অন্য তারা
ক্রেতার ইচ্ছা পূরণ করে মাহিনের ‘মায়াসির’
পোশাক ও অলংকারের প্রতিটি ডিজাইনে দেশীয় শিল্পকে তুলে ধরাই তাঁর কাজ। মাঠ পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে মিশে গ্রামবাংলার কারুশিল্পের ধারা এগিয়ে নেওয়ার পেছনে অবিরত কাজ করছেন তিনি। দেশীয় ঐতিহ্যকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াই যাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য, সেই মাহিন খানকে নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে ‘মায়াসির’ ফ্যাশন হাউসের কর্ণধার ও প্রধান ডিজাইনার মাহিন খান কারুশিল্পের সঙ্গে তাঁর এতদিনের সখ্যের কথা জানালেন।
গোড়ার কথা
পড়াশোনা শেষ করেন আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসের ‘ফ্যাশন ইনস্টিটিউট অব ডিজাইন অ্যান্ড মার্চেন্ডাইজিং’ নামক প্রতিষ্ঠান থেকে। সেখানে তিনি তিন বছরের একটি ডিগ্রি নেন। এর পর দেশে ফিরে আসেন। কাজের শুরুটা হয় সেই ১৯৮৬ সাল থেকে। আড়ংয়ের ডিজাইনার হিসেবে তখন যোগ দেন তিনি। কিন্তু বেশিদিন সেখানে কাজ করা হয় না তাঁর। দুই বছর পর ১৯৮৯ সালে আবার লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরে যান। সেখানে ‘পারসনস স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ডিজাইন’-এ ভর্তি হন। চার বছরের বিএফএ শেষ করে ১৯৯৪ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। এর পর আবার আড়ংয়ে চিফ ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত আড়ংয়ে যুক্ত থাকেন তিনি। এর পর দেশীয় পণ্যকে সব প্রান্তের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিজেই বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউতে ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে ফ্যাশন হাউস ‘মায়াসির’ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর ২০০৪ সালে গুলশানে বড় পরিসরে ‘মায়াসির’ শুরু করেন।
‘মায়াসির’-এর পথচলা
‘মায়াসির’ ফ্যাশন হাউসের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কি—এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহিন খান বলেন, ‘মায়াসির-এর শুরুর সময়টাতে একটু চিন্তায় ছিলাম। কার সঙ্গে কাজ করব, আমার তাঁতি কে হবে, টেকনেশিয়ান কেমন হবে—সবকিছু মিলিয়ে একটু দ্বিধার মধ্যেই ছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে সব সহজ হয়ে গেল। বর্তমানে তিন হাজার মানুষ আমার সঙ্গে কাজ করছে। আমি মনে করি, এটি একটি সামাজিক ব্যবস্থা। আমরা যাঁরা কারুশিল্প নিয়ে কাজ করি, তাঁদের মাঠ পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা থাকে। তাঁরা ঘরে বসে কাজ করে আমাদের শিল্পের মানকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এক একটি কাজের পেছনে কতটা পরিশ্রম থাকে, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কনসেপ্ট থেকে শুরু করে শেষ হওয়া পর্যন্ত অনেক ধাপ পার হয়ে আসে। আমরা মানুষকে দামের দিক থেকে খুব একটা সুবিধা দিতে পারি না। তবে কোয়ালিটির দিক থেকে একটুও পিছিয়ে নেই। সেরাটাই দেওয়ার চেষ্টা করি। ক্রেতাদের বারবার ফিরে আসাতেই আমার কাজের তৃপ্তি।’
অনুপ্রেরণায়
এই শিল্পের প্রতি ভালোবাসা, কাজ করার আগ্রহ সবকিছুর পেছনে অনুপ্ররণায় ছিলেন আমার মা শিলু আবেদ। সেই ষাটের দশক থেকে আমি আমার মাকে দেখেছি কারুশিল্প, দেশীয় সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে। তিনিই আড়ংয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে তিনি লোকজ শিল্পের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। যাঁর হাত ধরে গ্রামবাংলার কারুশিল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হয়েছে। তাঁর কাজই আমার এই শিল্পের প্রতি উৎসাহের প্রধান কারণ।
বিশেষ কাজ
নিজের সব কাজের মধ্যে কোন কাজটি বিশেষ—জানতে চাইলে মাহিন খান বলেন, “আমার হাউসের বেশির ভাগ কাজেই এমব্রয়ডারি, নকশিকাঁথার কাজ থাকে। যার প্রতিটি ফোঁড় আলাদাভাবে প্রতিটিকে বিশেষ করে তোলে। সব পোশাকই এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট না হয়ে যায়। আর স্টাইলটাও এমনভাবে করার চেষ্টা করি, যাতে কয়দিন যেতে না যেতেই এর চল পুরোনো না হয়ে যায়। আর আমি মনে করি, এ কারণেই ‘মায়াসির’-এর পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের ভীষণ আগ্রহ কাজ করে। তাঁরা এখানকার পোশাকই বেছে নেয়। কারণ, তাঁরা ভালোটা চায়। সেই ইচ্ছাটা ‘মায়াসির’ই পূরণ করে।”
অবসর এবং ভালোলাগা
অবসরে ঘুরতে ভীষণ ভালো লাগে মাহিন খানের। দেশের মধ্যেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—সব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। প্রাচীন নিদর্শনগুলো তাঁকে বেশ টানে। পানামনগর, পাহাড়পুর তাঁর অনেক পছন্দ। এ ছাড়া দেশের বাইরেও তিনি বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। সাদা রং বেশ পছন্দ মাহিন খানের। খেতে ভালোবাসেন টক-ঝাল-মিষ্টি। অনেক ধরনের সালাদ বানাতে পারেন তিনি। সপ্তাহে তিন দিন জিমে যেতে ভুলেন না মাহিন খান। নিজেকে ফিট রাখতে সব সময় ফল, শাকসবজি আর প্রোটিনজাতীয় খাবারকে বেছে নেন মাহিন খান।
যাঁরা এই পেশায় আসতে চান
এই শিল্প নিয়ে অনেকেই কাজ করতে চান, এই পেশায় আসতে চান তাঁদের উদ্দেশে মাহিন খান বলেন, ‘ভুল না হলে মানুষ শেখে না। তাই শুরুতেই ভুল হলে পিছপা হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা থাকা অনেক জরুরি। পুরো প্রক্রিয়াটা ভালোভাবে রপ্ত করতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে রিসার্চ করতে হবে। তাহলেই শিখতে পারবেন। মনে রাখবেন, অল্প পুঁজি দিয়েও কাজ শুরু করা যায়। তবে যেটুকু কাজ করবেন, সৎ থাকার চেষ্টা করবেন, তাহলেই সাফল্য নিশ্চিত।’