বাজেট
ধার করে ঘি খাওয়া স্বাস্থ্যকর নয়
আগামী ৪ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জন্য প্রায় তিন লাখ এক হাজার কোটি টাকার বিশাল বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যা চলমান অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাজেটের আকার বৃদ্ধিতে উল্লসিত অর্থমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বাজেটটি পাঁচ লাখ কোটি টাকা করার আশাবাদও জানিয়েছেন। আপাতভাবে দেখলে ও শুনলে মনে হবে, বছর বছর যেহেতু খরচ বাড়ছে, তাই বাজেটের আকার তো বিশাল হবেই! নিশ্চয়, তা বাড়বে কিন্তু তার তো একটা মাত্রা থাকবে! আর আয়ের জোগান না বাড়িয়ে আকার ঢাউস করার মধ্যে কৃতিত্ব কিছু নেই। মোদ্দা কথায়, ধার করে ঘি খাওয়ার অভ্যাস ব্যক্তি, পরিবার বা রাষ্ট্র কারো পক্ষেই স্বাস্থ্যকর নয়। গেল ছয় বছরের বাজেট খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, অর্থমন্ত্রী ‘ঋণং কর্ত্তা ঘিতং পিব্যেত....’ নীতিতে চালাতে চায় দেশটা। আগে পিছে না ভেবে যে হারে ঋণ নিচ্ছে সরকার তাতে ১৬ কোটি মানুষের মাথাপিছু ঋণভারে নুয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে বাংলাদেশের।
মহাজোট সরকারের ২০০৯-১০ অর্থবছরের প্রথম বাজেট ছিল এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার। যেখানে ১৩ হাজার কোটি টাকা দেশীয় ঋণের সুদসহ মোট সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি! এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১-১২ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৩ হাজার ৯১৫ কোটি এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এসে ২৬ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছর সুদ বাবদ বাজেটে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। এ কারণে প্রতিবছরই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ জনগুরুত্বপূর্ণ সব খাত পেছনে ফেলে সর্বোচ্চ বরাদ্দ যাচ্ছে সুদ পরিশোধ খাতে। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে হয়তো সুদ পরিশোধ মন্ত্রণালয়-বিভাগ খুলতে হবে সরকারকে। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৪ ভাগ বা ৩১ হাজার ৪৩ কোটি টাকা রাখা হয়েছে সুদ পরিশোধ খাতে। যদিও সরকারের ভাষ্য শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু শুভঙ্করের ফাঁকি হলো শিক্ষার সঙ্গে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ যোগ করে বড় করে দেখানো হয়েছে। একক খাত হিসেবে গেল কয়েক বছর ধরে শীর্ষে রয়েছে সুদজনিত ব্যয়।
আসছে বাজেটেও যে সুদ পরিশোধ খাতেই সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকবে, তা সহজেই অনুমেয়। এসব ঋণের সিংহভাগই দেশীয় ব্যাংক থেকে নেওয়া, যা অত্যন্ত চড়া সুদে নিতে হয় সরকারকে। সুদ পরিশোধের ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, এই অর্থমন্ত্রীর আমলেই হু হু করে বেড়েছে ঋণের বোঝা। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশি ও বিদেশি ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছিল নয় হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। তাই বাজেটের আকার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ঋণ করে ঘি খেতে কম যান না অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতির জন্য এ বড় উদ্বেগের, উৎকণ্ঠার। সুদ পরিশোধের মাধ্যমে এত বেশি টাকা বেরিয়ে গেলেও তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ জনগণের স্বার্থে খুব বেশি কাজে আসে না। বরং জনগণের মাথায় চাপে ঋণের বোঝা। তারপরও বিশাল আকারের বাজেট দিতে গিয়ে জনগণকে ঋণের জালে আটকে ফেলা হচ্ছে। সঙ্গে চাপানো হচ্ছে নতুন নতুন করের বোঝা। উন্নয়ন বাজেটের তিন ভাগের এক ভাগের সমান টাকা খরচের লাগাম টেনে ধরা জরুরি। সময় হয়েছে এই বাজেটের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার।
এ জন্য গতানুগতিক চিন্তার বাইরে গিয়ে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় বাজেট প্রণয়ন হয়, তাতে আগের অর্থবছরের খাতওয়ারি বরাদ্দে কম-বেশি করা হয় মাত্র। মৌলিক বা গুণগত কোনো পরিবর্তন হয় না বললেই চলে। অনেকটা বরাদ্দ কম-বেশির ‘কাট কপি পেস্টের’ আদলেই তৈরি করছেন আমলারা। যেখানে সত্যিকার মেধার ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না। ব্যবসায়ীসহ অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে নিয়ম রক্ষার প্রাক-বাজেট হলেও সেসব মতামত খুব একটা জায়গা পায় না বাজেটে। বাজেট পেশের পর সংসদেও এসব নিয়ে কার্যকর কোনো আলোচনা হয় না বললেই চলে। ফলে তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আড়ালে অগণতান্ত্রিক রীতিতেই বাজেট তৈরি হচ্ছে বছরের পর বছর, যা বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়নের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। এসব বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের চেয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে আসে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রক্ষেপণের বিষয়টি। বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতিতে গড়ে ছয় ভাগ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত ভালো। প্রায় এক দশক ধরে গড়ে ছয় ভাগ প্রবৃদ্ধি উন্নয়নশীল বিশ্বে বিরল। ফলে জোর করে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টার চেয়ে বাজেটের নীতি কাঠামো আরো জনবান্ধব ও প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া বেশি জরুরি। তাহলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়বে প্রবৃদ্ধির হার।
