্য নিজস্ব স্টাইল তৈরি করেছিলেন সালমান। চুলের স্টাইলেও এনেছিলেন পরিবর্তন।

বিশ্বরঙ ফ্যাশন হাউসের কর্ণধার ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহা। ছবি : সংগৃহীত

সে সময়ে নতুন সিনেমা মুক্তির সঙ্গে সালমানের নিত্যনতুন স্টাইল দেখে পাড়া-মহল্লায় ফলো করার হিড়িক লেগে যেত। সালমানের মতো স্টাইলে চুল রাখত তাঁর ভক্তরা, পরত গোল ফ্রেমের চশমা, বিভিন্ন রঙের চুপি। এ ছাড়া কপাল ঢেকে রাখা ব্যান্ডেনা ও স্ট্রিট জিন্স প্যান্টের হাঁটুতে রুমাল বাঁধা নব্বই দশকে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সালমানের জন্যই।

তবে সালমান মারা যাওয়ার পর মান্না, ওমর সানী, ফেরদৌস, রিয়াজ ও শাকিব খানরা ঢাকাই সিনেমায় বিভিন্ন সময় একক আধিপত্য বিস্তার করলেও তাঁরা কেউই সালমানের মতো ভক্তদের ফ্যাশন আইকন হয়ে উঠতে পারেননি।

এমনটা হতে না পারার কারণ কী? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে এনটিভি অনলাইন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বরঙ ফ্যাশন হাউসের কর্ণধার ও ফ্যাশন ডিজাইনার বিপ্লব সাহা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যুগ যুগ ধরে অনেক কিংবদন্তির জন্ম হয়েছে। তাঁরা মেধা দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে তাঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন। যদি আমরা ফ্যাশন আইকন হিসেবে চিন্তা করি, তাহলে খুব কম তারকা আছেন, যাঁরা এই জায়গাটা মেইনটেইন করেছিলেন। সেই ষাট-সত্তরের দশকে আমি যত দূর জানি আমাদের চিত্রনায়ক রাজ্জাক স্যার, আলমগীর স্যার, জাফর ইকবাল স্যারের নাম চলে আসে। উনাদের ফ্যাশন আইকন বলা যায়। চিত্রনায়িকাদের নাম বলতে গেলে ববিতা, শাবানা ও চম্পা ম্যাডামদের নাম আসে। উনারা আসলে ভেবেছেন ব্যাপারটা। ফ্যাশন ব্যাপারটা তো সহজ না, আসলে যেকোনো চলচ্চিত্র একটি বার্তা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন দেশে কিন্তু চলচ্চিত্রই নানা ফ্যাশনকে ডমিনেট করে বছরজুড়ে। আমাদের দেশে আসলে ব্যাপারটা ওভাবে হয়ে ওঠেনি।’

বিপ্লব সাহা আরো বলেন, “‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমা যদিও সালমান শাহর প্রথম সিনেমা, তিনি ছোটবেলা থেকেই কাজ করেছেন। এবং তাঁর পরিবার, তাঁর মেধা, তাঁর শিক্ষা আর ক্রিয়েটিভ যে সেন্স আছে, তাঁকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে। তিনি তো আর বলেকয়ে ফ্যাশন আইকন হননি, মেধা ও সেন্স দিয়ে সিনেমায় তিনি ফ্যাশন সেন্সটা সৃষ্টি করেছেন। এ ছাড়া ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিজেকে ফ্যাশনেবল করে তুলেছিলেন। যেটা সবার ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে না। এরপর যা হয়েছে আমাদের দেশের সিনেমায় অন্য দেশের সিনেমার প্রভাব পড়েছে। সেই থেকে এখনকার নায়কেরা আসলে সবটুকুই কপি করতে চেয়েছেন। আমি শাহরুখের মতো হবো, আমি রণবীরের মতো হবো। কপি বা ইন্সপাইরেশন থাকতেই পারে, সে সময়ের অনেক সিনেমাতেও সেটা ছিল। কিন্তু সেটা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হতো। কারণ, যেকোনো ইন্সপাইরেশনে কাজ করতে গেলেও মেধা লাগে। কিন্তু এখন আমাদের নায়কেরা সেটা ভাবেনই না। সে কারণে আসলে হয়নি। পোশাক তো শুধু পরলেই হয় না, সেটা ক্যারি করতে পারতে হবে। এসব নিয়ে এখন অনেকে ভাবেন না, সে কারণে কেউ ফ্যাশন আইকন হয়ে উঠতে পারেননি।”

উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন ডিজাইনিং বিভাগের প্রভাষক নাজমী জান্নাত। ছবি : সংগৃহীত

উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন ডিজাইনিং বিভাগের প্রভাষক নাজমী জান্নাত এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রথমত আমি মনে করি, সালমান শাহর একটা ক্রেজ ছিল ফ্যাশনের প্রতি। নতুন নতুন ফ্যাশন সালমান শাহ এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করতেন, নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করতেন; নতুনত্বের প্রতি তাঁর একটা বিশেষ টান ছিল। আর সেইসঙ্গে তাঁর নিজস্ব সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটিয়ে একেবারেই স্বকীয় একটা ট্রেন্ড বা ফ্যাশন দাঁড় করিয়েছিলেন, যার আইকন সালমান নিজেই ছিলেন। আর এমন কোনো ট্রেন্ড তিনি অনুকরণ করতেন না, যেটায় তাঁকে অদ্ভুত দেখাত; খুব সাবলীল-স্বাভাবিকভাবেই সালমানের ট্রেন্ডগুলোর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিত্ব ব্লেন্ড হয়ে যেত। এমন একটা সময় সালমান শাহ ফ্যাশন আইকন ছিলেন, যখন ইন্টারনেটের দুনিয়া ছিল না; নেহাত ম্যাগাজিন, ডিশ এসবের ওপর মানুষকে নির্ভর করতে হতো আপডেটেড ট্রেন্ডের জন্য। কিন্তু ঠিক সে সময়েই তিনি এত প্রতিকূলতার ভেতরেও ফ্যাশন সম্পর্কে আপডেটেড ছিলেন, যা দেখে নিঃসন্দেহে এটাই বলা যায় যে সালমান ফ্যাশনের ব্যাপারে তাঁর নিজের যুগের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে ছিলেন।’

নাজমী জান্নাত আরো বলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মে সালমান শাহর মতো এমন কোনো ফ্যাশন আইকনের আবির্ভাব হয়নি, এর মূল কারণ বলতে আমার কাছে মনে হয় পরবর্তী প্রজন্মের যাঁরাই এসেছেন, হাতেগোনা দু-একজন বাদে ফ্যাশনের ব্যাপারে এতটা প্যাশনেট কেউ ছিলেন না। এতটা আগ্রহও কারো তেমন ছিল না, সবাই নকলসর্বস্ব একটা ট্রেন্ডকে অনুসরণ করাটাই সহজতর মনে করতেন। তবে এর ভেতরেও অনেকেই চেষ্টা করেছেন নিজস্ব স্বকীয়তার ট্রেন্ড দাঁড় করাতে, কিন্তু নানা কারণেই সালমানের কাছাকাছিও কেউ যেতে পারেননি। এটা হয়তো আমাদের সালমান-পরবর্তী যুগে সামগ্রিক ব্যর্থতার একটা প্রতিফলন। তবে আমি আশাবাদী এখনো, কেউ না কেউ আসবে, যে কি না সালমান শাহর কথা আমাদের সবাইকে আবার মনে করিয়ে দেবে নিজের ট্রেন্ড দিয়ে।’