জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে হিমশিম, ঢাকা ছাড়ছেন অনেকেই
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন নাজমুল হক তপন। বেতন পান ৫২ হাজার টাকা। তিন সদস্যের পরিবার তার। মেয়েটি এইএচএসসির ছাত্রী। তপন বলেন, ‘এখন আর সংসার চলছে না। গত চার বছরে বেতন বাড়েনি, কিন্তু খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। আসলে জোর করে এখন জীবন চালাচ্ছি। সেই মুড়ির টিন বাসের মতো। রাস্তায় চলাচলের কোনো অবস্থাই নাই। তাই ‘আল্লাহর নামে চলিলাম’ বলে জোর করে চালানো হচ্ছে। জীবন এখন মুড়ির টিন বাসের মতো।’
বেসরকারি এই কর্মজীবী আরও বলেন, ‘আগে মাসে একবার গরুর মাংস খেতাম। এখন তিন মাসে একবার খাই। দুধের খরচ বাঁচাতে দুধের চা খাওয়া বাদ দিয়েছি, রং চা খাই। গেস্ট আসলে শুধু দুধ চা চলে। বাসায় অতিথি আসলে আরও কষ্ট বেড়ে যায়। এখন শাক-সবজি দিয়েই চলছে। খাবার পরিমাণও কমিয়ে দিয়েছি। আর আগের বাসা পরিবর্তন করে মেয়ের স্কুলের কাছে ছোট বাসা নিয়েছি। তাতে বাসা ভাড়াও কম লাগছে আর স্কুলে যাওয়ার খরচও বেঁচে যাচ্ছে। তবে, যদি এভাবেই চলতে থাকে তাহলে সামনের বছর মেয়েটিকে পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করতে পারলে তাকে হোস্টেলে দিয়ে দেব। আর আমরা স্বামী-স্ত্রী এক রুমের একটি বাসা নিয়ে থাকব। তা না হলে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে হবে।’
একই ধরনের কথা বলেন রফিক রাফি নামে আরেকজন। তিনি বলেন, ‘আমার ৩০ হাজার টাকা বেতন। চারজনের সংসার। বাসা ভাড়া লাগে না। নিজেদের বাসায় থাকি। কিন্তু ওই বেতনে প্রতিমাসেই ধারদেনা করতে হয়।’
ঢাকায় একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন সালমা বেগম। তিনি ও তার স্বামীর মিলিয়ে তাদের মোট আয় ৭২ হাজার টাকা। সালমা বেগম বলেন, ‘আমাদের তিনজনের সংসার। শ্বশুর বাড়িতেও টাকা দিতে হয়। সবমিলিয়ে আমাদের চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। করোনার সময় থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। সেই ঋণ এখনও শোধ করছি। নতুন করে ঋণ নিয়ে কীভাবে শোধ করব? তাই নানাভাবে সংসারের খরচ কমানোর চেষ্টা করছি।’
এই নারী শিক্ষিকা আরও বলেন, ‘গত তিন মাসে যা অবস্থা, সব কিছুর দাম ১০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে। তাই মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। নতুন পোশাকও কিনছি না। তারপরও সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে।’
রংপুরের গফুর মিয়া এক বছর আগে ঢাকায় এসেছিলেন রিকশা চালাতেন। কিন্তু, টিকতে না পেরে আবার গ্রামে ফিরে গেছেন। গফুর মিয়া বলেন, ‘ঢাকায় এসে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিন মাস পর বউ ছেলে-মেয়েকে গ্রামের বাড়ি পাঠাই। এরপর একা থেকে অনেক কষ্ট করে ঋণ শোধ করে গ্রামের বাড়ি চলে এসেছি। এই বাজারে ঢাকায় টিকে থাকা সম্ভব ছিল না।’
গত অক্টোবরে সিপিডি তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, রাজধানীতে বসবাসরত চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসে খাদ্য ব্যয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। মাছ-মাংস বাদ দিলেও খাদ্যের পেছনে ব্যয় হবে ৯ হাজার ৫৯ টাকা। এটা ‘কম্প্রোমাইজ ডায়েট’ বা আপসের খাদ্য তালিকা। প্রচলিত ১৯টি খাবারের ওপর ভিত্তি করে তারা এই তথ্য দেয়।
সিপিডির গবেষণা বলছে, ২০১৯ সালেও একজনের উপার্জন দিয়ে চারজনের একটি পরিবার ১৭ হাজার ৫৩০ টাকায় চলতে পারত। তখন মাছ-মাংস বাদ দিলে ওই পরিবারের খাবার খরচ হতো ছয় হাজার ৫৪১ টাকা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘সিপিডির ওই হিসেব আরও সাত-আট মাস আগের। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। আমাদের বিবেচনায় মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যদিও সরকারের হিসেবে তা কম।’
এস এম নাজের হোসেন আরও বলেন, ‘যা পরিস্থিতি তাতে অনেকেই খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না। অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। নতুন করে ঋণ নিয়ে তারা শোধ করবেন কীভাবে? তাই একটি অংশ স্ত্রী সন্তানকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ আগের বাসা ছেড়ে কম ভাড়ায় ছোট বাসায় উঠেছেন। পরিবহণ ভাড়া কুলাতে না পেরে অনেকে এখন পায়ে হেঁটে চলাচল করছেন।’
প্রয়োজনীয় খাবার না খাওয়ায় একটি অংশ পুষ্টিহীনতায় ভুগতে শুরু করেছে বলেও জানিয়েছেন ক্যাব সহসভাপতি।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিবিএস) আজ রোববার মূল্যস্ফীতির সরকারি হিসেব প্রকাশ করেছে। তাতে মূল্যস্ফীতি আবারও বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে আট দশমিক ৭৮ শতাংশে পৌঁছেছে, যা জানুয়ারি মাসে ছিল আট দশমিক ৫৭ শতাংশ। তবে, গত বছরের আগস্টে এই হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ।