কেমন আছে পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দারা

নানা ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কারণেই পুরান ঢাকার সুনাম দেশব্যাপী। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হলো এই বানর।
বানর হচ্ছে একমাত্র বৃহদাকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী, যা আজও এই কংক্রিটের অরণ্যে মানুষের সাথে টিকে আছে। একটা সময় পুরান ঢাকার বেশির ভাগ এলাকাই ছিল ঘন জঙ্গল আর গাছপালায় ভরপুর। এরপর হয়েছে নগরায়ণ, আধুনিকতার জোয়ারে বদলে গেছে চারপাশ। ঢাকা থেকে গাছপালা নদী-নালা, খাল-বিল হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হারিয়ে গেছে ঢাকায় বসবাসরত বিভিন্ন বন্য প্রাণী। ঢাকার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ এই বানরগুলো একেবারে হারিয়ে না গেলেও আর আগের মতো দেখা যায় না। কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ঢাকার এই আদি বাসিন্দারা।
পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া এলাকার দীননাথ সেন রোডের সাধনা ঔষধালয়ের কারখানা ও কারখানার পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে এখনো প্রায় এক থেকে দেড় শত বানরের দেখা পাওয়া যায়। যার নামে এই দীননাথ সেন রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে তিনি হচ্ছেন সুচিত্রা সেনের শ্বশুর। এই বানরগুলো এই এলাকায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসছে। ১৯১৪ সাল থেকে সাধনা চত্বর বানরের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
সাধনা ঔষধালয়ের ওষুধ বানানোর প্রধান উপকরণ ছিল গুড়। শোনা যায়, কারখানায় যখন ওষুধ বানানোর কাজ চলত তখন গুড়ের গন্ধে বানরগুলো এখানে আসত এবং চুরি করে গুড় খাওয়ার চেষ্টা করত।
এরপর থেকে সাধনার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ড. যোগেশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর ওষুধ কারখানার একটি কক্ষ বানরদের জন্য ছেড়ে দেন। সেই সাথে বানরদের সকাল-বিকাল খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন যা আজও অব্যাহত আছে।
সাধনা ঔষধালয় ছাড়াও পুরান ঢাকার আরো কিছু এলাকায় এখনো বানর দেখা যায়। ওয়ারীর নবাব স্ট্রিটের রবিদাশপাড়া, বংশাল, টিপু সুলতান রোড, জনসন রোড, নারিন্দার মৈশুণ্ডি, ফরাশগঞ্জ এলাকার বিবি রওজার পাশেও দেখা পাওয়া যায় কিছু বানরের।
বাংলাদেশে বানরের প্রজাতিগুলো হচ্ছে- রেসাস ম্যাকাক, পিগ টেইল ম্যাকাক, আসামিজ ম্যাকাক, স্ট্যাম্প টেইল ম্যাকাক, লজ্জাবতী বানর ও প্যারাল্যা বানর।
পুরান ঢাকার বানরগুলো ‘রেসাস ম্যাকাক’ প্রজাতির। দক্ষিণ এশিয়াই এদের আদিভূমি। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রজাতির রেড লিস্টে ঢুকে গেছে পুরান ঢাকার এই প্রাণী।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বন্য প্রাণী গবেষক মনিরুল এইচ খান পুরান ঢাকার বানর প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুরান ঢাকার বানরগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে খাবার ও বাসস্থান। দেয়ালের ফাঁক-ফোকরে ওরা নানা ধরনের কষ্ট সহ্য করে বসবাস করে যার কারণে বাসস্থানের খুব বেশি সমস্যা না হলেও দেয়ালের সাথে বেশি ঘষা লেগে লেগে বানরের পিছনের দিকে ও শরীরে বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি হয়। পুরান ঢাকার বানরের মূল সমস্যা হচ্ছে খাবার। দর্শনার্থীদের দেওয়া খাবারের ওপর নির্ভরশীল এই বানরগুলো। যা বানরের খাবারের চাহিদার তুলনায় একেবারেই যৎসামান্য।’
ঢাকার বানরগুলো চাহিদা অনুযায়ী খাবার না পাওয়ার কারণে এই বানরগুলো অনেকটা দুর্বল। পুরান ঢাকার বিশুদ্ধ খাবার পানির অনেক বেশি অভাব দেখা যায়। এই বানরগুলো খাবার পানির জন্য মানুষের বাড়ির ছাদের পানির টাংকি, নালা-নর্দমা ও বিভিন্ন দূষিত পানির উৎসের ওপর নির্ভর করে থাকে। এসব দূষিত পানি পান করার ফলেও বানরগুলো অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে অসুস্থতার কারণে মারাও যাচ্ছে।
বানরের খাবারের বিষয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ও কালচারাল অফিসার খন্দকার মিল্লাতুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে আমরা বানরের খাবার সরবরাহ করতাম, এখন আর করা হয় না। তবে কেউ যদি আমাদের কাছে বানরের খাবার সরবরাহ করার জন্য আবেদন করে তাহলে আমরা আবার বানরগুলোর খাবার সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
রেসাস প্রজাতির বানর উন্নত দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানীরা জীব রসায়নের বিভিন্ন আবিষ্কার করে প্রথমে রেসাস বানরের ওপর প্রয়োগ করে ফলাফল প্রত্যক্ষ করেন। মানুষ ও বানরের শারীরিক গঠনের মধ্যে যথেষ্ট মিল থাকায় বিজ্ঞানীরা বানরকেই বাছাই করে থাকেন। বহির্বিশ্বে বানরের যথেষ্ট চাহিদা এবং কিছু অসাধু মানুষ বানর পাচার করার কারণেও বাংলাদেশ থেকে দিনের পর দিন বানরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ অঞ্চলের প্রধান ড. তপন কুমার দের কাছে পুরান ঢাকার বানরদের সংরক্ষণের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকার বানর সংরক্ষণের বিষয়ে বন বিভাগের কোনো উদ্যোগ নেই। খাবারের অভাবে বানরগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাচ্ছে, যার কারণে মানুষ ও বানর উভয়েরই নানা রকমের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সবার সাথে আলোচনা করে ঢাকার বানরদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী যেমন আমাদের বসবাসের স্থান তেমনি অপরাপর বন্য প্রাণীদের বসবাসের স্থান। পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে তাদেরও। আর সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদেরই দায়িত্ব পৃথিবীতে বসবাসরত প্রত্যেকটা বন্যপ্রাণীর প্রতি সুনজর দেওয়া ও সংরক্ষণ করা। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ আপনার আমার সবার একটু সচেতনতা, উদ্যোগ ও ভালোবাসার হাতই সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পারে পুরান ঢাকার এই আদি বাসিন্দাদের।