প্রিয় ম্যারাডোনা, তুমি হারোনি, তুমি জিতেছ!
ছোটবেলা থেকে একজন খেলোয়াড়কে মনেপ্রাণে ভালোবাসি। তিনি হলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। আমরা জানি, ফুটবল মানেই উত্তেজনা। আর উত্তেজনার প্রাণপুরুষ হিসেবে সব সময়ই ম্যারাডোনাকে সঙ্গী করতাম। সবকিছুতেই ম্যারাডোনা ছিল অনন্য এক তুলনা। ম্যারাডোনার প্রতি ভালোবাসা কখনো কমেনি। ম্যারাডোনা মাঠে না থাকলেও সাথে থেকেছে সব সময়। প্রতিটি ফুটবল ম্যাচের অনন্য এক প্রাণপুরুষ ছিল প্রিয় ম্যারাডোনা। তাঁর সেই ১০ নম্বর জার্সি প্রতিটি খেলোয়াড়ের স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। তাঁর জন্য নিখাদ ভালোবাসা হৃদয়ে যেভাবে স্থান পেয়েছে, সেভাবে আর কোনো খেলোয়াড় স্থান করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।
প্রিয় ম্যারাডোনার বিদায় মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। ৬০ বছর তিনি ছিলেন কোটি মানুষের হৃদয়ে-স্বপ্নে-ভালোবাসায়-উল্লাসে-বেদনায়। পায়ের টোকায় তৈরি করেছেন শিল্পের সৌধ। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন কল্পনার রাজ্যে। সাফল্য পায়ে লুটিয়েছে, আবার ব্যর্থতাও এমন মাত্রা পেয়েছে যে মানুষ ভেবেছে এ তাঁরই হার। এই গ্রহকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা জাদুকরের বিদায় তাই পৃথিবীর জন্য হৃদয় ভাঙার। অদ্ভুত এক বিয়োগব্যথায় বিষণ্ণ আফ্রিকা থেকে আমেরিকা। আর্জেন্টিনা থেকে বাংলাদেশ।
ম্যারাডোনা আমাদের এত আপন, কারণ বুয়েনস এইরেসের বস্তি থেকে তাঁর উঠে আসাটাই যেন এক রূপকথা। মাথার ওপরের ছাদটা এমনই বিপজ্জনক ছিল, যেকোনো দিন সেটা ধসে যেতে পারত। পুলিশ এসে নিয়মিত দেখত, সেই বাসাটা আস্ত আছে কি না। সেই বস্তির সামনে কাদা আর আবর্জনার পাঁক, ছোট্ট দিয়েগো মাঝে মাঝে পড়ে যেত তাতে। চাচা চেঁচিয়ে উঠত, ‘পাঁকে ডুবে যাস না যেন, মাথাটা ভাসিয়ে রাখ।’ দিয়েগো সেটাই মনে রেখেছিল। ছেলেবেলায় এমন কোনো কাজ নেই, যেটা তাকে করতে হয়নি। ট্যাক্সিচালকের সহকারী থেকে ময়লাকুড়ানি, টোকাই থেকে কত ধরনের কাজ করতে হয়েছে। কে জানে, ময়লা কুড়াতে গিয়ে ভাঙা কাচ এড়িয়ে চলার যে কায়দা শিখেছিলেন, সেজন্যই বোধ হয় একের পর এক ডিফেন্ডারদের কাটিয়ে স্বপ্নের ওই গোল করতে পেরেছিলেন।
ম্যারাডোনার মতো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ সম্ভবত আর কোনো ফুটবলার কেন, খুব কম মানুষই দেখেছে। প্রথম যখন খেলতে গিয়েছিল, আর্জেন্টিনো জুনিয়রস থেকে বলা হয়েছিল, এই ছেলের বয়স নির্ঘাত আটের চেয়ে বেশি। আবার ডাক্তার ডাকা হলো, সার্টিফিকেট দেখা হলো। ম্যারাডোনা খেলার সুযোগ পেল, আর বাকিটা ইতিহাস। ১১ বছরের মধ্যে একেবারে পত্রিকার প্রথম পাতায়। ১৫ বছরের মধ্যে পেশাদার চুক্তি, এরপর শুধু একটার পর একটা সিঁড়ি তরতর করে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু এর মধ্যেও ম্যারাডোনা বারবার মেজাজ হারিয়েছেন। স্কুলে তাঁকে গ্রেস দিয়ে পরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যেই মারামারি করে গেছেন সবার সাথে। বোকার আর্থিক সুবিধার জন্য শরীরের কথা চিন্তা না করে কিশোর ম্যারাডোনাকে খেলে যেতে হয়েছে একের পর এক ম্যাচ, পরে শরীর সেটার শোধ তুলেছে। কিন্তু ম্যারাডোনা পেশাদার হতে পারেননি। সারা জীবন নিজের মর্জিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
কিন্তু ম্যারাডোনা বলেই বারবার রঙ্গমঞ্চে ফিরেছেন। অভিজ্ঞতাশূন্য হয়ে দলকে নিয়ে কোচ হিসেবে বিশ্বকাপে গেছেন। যুক্তির চেয়ে আবেগ দিয়ে দল চালানোর চেষ্টা করেছেন। জাদুটা অবশ্য রেখে এসেছিলেন মাঠেই, কোচ হিসেবে করতে পারেননি কিছুই। কিন্তু এত কিছুর পরও ম্যারাডোনা দেবতা হয়েছেন এই সাধারণত্বের জন্যই। মানুষ আপন ভেবেই তাঁকে বসিয়েছে হৃদমাঝারে।
ম্যারাডোনা নিষিদ্ধ হয়েছেন, নির্বাসিত হয়েছেন। ফিরে এসেছেন। মুটিয়ে গেছেন, আবার শুকিয়েছেন। মৃত্যুকে চুমু খেয়ে এসেছেন। আবার ফিরে জীবনকে করেছেন আলিঙ্গন। আনন্দের কান্না কেঁদেছেন, আবার ব্যর্থতায়ও চোখের জলে দুকূল ভাসিয়েছেন। কাঁদিয়েছেন অনেক বার, শেষবার কাঁদালেন মৃত্যুর পর। ম্যারাডোনা হেরেছেন, কিন্তু তার আগে জিতিয়ে দিয়ে গেছেন ফুটবলকে। প্রিয় ম্যারাডোনা, তুমি হারোনি, তুমি জীবনকে জিতিয়েছ।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়