হাল ছাড়ব না, লড়াই চালিয়ে যাব : লিপি খন্দকার

Looks like you've blocked notifications!
ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানার কর্ণধার লিপি খন্দকার। ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের ফ্যাশন শিল্প অঙ্গনে প্রায় কুড়ি বছর পথচলা বিবিয়ানার। বহু মানুষের ঘামে-শ্রমে তৈরি হয় একটি পোশাক। সুতা থেকে সেলাইকারী, পূর্ণ পোশাক তৈরিতে অনেকের নান্দনিক চোখ ও মস্তিষ্ক যুক্ত থাকে। পোশাকের গায়ে ফুটে ওঠে স্বদেশের চেতনার রং ও নান্দনিক কারুকাজ। আর বিবিয়ানার বিশেষত্ব হলো, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্তদের নব্বই শতাংশই নারী। নারীর কর্মসংস্থান তৈরিতে এ ফ্যাশন হাউসের অবদান অনেক। 

চারুকলার শিক্ষার্থী লিপি খন্দকার ছোটবেলা থেকেই নিজের মনের আয়নায় উঁকি দেওয়া আলপনাগুলো ফুটিয়ে তুলতেন নিজের পোশাকে। পরে নিজেই গড়ে তোলেন ফ্যাশন হাউস বিবিয়ানা। তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত এ প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে মানুষের মনে স্থান করে নেয়। ২০০১ থেকে পথচলা শুরু। এখন ফ্যাশন অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত নাম। অবশ্য বিবিয়ানার অংশীদারও রয়েছেন, তিনি লিপি খন্দকারের স্বামী কাজী হাসিবুল আহসান।

বাঙালির নানা পালা-পার্বণ, পবিত্র দুই ঈদ ও পূজার সময়গুলোতে বিবিয়ানা হাজারও নকশার পোশাকের পসরা সাজায়। কিন্তু কে জানত, একটি ক্ষুদ্র ভাইরাস কাঁপিয়ে দেবে গোটা বিশ্বকে! বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে নাকাল জনজীবন। সামাজিক ও শারীরিক দূরত্বের এই সময় জীবন বাঁচানোর তাগিদ নিশ্চয় পোশাক কেনার তাগিদকে দূরে সরিয়ে রাখছে। করোনার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের জনমনেও। তাই দেশীয় পোশাকশিল্পের পূর্বের সচলাবস্থা অনেকটাই স্থবির। স্থবিরতা প্রবেশ করেছে বিবিয়ানার ঘরেও!

বাঙালির বড় সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব পহেলা বৈশাখ ও পবিত্র ঈদুল ফিতরকে উপলক্ষ করে দেশি ফ্যাশন হাউসগুলো বৈচিত্র্যময় পোশাক সরবরাহ করে। গেল বৈশাখে করোনার তোপের মুখে পড়ে বিবিয়ানাও। লকডাউন-হোম কোয়ারেন্টিনের এই সময়ে ঘরে থাকাই যেখানে নিরাপদ, সেখানে বৈশাখী পোশাক কেনার লোক কজনই বা ছিলেন! বিবিয়ানার নকশাকার ও কর্ণধার লিপি খন্দকার জানালেন, গেল বৈশাখে তাঁর প্রতিষ্ঠানে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকা।

আর কিছুদিন পরই পবিত্র ঈদুল ফিতর। করোনাকালে জমছে না পোশাকের বিকিকিনি। দেশের বেশিরভাগ শপিং মল, শোরুম বন্ধ। অনলাইনে যদিও হোম ডেলিভারি দিচ্ছেন, তবে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এ নগণ্য।

সারা দেশে বিবিয়ানার মোট নয়টি আউটলেট। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় পাঁচটি—গুলশান, বনানী, বসুন্ধরা, মিরপুর ও উত্তরা। আর নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বগুড়ায় রয়েছে তাদের শোরুম। করোনাকালে সাতটি আউটলেটই বন্ধ। মাত্র দুটো খোলা। যেহেতু বিবিয়ানার ব্যবসা শোরুমকেন্দ্রিক, তাই বিক্রয়ে ভাটা। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। মৃদু স্বরে লিপি খন্দকার বললেন, ‘এর উত্তর আমারও জানা নেই। মানুষ না কিনলে কী করা যাবে। প্রায় সবার আয় এখন বন্ধ। সবই অনিশ্চিত।’

লিপি জানালেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এখন বিক্রি পাঁচ শতাংশে নেমেছে। আগের বছরগুলোতে ঈদের এ সময়ে প্রতিদিন বিবিয়ানার পোশাকের আনুমানিক বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা, এখন তা ঠেকেছে এর পাঁচ শতাংশে।

এ ক্ষতির সঙ্গে শুধু লিপি খন্দকারই জড়িয়ে আছেন, এমন নয়। জড়িয়ে আছেন অসংখ্য নারী। বিবিয়ানার সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত আট হাজারের বেশি নারী। তাঁদের ঘামে-শ্রমে তৈরি হয় প্রতিটি পোশাক। লকডাউনে পরিবহনব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ায় প্রান্তিক নারীর কাছ থেকে বিবিয়ানার ঘরে পৌঁছাতে পারছে না পোশাক। যদি পোশাকই না আসতে পারে, বিক্রি না হয়, তবে চলবেন কী করে এই নারীরা?

