এবারের ‘কান’-এর আদ্যপান্ত
কান চলচ্চিত্র উৎসবের সুবাদে এখন দক্ষিণের ফ্রেঞ্চ টাউন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু। তারকা, চলচ্চিত্র প্রযোজক শিল্প থেকে শুরু করে তাদের ঘিরে থাকা ভক্ত, ফটোগ্রাফার, সাংবাদিক কিংবা চির আবেদনময় রেড কার্পেট, মের ২২ তারিখ, অর্থাৎ আগামীকাল পর্যন্ত এর সবই থাকবে বিশ্বজোড়া চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রে। গত ১১ মে উডি অ্যালেন আর তাঁর নতুন সিনেমা ‘ক্যাফে সোসাইটি’র তারকাদের রেড কার্পেটের হাঁটার মধ্য দিয়ে এরই মধ্যেই পর্দা উঠেছে এই মহা আসরের। কান-এর এই আসরের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য থাকছে এই আয়োজনে।
পাম ডি’অর-এর দৌড়ে প্রথিতযশারা
যেমন ধারণা করা হয়েছিল, সেভাবেই চড়েছে প্রত্যাশার পারদ। পেদ্রো আলমাদোভার, হাভিয়ের দোলান, জিম জারমুশ এবং কেন লোচের মতো প্রথিতযশা নির্মাতারা এবার লড়ছেন পাম ডি’অর-এর জন্য। তালিকায় থাকা চারটি চলচ্চিত্রই প্রতিনিধিত্ব করছে ফ্রেঞ্চ চলচ্চিত্রের। যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্রগুলো যেমন- জিম জারমুশের ‘প্যাটারসন’ এবং শন পেনের ‘দ্য লাস্ট ফেস’-এর খাতিরে উৎসবে দেখা যাবে পরিচিত হলিউড তারকাদেরও। ভালো সিনেমা নির্মাণের জন্য খ্যাতিমান অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ইরানের প্রতিনিধিত্ব করছেন অস্কার জয়ী আসগার ফরহাদি আর রোমানিয়ার প্রতিনিধিত্ব করছে দুটি চলচ্চিত্র।
উৎসবে নিমন্ত্রণ পাওয়া পরিচালকদের ‘আমন্ত্রণ’কে ধরা হয় বিশেষ সম্মাননা হিসেবে, যেখানে তাদের সুযোগ দেওয়া হয় নিজেদের কাজ প্রদর্শনের, যার সুবাদে নিমন্ত্রণ পায় তাঁর চলচ্চিত্রের পুরো দল এবং তারকারাও। সেই তালিকায় এবার থাকছেন শার্লিজ থেরন, ইসাবেল হাপার্ট, রাসেল ক্রো, হাভিয়ের বারদেম, ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট ও ভিনসেন্ট চ্যাসেল।
প্রতিযোগিতায় ফিরল জার্মানি
লম্বা বিরতির পর আবার প্রতিযোগিতায় ফিরল একটি জার্মান চলচ্চিত্র। তরুণ নির্মাতা ম্যারেন এড প্রদর্শন করবেন এক বাবা আর তাঁর মেয়ের সম্পর্ককে উপজীব্য করে তাঁর নির্মাণ ‘টনি এর্ডমান’, যাতে অভিনয় করেন পিটার সিমনিসচেক ও সান্ড্রা হুলার। বিগত কয়েক বছরের কান-এর ইতিহাসে এটিই সর্বপ্রথম ‘সম্পূর্ণ জার্মান নির্মাণ’। সর্বশেষ জার্মান নির্মাতা হিসেবে এর আগে ২০০৮ কান-এ প্রতিযোগিতা করেছিলেন ভিম ভেন্ডার্স। পরিবর্তিত এই জার্মান প্রজন্মকে নিয়ে উৎসুক আয়োজক থেকে শুরু করে সিনিয়র জার্মান নির্মাতারাও। এ ছাড়া উৎসবে অংশগ্রহণ করছে বেশ কয়েকটি জার্মান সহ-প্রযোজনা। ‘নিউ জার্মান ফিল্মস’ শিরোনামে উৎসবের চলচ্চিত্র বাজারে নিজেদের ২৩টি প্রযোজনা প্রদর্শনীর মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় আগামীতে নিজেদের আবারও শক্তভাবে ফিরে আসার আভাস দিচ্ছে জার্মানি।
নির্বাচকদলের নেতৃত্বে ‘ম্যাড ম্যাক্স’ নির্মাতা জর্জ মিলার
