ক্রিস্টোফার নোলান, ক্যামেরার নেপথ্যে নায়ক
‘পেছনে তাকানোর আর সময় নেই, সবকিছু পাল্টে গেছে, তুমি সব পাল্টে দিয়েছ, সারা জীবনের জন্য’—‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমার এই ডায়ালগটির সঙ্গে সঙ্গেই যেন পাল্টে যায় সিনেমা ইতিহাসের একটা অংশ। ক্রিস্টোফার নোলান দেখিয়ে দিলেন, খলনায়ক কীভাবে ছাড়িয়ে যেতে পারে সুপারহিরোকেও। তবে নোলানের জন্য এ আর এমন কী! নিজের প্রতিটি ছবিতেই যে তিনি দর্শককে স্তম্ভিত করে দেন নির্মাণশৈলীর তাক লাগানো মেধায়।
একবার হলো কী! নোলানের লন্ডনের অ্যাপার্টমেন্টে সিঁধ কেটেছিল কোনো এক চোর। তাঁর কামরা ঘেঁটে ওই চোর দামি কিছু খুঁজে পেয়েছিল কি না, তা কেউ জানে না। কিন্তু চুরি করতে এসে সে রেখে গেছে অমূল্য কিছু। আর তা হলো ‘অনুপ্রেরণা’। শুনলে অদ্ভুত শোনালেও সত্যি যে এই চুরির ঘটনাই ক্রিস্টোফার নোলানকে উৎসাহিত করে সিনেমা বানানোয়। নিউইয়র্ক টাইমসকে নোলান এভাবেই নিজের রুপালি পর্দার জগতে রাজকীয় পদার্পণের গল্প বলেছিলেন তিনি।
শুধু ওই ছিঁচকে চোরের জায়গায় নোলান বসিয়ে দিলেন এক গল্পচোরকে। যে অপরিচিত মানুষের পেছনে ঘুরে বেড়ায় গল্পের সন্ধানে। পরে মূল সিনেমায় গল্পটির রূপান্তর হয় এমন : এক লেখকের সঙ্গে পরিচয় হয় এক চোরের। লেখক ওই চোরকে নিয়ে নিলেন নিজের সঙ্গে, গল্পের প্রয়োজনে। দুজনে মিলে শুরু করলেন নতুন এক গল্প। সিনেমাটির নাম দেওয়া হয় ‘ফলোয়িং’, মুক্তি পায় ১৯৯৮ সালে। আজকের দিনেও ‘ফলোয়িং’-কে বিবেচনা করা হয় একটি ‘ক্ল্যাসিক নয়্যার’ হিসেবে। অথচ অসাধারণ এই সিনেমা নির্মাণ করতে নোলানের মোট খরচ হয়েছিল মাত্র পাঁচ হাজার ডলার।
নিজের সর্বপ্রথম ‘ফিচার ফিল্ম’টি শেষ করতে-না-করতেই তাঁর ভাই জোনাথন নোলান তাঁকে শোনালেন ‘মেমেন্টো মোরি’ নামে আরেক অদ্ভুত সুন্দর গল্প। যেখানে বিশেষ ধরনের অ্যামনেশিয়ায় আক্রান্ত এক ব্যক্তি প্রতিশোধের নেশায় খুঁজে ফেরে তার প্রেমিকার হত্যাকারীদের। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ স্ক্রিনপ্লে আর ব্যতিক্রমধর্মী গল্প বলার ধরন দিয়ে পরে তাঁর বানানো ‘মেমেন্টো’ আরেকবার তাঁকে নিয়ে আসে সামনে। নজরে পড়েন প্রথিতযশা সমালোচক, চলচ্চিত্রকার, প্রযোজকদের। যার খাতিরে নোলান তাঁর তৃতীয় কাজটি করেন আল পাচিনো, রবিন উইলিয়ামস এবং হিলারি সোয়াঙ্কের মতো হলিউড সিনেমার রাঘববোয়ালদের নিয়ে। যে যাত্রার নাম দেওয়া হয় ‘ইনসমোনিয়া’।
নরওয়ের একটি সিনেমার রিমেক ছিল মূলত এটি। সিরিয়াল কিলারকে ধাওয়া করা এক ইনসমোনিয়াক পুলিশের গল্প বলে ‘ইনসোমোনিয়া’। যেখানে নিদ্রাহীনতা একসময় তাকে ভুলিয়ে দেয় ভালো আর খারাপের ফারাক।
সিনেমাটি নোলানের ক্যারিয়ারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ, মাত্র পাঁচ হাজার ডলার বাজেট থেকে ৪৫ লাখ ডলার বাজেটের সিনেমায় উত্তরণ ঘটে এই সিনেমার মাধ্যমে। তা ছাড়া সিনেমার অভিনেতাদের সবাই ছিলেন দুনিয়াখ্যাত। এই একটি সিনেমা অনেক দূর এগিয়ে দেয় নোলানকে।
সুপারহিরোদের মধ্যে ‘ব্যাটম্যান’কে নিয়ে বরাবরই অসীম আগ্রহ ছিল নোলানদের দুই ভাইয়ের। তার পরে একসময় লেখক ডেভিড এস গোয়্যারকে নিয়ে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নোলান ব্রাদার্স প্রথম দেখানো শুরু করেন ‘ব্রুস ওয়েন’-এর কালো দিক। সিনেমাটি পরে বক্স-অফিসে আয় করে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
এর পরপরই নোলানের দুই প্রযোজক ‘নিউমার্কেট ফিল্মস’ এবং বন্ধু অ্যারন রাইডার সিদ্ধান্ত নেন। ভিক্টোরিয়া সময়কালের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই জাদুকরকে নিয়ে তাদের এই গল্পের সূত্র মূলত ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত একটি বই। ক্রিস্টোফার প্রিস্ট নামের এক লেখকের এই বইটির নাম ছিল ‘দ্য প্রেস্টিজ’। নোলানের নির্মাণশৈলীর ছোঁয়ায় যে গল্পটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। ‘দ্য প্রেস্টিজ’-এ নোলান দর্শকের চোখে হাত দিয়ে দেখিয়েছিলেন ‘ঘোর’ আর সত্যিকারের স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য, একজন শিল্পী আর একজন সাধারণ সামাজিক জীবের দূরত্ব।
তার পরে নোলান আবার মনোনিবেশ করেন ‘ব্যাটম্যান’-এ। কিন্তু ‘ব্যাটম্যান বিগিনস’-এর বহুল প্রতীক্ষিত সিক্যুয়ালে খলনায়ক হিসেবে সুদর্শন হিথ লেজারকে মেনে নিতে পারছিলেন না কেউ। সিনেমার প্রথম স্থিরচিত্র আর ট্রেইলার বের হওয়ার পরই যেন ধাপ করেই নিভে গেল সব বিতর্ক। কারণ, হিথ তখন থেকেই তো ‘জোকার’ বনে গেছেন, যাতে এখনো বুঁদ পুরো দুনিয়া!
