গপ্পো তক্ক যুক্তি
আমি ঠান্ডা মাথার লোক নই : মার্টিন স্করসেসি
মার্টিন স্করসেসির জন্ম ১৯৪২ সালের ১৭ নভেম্বর। যুদ্ধাক্রান্ত নিউইয়র্কে বেড়ে উঠেছেন তিনি। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশে অনার্স এবং ফিল্মে মাস্টার্স করেন স্করসেসি। পড়ালেখা শেষে নেমে পড়েন ছবির কাজে। মার্কিন ছবিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন তিনি। কাজের জন্য সব ধরনের পুরস্কার পেয়েছেন। স্করসেসির নামকরা ছবির মধ্যে রয়েছে ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘রেজিং বুল’, ‘গুডফেলাস’, ‘কুনদুন’, ‘গ্যাংস অব নিউইয়র্ক’, ‘দ্য ডিপার্টেড’, ‘শাটার আইল্যান্ড’, ‘দ্য উলফ অব ওয়ালস্ট্রিট’। সাক্ষাৎকারটি ‘দ্য টকস’ থেকে ভাবানুবাদ করা হয়েছে। আর সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় ২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল।
প্রশ্ন : স্করসেসি, সিনেমার ভবিষ্যতের ব্যাপারে আপনি কি আশাবাদী না নিরাশ?
স্করসেসি : এখনকার সময়টা খুবই উত্তেজনার। কারণ, এখন সবই নতুন। যেসব ছবি মুক্তি পাচ্ছে, বেশির ভাগ কাজই একটি আরেকটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এটা ঠিক বিংশ শতাব্দী নয়।
প্রশ্ন : এটা কি ভালো না খারাপ?
স্করসেসি : না, আমি কোনো কিছুকে খারাপ বলছি না। কিন্তু এখনকার সিনেমা প্রদর্শনের যে প্রযুক্তি, সেটা তো সম্পূর্ণ আলাদা। এ ধরনের প্রযুক্তিতে তাঁরা তো ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ দেখেননি। আমার মনে হয়, নতুনদের সব সময় আগের দিনের ছবিগুলো দেখানো উচিত। এটাই দুই সময়ের মধ্যে একটা সংযোগ স্থাপন করতে পারে। না হলে সংস্কৃতির সবই আপনি ভুলে যাবেন। আমরা তাহলে শুধু অ্যানিমেটেড ছবি নিয়ে পড়ে থাকব। বড় বড় রাক্ষস পর্দায় আমাদের খাবে। আমরা বাস্তবেও তাদের পেটেই চলে যাব।
প্রশ্ন : সেটা তো ভয়ংকর ব্যাপার হবে?
স্করসেসি : ১০ বছর বয়সে আমরা যে ছবিটা দেখি, সেটা ২৫ বছর বয়সে দেখতে গিয়ে কিন্তু অন্য রকম মনে হবে। ৪০ বছর বয়সে গিয়ে দেখলে আপনার আগের সব ধারণাই পাল্টে যাবে। আর ৬০ বছর বয়সে গিয়ে আপনি যখন সব বয়সের ভাবনা জোড়া লাগাবেন, তখনই আসলে ছবিটি বুঝতে পারবেন। আপনার তখন মনে হবে, ‘আরে! ছবিটি তো দারুণ। এটা তো অনেক উন্নতি করেছে!’ কিন্তু সেটা কি তখনকার ১০ বছর বয়সী একটা শিশু নিতে পারবে? তার পৃথিবীর সঙ্গে কি সেটা মানানসই হবে? আসলে ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলে কেটে সাজিয়ে দিলেন, সেটা কীভাবে শিল্পকর্ম হয়ে উঠবে? কীভাবে সেটা সমাজের কাছে একটা মানে তৈরি করবে? আমি যে সময়ে বড় হয়েছি, সে সময়ের সিনেমাগুলো অর্থ বহন করত।
প্রশ্ন : আপনি কি বয়সের ব্যাপারে বেশি ভাবছেন?
স্করসেসি : আমার মনে হয় না, এ ভাবনায় আমি আক্রান্ত। ভাবের বিষয়টা অগভীর।
প্রশ্ন : তাহলে কি আবেগপ্রবণ?
স্করসেসি : আমি সব সময়ই আবেগপ্রবণ। আমার ক্ষেত্রে এটাই সত্যি। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে আপনি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছেন, বয়স বাড়ছে। আশপাশে মানুষজনকে জন্মাতে এবং মরতে দেখছেন। আবার বেশি বয়সে বাচ্চা নেওয়াটাও একটু আলাদা ব্যাপার। যেমন আমার দুই মেয়ে। প্রথম মেয়েটি যখন জন্মাল, তখন আমার বয়স ২০-এর কোটায়। আর দ্বিতীয়টা যখন জন্মাল, তখন আমার বয়স ৩০-এর কোটায়। দুটি বয়স কিন্তু আমার কাছে দুই রকম ছিল। এখন আমি জীবনের শেষ নিয়ে ভাবছি। যেমন আমার ‘জর্জ হ্যারিসন’ ছবিটার মতো। একজন রোমান ক্যাথলিক হওয়ায় আমাকে সব সময়ই আমার সমাপ্তি নিয়ে ভাবতে হয়।
প্রশ্ন : আপনি কি মেয়েদের আপনার ছবি দেখার অনুমতি দিয়েছেন?
স্করসেসি : (হেসে) না, না।
প্রশ্ন : কখন দেখতে দেবেন তাহলে?
