শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাবি শিক্ষকরা রাজপথে
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে রাজপথে নেমেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষকরা। আজ মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) দুপুরে রাবির ফটকের সামনে মহাসড়কে তাঁরা সমাবেশ করেন।
‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাজ’-এর ব্যানারে আয়োজিত এই প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশে প্রায় ২০০ শিক্ষক অংশ নেন।
এর আগে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে থেকে শিক্ষকরা মাথায় ও মুখে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল করেন। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে।
এরপর মিছিল নিয়ে শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের দিকে মহাসড়কে যেতে শুরু করেন। এ সময় ফটকের সামনের মহাসড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকের তালা খোলার অনুরোধ করলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তাকর্মী তালা খুলে দিলে তাঁরা ফটকের সামনে লাইন ধরে সমাবেশে মিলিত হন।
সমাবেশে শিক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য দেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, অধ্যাপক রায়হানা শামস ইসলাম, প্রাণরসায়ন বিভাগের অধ্যাপক রেজাউল করিম, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ফারুকী, আইবিএর অধ্যাপক হাছানাত আলী, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান, আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ফরিদুল ইসলাম প্রমুখ।
সমাবেশে অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব ছাত্রসমাজের ৯ দফা দাবির সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন, ‘তাঁদের দাবি ন্যায়সঙ্গত, ন্যায়বিচারের পক্ষে। শিক্ষকসমাজের দায়িত্ব হচ্ছে তাঁদের পাশে থাকা। শত শত জীবন ঝরে গেছে, আমরা রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। এই জীবন ঝরার তালিকায় ছয় বছরের শিশু থেকে সবাই আছে। যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষত কোনো দিনই সারানোর নয়। এই দুঃখবোধ সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। শিক্ষকরা আজ দলে দলে এসেছেন। এটা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা। দলমত-নির্বিশেষে সব নিপীড়নের বিরুদ্ধে থাকতে হবে। সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে শেখেন।’
অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, “কবি শামসুর রাহমান নূর হোসেনকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘নূর হোসেনের বুক নয়, যেন বাংলাদেশের হৃদয়।’ শিক্ষার্থী তোমরা যারা রাজপথে লড়ছ, তোমরা বাংলাদেশের হৃদয় না, তোমরা গোটা বাংলাদেশ। তোমাদের বুকে যে গুলিবিদ্ধ করা হয়েছে, তা সমগ্র বাংলাদেশের বুকে গুলি চালানো হয়েছে। সেই গুলি কোনো পরাশক্তি চালায়নি, চালিয়েছে এ দেশের তথাকথিত এক গণতান্ত্রিক শক্তি। প্রধানমন্ত্রী আপনিও দুই সন্তানের মা। আপনার সরকার প্রকাশ্য দিবালোকে কীভাবে নিরস্ত্র শিশু, ছাত্রজনতার ওপর গুলি চালাল? আপনি রাতে কীভাবে ঘুমান, আমার খুব বিস্ময় লাগে। আজকে মানুষের ভোটাধিকার নেই। অধিকার নিয়ে দাঁড়ালেই গুলি করে মারা হচ্ছে। রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটি দেশ এভাবে চলতে পারে না।’
ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ইসমত আরা বলেন, ‘আজকে আমার সন্তান কীসের জন্য প্রাণ দিল? তাঁদের দাবিটা কি খুব অন্যায্য ছিল? প্রধানমন্ত্রী কি তাঁদের এই দাবি মানতে পারতেন না? উনার কোথায় সমস্যা? উনারও তো সন্তান আছে। আমিও দুই সন্তানের মা। আজ মা হিসেবে আমি কথা বলতে পারছি না। আমি শুধু সেই মায়েদের কথাই ভাবছি, যাঁদের সন্তানরা তাজা রক্ত দিয়ে বলে গেল, আমাদের যৌক্তিক দাবি আমরা আদায় করেই ছাড়ব।’
বক্তব্য দেওয়ার এক পর্যায়ে অধ্যাপক ইসমত আরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘আজকের এই পরিস্থিতিকে বিশ্বের একটি দেশের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। আমরা কোনো পশ্চিম তীরে, কোনো গাজায়, রাফায় অবস্থান করছি। যেখানে মুখ না খুললেও গুলি করা হচ্ছে। সেখানে শিক্ষকসমাজ বসে থাকতে পারে না। ছাত্রজনতাসহ যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সরকার মুখে বলছে শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে রাত দুটার দিকে দরজায় নক করে খোঁজা হচ্ছে, ছাত্র আছে কি না। ধরে ডিবি অফিসে নিয়ে যাচ্ছে। নাটক সাজাচ্ছে, ভাতের টেবিলে বসাচ্ছে। এই দ্বিচারিতা মানুষ দেখতে চায় না। জনগণের পালস বোঝেন, জনগণের মনের অবস্থা বোঝেন। শিক্ষক সমাজ কতটা অসহায় হলে রাস্তায় নেমে আসে। কোনো লাঞ্চের টেবিলে এর সমাধান নেই। চোখে আঙুল দিয়ে এই ছাত্রসমাজ দেখিয়েছে বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে।’
অধ্যাপক ফরিদুল আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকসমাজ গতকাল পেনশন নিয়ে একটি মিটিং করেছে। আমি লজ্জিত শিক্ষক হিসেবে। এই অবস্থায় শিক্ষকদের পেনশন নিয়ে বসা উচিত হয়নি। অনেক সময় আছে। আপনার পেনশন মেনে নিতে বাধ্য। এখন আর কেউ বলবে না যে ওরা আন্দোলন করছে, করুক, ক্লান্ত হয়ে গেলে ফিরে যাবে। এই কথা বলার সাহস আর কারও নেই।’