মুক্তির পরে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ‘দ্য ডার্ক নাইট’ পরিণত হলো ‘কিংবদন্তি’তে। সিনেমায় লেজারের ‘জোকার’ ছাপিয়ে গেল স্বয়ং ব্যাটম্যানকেও। সিনেমাপ্রেমীদের জন্য আজীবনের এক খোরাক উপহার দিলেন নোলান আর লেজার জুটি।
এর পর নোলান বাস্তবে রূপ দেন তাঁর নয় বছরের পুরোনো এক চিন্তাকে। দীর্ঘ এই সময় ধরে তিনি ধীরে ধীরে প্রস্তুত করলেন নিজেকে, তাঁর সবচেয়ে বড় উপহারের জন্য, বড় কিছু করার সাহস সঞ্চারের জন্য। তার পরে একদিন তিনি মুক্তি দিলেন ‘ইনসেপশন’ আর তাঁর সৃষ্টিশীলতায় উন্মত্ত করে তুললেন এরই মধ্যে দুনিয়াজোড়া তৈরি হওয়া লাখো কোটি নোলানভক্তকে। বক্স-অফিসে দুর্দান্ত সাফল্য পায় ‘ইনসেপশন’।
‘মেমেন্টো’, ‘ব্যাটম্যান বিগিনস’, ‘দ্য প্রেস্টিজ’ আর ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এর মতো সব সুপারহিট সিনেমা উপহার দেওয়ার পর ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’-এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দর্শককে কিছুটা হতাশ করেন নোলান। সিনেমার গল্পের ফাঁকফোকরগুলোর কারণে বেশ সমালোচনাও শুনতে হয় তাঁকে। অসাধারণ শুরু করেও ‘ডার্ক নাইট ট্রিলজি’র সফল সমাপ্তি টানতে কিছুটা ব্যর্থই বলা চলে তাঁকে।
কিন্তু ক্রিস্টোফার নোলান তো আর দমে যাওয়ার লোক নন। নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলেন তাঁর আরেক অসাধারণ সৃষ্টি ‘ইন্টারস্টেলার’ নিয়ে। পৃথিবীর বিকল্প বসবাসের উপযুক্ত গ্রহের সন্ধানে নামে একদল মহাশূন্য গবেষক, যা খুঁজতে গিয়ে তাদের পেরোতে হয় হাজারো চড়াই-উতরাই আর বাধা। কিন্তু বিজ্ঞান আর অ্যাডেভঞ্চারের মধ্যে নোলান সম্মিলন ঘটান পারিবারিক সম্পর্কের টানাপড়েনের। পুরো সিনেমায় বাপ-মেয়ে কুপার আর মার্ফের মধ্যে সম্পর্কের ঘুড়ি তৈরি করেন নোলান, শেষে এসে যার নাটাই তিনি তুলে দেন হ্যান্স জিমারের হাতে।
গুটিকয়েক বৈজ্ঞানিক ভুল থাকলেও ‘ইন্টারস্টেলার’কে সাদরেই গ্রহণ করে নেয় সবাই। এমনকি খোদ নেইল ডি’গ্রাসে টাইসনের মতো জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীরাও।
চিন্তাচেতনায় পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক মানুষটি হলেও ব্যক্তি নোলান নিজেকে সেকেলে ভাবতেই বেশি ভালোবাসেন। যার কারণে সঙ্গে রাখেন না কোনো সেলফোন, তাঁর নাকি কোনো ই-মেইল অ্যাড্রেসও নেই।
নোলানের সিনেমাগুলোর মধ্যে এক ধরনের সাদৃশ্য আছে। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, তিনি আসলেই কি এ প্রজন্মের সেরা? কিংবা সেরাদের অন্যতম? যার উত্তর কিছুটা তাঁর সিনেমাগুলোর সমাপ্তির মতোই—হয়তো বা নোলান সেরা, হয়তো বা না! এটা দর্শকেরই নির্ধারণ করার বিষয়।