পাম ডি’অর বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে আগামীকাল ২২ মে। এ বছর জুরি বোর্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ান নির্মাতা জর্জ মিলার। এ ছাড়া জুরিতে থাকছেন অভিনেতা ডোনাল্ড সাদারল্যান্ড, ম্যাডস মিকেলসন এবং কার্স্টেন ডান্সট, ফ্রেঞ্চ গায়িকা ভেনেসা পাহাদিস, পরিচালক লাজলো নিমেস এবং আর্নল্ড ডেস্প্লেসিন। তবে কান কখনোই শুধুমাত্র প্রতিযোগিতা কিংবা পাম ডি’অর-সর্বস্ব উৎসব নয়। উৎসবে জমা পড়া সর্বমোট ১৮৬৯টি সিনেমার মধ্যে মাত্র ৪৯টিকে নির্বাচন করা হয়েছে মূল উৎসবের জন্য। পাম ডি’অর-এর বাইরেও যেখানে সম্মানিত করা হয় অসাধারণ পরিচালক, তরুণ পরিচালক এবং প্রতিভাবান নবাগতদের। এ ছাড়া উৎসবের ‘বিশেষ প্রদর্শনী’তে থাকবে বিশ্বখ্যাত নির্মাতাদের চলচ্চিত্র, যেগুলো মূল প্রতিযোগিতায় আসতে ব্যর্থ হয়েছে। যার মধ্যে এবার থাকছে স্টিভেন স্পিলবার্গের শিশুতোষ ‘দ্য বিগ ফ্রেন্ডলি জায়ান্ট’ এবং জর্জ ক্লুনি, জুলিয়া রবার্টস অভিনীত ‘মানি মনস্টার’, যেটি নির্মাণ করেছেন জোডি ফস্টার।
জার্মানি আর যুক্তরাজ্যের রাজনীতি
‘বার্লিনাল’-এর মতো কান-এর গায়ে এখনো ‘রাজনৈতিক উৎসব’-এর তকমা লাগেনি। কারণ, কান-এর যাবতীয় মনোযোগ নির্মাতার নাম, খ্যাতি, সেলিব্রিটি আর গ্ল্যামারের দিকে। তবু কখনো কখনো খোদ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই উৎসবে ঢুকে পড়ে রাজনীতি। এবারের উৎসবে জার্মান শর্ট ফিল্ম ‘শেসকপিয়র ইন জাতারি’ জর্ডানের একটি রিফিউজি ক্যাম্পের গল্প নিয়ে নির্মিত, যার পরিচালনা করেছে জন্মসূত্রে সিরিয়ান, বর্তমানে জার্মানিতে বসবাসকারী মান মৌসলি। এডওয়ার্ড স্নোডেনের গল্প নিয়ে করা অস্কারজয়ী ‘সিটিজেন ফোর’-এর পর নির্মাতা লরা পয়ট্রাস কান-এ প্রদর্শন করবেন তাঁর আরেক রাজনৈতিক ডকুমেন্টারি ‘রিস্ক’, যার কেন্দ্রে থাকছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ।
চলচ্চিত্রের ইতিহাস পাঠ
এত গ্ল্যামার আর জাঁকজমকের ভিড়েও কান ফিরে দেখতে ভোলেনি ‘চলচ্চিত্রের ইতিহাস’। এই ইতিহাসের পাঠের সঙ্গে উৎসবে সম্মানও প্রদর্শন করা হবে চলচ্চিত্রের ‘গ্রেট’দের। ‘পাম ডি’অর অব দ্য ফেস্টিভাল’ নামে এই সম্মাননাটি এবার পাচ্ছেন ফ্রেঞ্চ অভিনেতা জ্যঁ-পিয়েরে ল্যুদ’। বার্ট্রান্ড ট্যাভের্নিয়ার সব ফ্রেঞ্চ চলচ্চিত্রের সম্মানে প্রদর্শন করবেন তাঁর চলচ্চিত্র ‘ভয়াজ আ থ্রাভেখ লো সিনেমা ফ্রসেঁ’ (Voyage à travers le cinéma français)। ‘সিনেমা মাস্টারক্লাস’ নামে একটি ওয়ার্কশপও থাকছে উৎসবে, যার সঞ্চালনা করবেন হলিউডের অভিজ্ঞ উইলিয়াম ফ্রিডকিন, যিনি সর্বাধিক পরিচিত তাঁর ‘দ্য ফ্রেঞ্চ কানেকশন’ এবং ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ চলচ্চিত্রের জন্য। এ ছাড়া ‘কান ক্লাসিক’ শিরোনামে প্রদর্শন করা হবে আন্দ্রেই তারকোভস্কি, কেনজি মিজোগুচি এবং জ্যঁ-লুক গদারের কয়েকটি চলচ্চিত্রের ‘ডিজিটাল ভার্সন’।