আত্মসমর্পণের পরামর্শ গ্রহণ না করে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেন শামিন : সিটিটিসি
নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় জঙ্গি সংগঠনটির প্রধানসহ আরও কয়েকজনকে আশ্রয় দেয় পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট। অভিযানের ধারাবাহিকতা দেখে জঙ্গি সংগঠনটির প্রধান শামিন মাহফুজকে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দেন কুক-চিন প্রধান নাথান বম। তবে, সেই পরামর্শ না মেনে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন শামিন। আজ শনিবার (২৪ জুন) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
গতকাল শুক্রবার রাতে রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে সস্ত্রীক গ্রেপ্তার হন শামিন। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের বিষয়ে আজ দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে সিটিটিসি।
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও মূল ব্যক্তি শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। এর মাধ্যমে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি হবে বলে আশা করছি।’
সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি প্রধান জানান, ছাত্রজীবন থেকেই শামিন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। এসএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে পঞ্চম স্থান অর্জন করেন। এরপর রংপুর ক্যাডেট কলেজে পড়াকালে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তাকে ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে, অন্য একটি কলেজে ভর্তি হলেও তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। এইচএসসিতে রাজশাহী বোর্ডে সপ্তম স্থান অর্জন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি হওয়ার পরই বড় ভাইয়ের ছেলের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে যান শামিন। যে সংগঠনটি পরে আনসার আল ইসলাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৭ সাল থেকেই শামিন সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা জসীম উদ্দিন রহমানীসহ শীর্ষ নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসেন।
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ঢাবিতে পড়াকালীন শামিন পাহাড়ে ক্যাম্পের পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী, তিনি পাহাড়ে যান। ঢাবি থেকে বের হয়ে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এর মধ্যেই তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিতে এনরোলমেন্ট হয়। তার গবেষণার বিষয় ছিল পাহাড়ে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। ইচ্ছা করেই তিনি এই বিষয়টি নেন, যাতে তিনি পাহাড়ে যেতে পারেন এবং সেখানে নিরাপদ আস্তানা তৈরি করতে পারেন।’
ঢাবিতে থাকাকালে শামিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কুকি-চিনের প্রধান নাথান বম এই তথ্য জানিয়ে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘শামিন উদ্দেশমূলকভাবেই নাথান বমের সঙ্গে পরিকল্পনা করে ঘনিষ্ঠতা করেন। তখনই নাথান বমের সঙ্গে পাহাড়ে বেড়াতে যান শামিন। ২০১৯ সালে নাথান বমকে জঙ্গি সংগঠন তৈরির কথাটি জানান শামিন। এবং সশস্ত্র জিহাদের প্রস্তুতের জন্য তাকে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তাব দেন।’
আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ‘২০২০ সালে কক্সবাজারের একটি হোটেলে বসে কুকি-চিন ও নতুন জঙ্গি সংগঠন শারক্বীয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক হয়। আমরা শামিনের কাছ থেকে হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার স্মারকটি উদ্ধার করতে পেরেছি। তখন থেকেই কুকি-চিনের আওতায় তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসি থেকে বলা হয়, ২০২১ সালে সিলেট থেকে ছয় তরুণ নিখোঁজ হয়। এপ্রিলে প্রথম ১২ জন নিয়ে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। কুকি-চিনের ক্যাম্পের পাশেই কেডিসি ক্যাস্প নামে ক্যাম্পটি পরিচালিত হয়। তখনই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বসে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে সংগঠনটি। ২০২২ সালের শুরুর দিকে ৩০ জনের বেশি তরুণ নিখোঁজ হন। তখনই আমরা এ সংগঠনের তৎপরতার বিষয়ে অবগত হই। শামিন মাহফুজের স্ত্রী, যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; তিনি ছিলেন আনসার আল ইসলামের ইজাজ কারগিলের স্ত্রী। যিনি কারগিল যুদ্ধে ড্রোন হামলায় মারা যান। ইজাজ যখন পাকিস্তান চলে যান তখন সংগঠনের সিদ্ধান্তে তার স্ত্রীকে বিয়ে করেন শামিন। তার স্ত্রীও সংগঠনের নারী সদস্য হিসেবে নারীদের দাওয়াতি কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা নাথান বমের সঙ্গে শামিনের সর্বশেষ যোগাযোগটা উদঘাটন করতে পারিনি। আমরা মনে করি, কোনো না কোনোভাবে তার যোগাযোগ থাকতে পারে। হিজরতে যাওয়া অধিকাংশকেই আমরা গ্রেপ্তার করতে পেরেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত জানা যাবে।’
শামিনকে গ্রেপ্তারের সময় পুলিশ কোনো প্রতিরোধের শিকার হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘না, আমরা এমন কোনো প্রতিরোধের শিকার হইনি। তারা দুজন (স্বামী-স্ত্রী) ছিলেন। আমাদের অফিসাররা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের নিষ্ক্রীয় করেছে।’