গেল এক বছরে প্রশাসনিক কাজে এমন কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেনি সরকার। ফলে অতিমাত্রায় রাজনীতিকীকরণের কারণে সর্বত্রই ‘চেইন অব কমান্ড’ আগের চেয়ে আরো দুর্বল হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি খরচের যোগ্যতা কি আছে আমাদের? এক কথায় নেই, কিন্তু তারপরও ৯৭ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি ধরা হয়েছে আসন্ন বাজেটে। এডিপির লম্বা আকার মাঝপথে কাটছাঁট আর শেষ দুই মাসে যেনতেনভাবে টাকা খরচের মচ্ছব এখন রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এ কারণেই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয় না দেশের। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন- এ কথাটি অসংখ্যবার বলেছেন যোগাযোগ মন্ত্রীসহ হর্তাকর্তারা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের দেড় বছর পরও চার লেনে উন্নীত করার কাজের অর্ধেকটাও শেষ হয়নি এখনো। অথচ প্রকল্পের খরচ বেড়েছে বহুগুণে। দুনিয়ার কোথাও একটি রাস্তা তৈরিতে এত সময় লেগেছে বলে জানা নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের যদি এই হাল হয়, তাহলে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কী অবস্থা? পরিস্থিতি এমনই যে পুরো রাস্তার কাজ যখন শেষ হবে, তখন হয়তো আগে শেষ হওয়ায় মহাসড়কের অনেক জায়গায় সংস্কার করতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাবে দেশ। কিন্তু বাড়বে টাকার অপচয়। এ কারণেই ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্প সংশোধিত হতে হতে গিয়ে ঠেকে দুই হাজার কোটি টাকায়। তাই খরচের গুণগত মান বাড়ানো তথা এডিপি বাস্তবায়ন বাংলাদেশের বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ। সেদিকেই মনোযোগ দেওয়া বেশি জরুরি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল জনবহুল দেশের জন্য প্রকল্পের সংখ্যা কমিয়ে বেছে বেছে প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন। প্রকল্পসংখ্যা কম হলেও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অনেক বেশি সুফল আসবে। অনেক বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। যেমন কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের দেড় কোটি কৃষক পরিবার চাহিদা অনুযায়ী ধানের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সবজির উৎপাদনেও স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। যদিও আবাদি জমির মাত্র এক ভাগ জমিতে সবজি চাষ হয়। এসব সবজি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। এ জন্য উৎপাদক কৃষক থেকে রপ্তানি পর্যন্ত পরিবহনসহ আধুনিক সাপ্লাই চেইনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাথমিকভাবে খরচ বেশি হলেও আখেরে কৃষকসহ গোটা দেশই উপকৃত হতো। কিন্তু তা করা হচ্ছে কি? একইভাবে টাঙ্গাইলের আনারস, বগুড়ার কলা, পিরোজপুরের পেয়ারাসহ অনেক ফল থেকেই জুসসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা যায়। গোটা পৃথিবীতেই ফলের রসের রমরমা ব্যবসা। কিন্তু দেশে একদিকে ফল পচে নষ্ট হচ্ছে, কৃষক পণ্যের দাম পাচ্ছে না, অন্যদিকে বিদেশ থেকে জুসসহ খাদ্যদ্রব্য আমদানিতে কোটি কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। অথচ জনগণ তথা দেশের প্রকৃত উন্নয়নের কথা চিন্তা করে বাজেট নেওয়া হলে সাপ্লাই চেইনের সমস্যাগুলো সমাধানসহ বিনিয়োগের বাধাগুলো দূর করতে প্রকল্প হাতে নেওয়া সম্ভব হতো।
সরকারের বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয় এডিপি। কিন্তু এডিপির শত শত প্রকল্প নেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। সত্যিকার অর্থে জনগণের মঙ্গল হবে এমন প্রকল্প নির্বাচনে আগ্রহ কম থাকে মন্ত্রীদের। কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগ আসার অনেকগুলো শর্তের অন্যতম হলো সরকারি ব্যয়। সরকারি ব্যয় বাড়লে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়বে। আর দেশীয় বিনিয়োগ বাড়লে আসবে বিদেশি বিনিয়োগ। কিন্তু সেই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনার চিহ্ন থাকে না ফি বছরের বাজেটে। বাজেট এক বছরের কিন্তু আমার যা নেই, তা অর্জনে ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা থাকবে, বরাদ্দ থাকবে এবং সেইমতো প্রকল্পের ডিজাইন ঢেলে সাজাতে হবে। কিন্তু সেসবের বালাই নেই আমাদের বাজেটে। টুনি প্যাক শ্যাম্পুর মতোই এক বছরে টাকা যেনতেনভাবে খরচ করতে পারলেই হলো। এভাবে চললে বিদেশিসহ বড় বড় বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সহজ হবে না। ফলে বাজেটকে শুধু ফি বছরের বিশাল ব্যয় ও আয়ের হিসাব দেখার দিন ফুরিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার নীতি কাঠামোর দলিল হিসেবে দেখতে হবে বাজেটকে।
লেখক : সাংবাদিক