স্করসেসি : আমি ও আমার স্ত্রী এটা নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা বলেছি। ওদেরকে আমি প্রথমে দেখাতে চাই ‘কুনদুন’ ছবিটা। অথবা ‘এলিস ডাজেন্ট লিভ হিয়ার অ্যানিমোর’, এমনকি ‘দ্য কালার অব মানি’ও দেখাতে পারি। আমার মনে হয়, এটা দেখার আগে ওদের ‘দ্য হাসলার’টা প্রথমে দেখতে হবে। এটা অন্যগুলোর চেয়ে ভালো ছবি। আমরা অবশ্য এভাবে ধরে-বেঁধে দেখাতে চাই না। আমার মনে হয়, ১৩-১৪ বছরের বাচ্চাদের জন্য হাসলারটাই ভালো হবে। তবে আমি ঠিক নিশ্চিত না, দেখা যাক এটা একটা মজার ব্যাপার হবে।
প্রশ্ন : আপনার বাবা কি আপনাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন?
স্করসেসি : আমার সঙ্গে বাবার বেশ সখ্য ছিল। ১৯৪০ কিংবা ৫০-এর দশকের শুরুতে যেসব ছবি হয়েছে, সেগুলো আমি নিজে হলে যাওয়ার আগে থেকেই দেখা শুরু করেছি। বাবা সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। সত্যিকারের বিনোদন পেতে আমি চলচ্চিত্রই দেখতাম। খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ, আড্ডাবাজি এসব বিষয়ে আমার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। এমনকি ঘোরাঘুরিতেও তেমন আকর্ষণ বোধ করতাম না। শুধু হলে গিয়ে ছবি দেখতেই ভালো লাগত।
প্রশ্ন : ১৯৫০-এর দশকে নিউইয়র্কে বেড়ে ওঠাটা কেমন ছিল?
স্করসেসি : আমি বেড়ে উঠেছি শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে। যেখানে মানুষ বই পড়ত না। রক্ষণশীল শ্রমিকগোষ্ঠী। যাঁরা চরম মন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে দিয়ে গেছেন। এর পরে তাঁরা আবার অর্থনৈতিক উন্নয়নও প্রত্যক্ষ করেছেন। মানুষের পকেটে টাকা থাকায় তাদের গাড়ি দিন দিন বড় হচ্ছিল। নিউইয়র্কের পূর্বাঞ্চলে যাদের কাছে পয়সা ছিল, তাদেরই বুদ্ধিমান ভাবা হতো। মানে আমি বলছি, সে সময়ের নিউইয়র্কে আপনি শ্রমিক শ্রেণির লোক, মানে আপনার কাছে কোনো গাড়ি নেই, আপনাকে শহরে চলতে হলে সাবওয়ে বা বাসে চড়তে হবে।
প্রশ্ন : স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পরিস্থিতি কেমন ছিল? সোভিয়েত আক্রমণের ভীতি কি সব সময় আপনাদের ভীত করে রাখত?
স্করসেসি : অনেকটা সে রকমই। স্কুলে নানরা সব সময় আমাদের বলতেন, নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানগুলোতে বোমা আছে। তাই একটু নিচ থেকে উড়ে যাওয়া কোনো বিমান দেখলেই আমরা ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। মনে হতো, এটাই বুঝি মাথার ওপর বোমা ফেলবে। আমি তখন প্রতিদিন স্কুলে যেতাম ভীষণ ঠান্ডার মধ্যে। আমাদের তখন ডগ ট্যাগস পরিয়ে দেওয়া হতো, যাতে বিমান থেকে আমাদের ওপর হামলা চালানো না হয়। আমরা স্কুলে যাওয়ার পথে প্রার্থনা করতাম, আজকে যেন বোমা হামলা না হয়। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার পথে হঠাৎ কানে মাইক্রোফোনের গুরুগম্ভীর গলায় ভেসে এলো, ‘অ্যাটেনশন প্লিজ, টেক কভার।’ তখন আমাকে লাফিয়ে পড়ে গাছের পেছনে আশ্রয় নিতে হতো হামলা থেকে বাঁচার জন্য। এটা তো কোনো স্বাভাবিক বিষয় ছিল না।
প্রশ্ন : চলচ্চিত্র বানাতে গিয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় কি পাগলামি করেছেন আপনি?
স্করসেসি : আমার কাছে তো সবকিছুই পাগলামি মনে হয়েছে। আমি যখন ছবি বানাই আমি আসলে বুঝিনা আমি আসলে কিসের সাথে জড়িয়ে পড়েছি। ‘রেজিং বুল’ যখন আমরা শুট করছিলাম তখন আমি আর আমার প্রোডিউসার বলছিলাম, ‘এগুলা তো পাগলামি, আমরা কিভাবে এর সাথে জড়িয়ে পড়লাম’! কিন্তু সেটা যদি আমরা প্রথমে বুঝতে পারতাম তাহলে হয়তো ওই ছবির কাজে হাতই দিতাম না।
প্রশ্ন : অভিনেতারা কখনো কোনো কাজে আপত্তি করেছেন?
স্করসেসি : না, অভিনেতারা কখনো আপত্তি করেননি। কিন্তু ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি মাইকেল বালহাউস একবার আপত্তি করেছিলেন। ‘দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অব ক্রাইস্ট’ ছবির প্রথম দৃশ্যধারণের পর মাইকেল বলেছিলেন, ‘পুরো ছবিই যদি এভাবে শুট করতে হয়, তাহলে ব্যাপারটা খুব কঠিন হয়ে যাবে। সব শটই আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করবে।’
প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয়, কাজগুলো ঠিকঠাকভাবে হয়েছে?
স্করসেসি : বাকিরা হয়তো বলবে, কাজগুলো অন্যভাবেও করা যেত, অন্য পদ্ধতিতে। ঠান্ডা মাথায় আরো সাবধানে করা যেত। কিন্তু আমি আসলে ঠান্ডা মাথার লোক নই।