এনটিভি অনলাইনকে লিপি খন্দকার বলেন, ‘আমি কখনোই বিবিয়ানাকে ব্যবসা হিসেবে নিইনি। আমি মনে করি, এটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আমাদের পোশাকের দাম তুলনামূলক কম। যেন সবার কাছে তা পৌঁছাতে পারে, সে জন্যই এমন ভাবনা। করোনার অস্বাভাবিক পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে আমরাও চলতে পারব না। আমাদের ওই নারীরাও চলতে পারবেন না। তাঁরা পোশাকের কাজ করেই সংসার চালান। দেশের অর্থনীতি সচল রাখেন।’

প্রান্তিক নারী যাতে উপকৃত হন, সেই প্রয়াসেই বিবিয়ানার যাত্রা। লিপি খন্দকারের ভাষায়, ‘বিবিয়ানা প্রতিষ্ঠার সময় ভাবনায় ছিল, মানুষকে তো আর টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারব না। এর চেয়ে কর্মসংস্থানের প্রচেষ্টাই উত্তম। গ্রামের প্রান্তিক নারীরা সেলাইয়ের কাজ জানেন, তাঁদের হাতের যশে পোশাকে ফুটে ওঠে নানা সাংস্কৃতিক চিহ্ন, নকশা, ঐতিহ্যের ধারা। একজন প্রান্তিক সেলাইকর্মী তো বড় পরিসরে নিজের প্রডাক্ট বিক্রি করতে পারেন না, আমরা মাধ্যম হয়ে উঠলাম। আমি নিজে অনেককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সেখান থেকেই আজকের বিবিয়ানা।’ 

তবে গার্মেন্টশিল্প নিয়ে যেভাবে মানুষ উচ্চকিত, দেশীয় এ সেক্টরের প্রতি ততটাই উদাসীন বলে আক্ষেপ লিপি খন্দকারের। বিনয়ের সঙ্গেই বলেন, ‘এ সেক্টর নিয়ে মানুষ কম কথা বলে। সারিবদ্ধভাবে হাজারও মানুষ যখন একটি কারখানায় প্রবেশ করে, তখন তা বেশি চোখে পড়ে। আমাদের শিল্পেও হাজারও মানুষ কাজ করে। অনেক দূরে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেসব মানুষও ছোট ছোট দলে কাজে যায়। সব মিলিয়ে অসংখ্য মানুষ কাজ করে এ শিল্পে। হয়তো একসঙ্গে চোখে পড়ে না।’ 

‘আমাদের নারীরাও আশায় থাকেন, কখন পোশাক বিক্রি হবে, কখন তাঁরা টাকা পাবেন। আমি তাঁদের পারিশ্রমিক দিতে দায়বদ্ধ। কিন্তু বিক্রি না হলে কীভাবে দেব?,’ যোগ করেন লিপি।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কত দিন লাগবে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। তবে হাল ছাড়ার পাত্রী নন লিপি। বলেন, ‘আমরা ধরে নিয়েছি দু-তিন বছর এভাবে চলতে হবে। জানি না, অনিশ্চিত। পরিস্থিতি যা করতে বলে, তা-ই করব। তবে হাল ছাড়ব না। আগেই বলেছি, এটা ব্যবসার উদ্দেশ্যে করিনি। এর সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। এর সঙ্গে অনেক পরিবার জড়িত। দেশি শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আপনাদের মিডিয়ার ভূমিকা অনেক। আপনাদের বারবার এ শিল্পের কথা বলতে হবে।’

বাহারি বিজ্ঞাপন আর পুঁজির নিজস্ব চটকদারিতে মানুষ অনেক বেশি বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মানুষকে দেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে, এমনটাই মত বিবিয়ানার কর্ণধারের। সরকারের কাছে লিপি খন্দকারের অনুরোধ, দেশি শিল্প বাঁচাতে সরকার যেন প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়।

লিপি বলেন, ‘আগামী তিন বছর যেন বিদেশি পোশাক আনা বন্ধ করা হয়। না হলে দেশের পোশাকশিল্প দাঁড়াতে পারবে না। অথবা বিদেশি পণ্যে অধিক শুল্ক আরোপ করতে হবে। দেশি পণ্যে ভ্যাট কমাতে হবে। আর মানুষকে দেশি পণ্য কিনতে হবে। মানুষ দেশি পণ্য না কিনলে এ শিল্প বাঁচবে না। ক্রেতারা না কিনলে আমরা কী করব? বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। এই শিল্পে অনেক মেধা ও শ্রম জড়িত। কখনোই এখান থেকে সরে যাব না। হাল ছাড়ব না, লড়াই চালিয়ে যাব।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই নাকি লিখছেন, এবার ঈদে পোশাক না কিনে যেন গরিব মানুষকে সেই অর্থ দেওয়া হয়। লিপি খন্দকার মনে করেন, এবার স্লোগান হওয়া উচিত—‘একটা পোশাক কিনলে কিনব দেশি পোশাক’। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘দেশি পোশাক কিনলে সেই টাকাটা তো গরিবের কাছেই যাচ্ছে। যে মানুষটা পোশাক তৈরি করেছেন, তিনি তো গরিব। পোশাক বিক্রি না হলে সেই মানুষটি চলবেন কীভাবে। হাত পাতার চাইতে পোশাক বিক্রির টাকায় চলাই তো উত্তম।’

করোনাকাল কেটে যাবে। আবার ফিরে আসবে স্বাভাবিক অবস্থা। প্রান্তিক মানুষের মুখে হাসি ফুটবে, সেই সুদিনের অপেক্ষায় লিপি খন্দকার।