গুদামে জায়গা নেই, খোলা আকাশের নিচে সার

এক মাস ধরে পাবনাসহ গোটা উত্তরাঞ্চলের সার ডিলাররা ইউরিয়া সার উত্তোলন না করায় বাঘাবাড়ী বাফার গুদাম ও নগরবাড়ী ঘাটে সারের স্তূপ জমে উঠেছে। গুদামে জায়গা না থাকায় বাঘাবাড়ীতে বাফার স্টকের গুদামের সামনে ও নগরবাড়ী ঘাটে হাজার হাজার টন ইউরিয়া সার খোলা আকাশের নিচে রাখা হয়েছে।
পাবনা, সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার বিভিন্ন উপজেলার জন্য বরাদ্দকৃত এসব সার রোদ-বৃষ্টি-কুয়াশায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে এর গুণগত মান।
সরেজমিনে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) বাফার স্টকের গুদাম রয়েছে মোট ১৪টি। এর মধ্যে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে অবস্থিত বাফার স্টকের গুদাম থেকে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় সার সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) নির্মাণ করা (পরে বিসিআইসিকে হস্তান্তর করা হয়) এই গুদামটির ধারণক্ষমতা মাত্র ছয় হাজার টন। অথচ বর্তমানে গুদামের ভেতর-বাইরে মিলিয়ে ১৮ হাজার টনেরও বেশি সার মজুদ রয়েছে।
বিসিআইসির বাঘাবাড়ী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বোরো মৌসুমের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিসিআইসি পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় ৫০ হাজার টন ইউরিয়া সার সরবরাহ করে থাকে। এসব সার বাঘাবাড়ী বাফার স্টকের গুদামে আনার পর তা দুই জেলার বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সার আসে বলে প্রতিবছরই সার গুদামের বাইরেও স্তূপ করে রাখা হয়।
অন্যান্য বছর স্তূপ থেকে সারগুলো দ্রুত সরবরাহ হলেও এ বছরের ক্ষেত্রে তা হয়নি। গত সেপ্টেম্বরে বরাদ্দকৃত সারের অর্ধেক উত্তোলন করেননি সার ডিলাররা। ফলে অন্যান্যবারের তুলনায় এবার গুদামের সামনে সারের স্তূপ বড় হয়েই চলেছে।
গুদামের কর্মকর্তারা জানান, ছয় হাজার টন ধারণক্ষমতার গুদামে ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়েছে নয় হাজার টন সার। আর বাইরে স্তূপ করে রাখা হয়েছে আরো নয় হাজার ৩০০ টন সার। এর পরও গুদামটিতে বিসিআইসির কারখানাগুলো থেকে সার আসা অব্যাহত থাকায় মজুদের পরিমাণ ভারী হয়েই চলেছে।
বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের শ্রমিক লুৎফর এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এবার সার জুমতি জুমতি পাহাড় হয়া গেছে। এর আগে গুদামের বাইরে এত সার কখনো রাখতি দেখি নাই।’
সার পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত ট্রাকচালক জানে আলম বলেন, ‘অন্য বছর সারের ডিলাররা এ সময়ে সার নেওয়ার জন্য পাগল হয়ে ওঠেন। কিন্তু এবার সে অবস্থা এখনো শুরু হয় নাই।’
বিসিআইসির বাঘাবাড়ী বাফার স্টক গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুদেব কুমার ভট্টাচার্য এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ডিলাররা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম সার উত্তোলন করায় গুদামে সারের মজুদ ব্যাপক বেড়ে গেছে। এর ফলে গুদামের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত সার এভাবে বাইরে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় ১৫ দিন বা এক মাসও রাখা হতে পারে।’
গুদাম কর্মকর্তা দাবি করেন, ইউরিয়া সার দীর্ঘদিন বাইরে রাখা হলে তার গুণগত মানের কোনো ক্ষতি হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিলাররা জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে যে সার উত্তোলন করেছিলেন, তার অনেকটাই এখনো অবিক্রীত রয়ে গেছে। আর এ কারণেই তাঁরা বাফার স্টকের গুদাম থেকে আপাতত সার উত্তোলনে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানায়, জানুয়ারিতে জেলার নয়টি উপজেলায় সারের বরাদ্দ ছিল ৭১৫ টন। ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত জেলার ১০৪ জন সারের ডিলারের কাছে মজুদ ছিল ৮২০ টন সার।
বেড়া পৌরসভার সারের ডিলার নূরুল ইসলাম বলেন, ‘আগের উত্তোলন করা সার এখনো গুদামে পড়ে আছে। এ কারণে বাজারে ব্যাপক চাহিদা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সার উত্তোলন করছি ধীরগতিতে। শিগগিরই বাজারে সারের চাহিদা বাড়বে বলে আমাদের ধারণা।’
বেড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বোরো চাষ কিছুটা পিছিয়ে যাওয়ায় এবার সারের স্বাভাবিক চাহিদা এখনো দেখা দেয়নি। তা ছাড়া সারের দাম কম হওয়ায় অনেক ডিলার বেশি করে সার তুলে রেখেছেন। এ কারণে তাঁরা বাফার স্টকের গুদাম থেকে ধীরগতিতে সার উত্তোলন করছেন বলে গুদামে সারের মজুদ বেড়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, দীর্ঘদিন খোলা আকাশের নিচে সার রাখা হলে তার গুণগত মান অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এদিকে, বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী ঘাটেও প্রচুর সার খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখতে দেখা গেছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন সারের গুদামগুলো ভর্তি হয়ে যাওয়ায় জাহাজ থেকে এসব সার নামিয়ে নদীপাড়ে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বাফার স্টকের গুদামে এসব সার ট্রাকে করে নেওয়া হবে।
নগরবাড়ী ঘাটের শ্রমিক সরদার রফিকুল ইসলাম বলেন, গুদাম ভর্তি হয়ে যাওয়ায় নদীপাড়েই সার রাখা হচ্ছে। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই সারগুলো ট্রাকে করে বিভিন্ন স্থানে চলে যাবে।
নগরবাড়ী ঘাট বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বিশিষ্ট সার ব্যবসায়ী এ এম রফিকউল্লাহ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নগরবাড়ী ঘাটে জরুরি ভিত্তিতে বিসিআইসির বাফার স্টকের গুদাম স্থাপনের প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেও সাড়া পাচ্ছি না।’
এখানকার ব্যক্তিমালিকানাধীন গুদামগুলোতে জায়গা না থাকায় এবং সার নিয়ে আসা জাহাজগুলো থেকে সাত দিনের মধ্যে সার খালাস করার নিয়ম থাকায় পরিবহন ঠিকাদাররা নদীপাড়েই সার নামিয়ে রাখছেন। বাইরে রাখা সার ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হয় বলে সেগুলোর গুণগত মানের কোনো ক্ষতি হয় না বলে দাবি করেন রফিক উল্লাহ।