‘বাড়ে আব বাড়ে নাহি রাহে’
ক্যাবল টিভির কল্যাণে যাঁরা স্টার স্পোর্টস, দেখেন তাঁরা হয়তো সবাই অ্যাডটা দেখেছেন। ‘বাচ্চে আব বাচ্চে নাহি রাহে’। স্টার স্পোর্টস কর্তৃপক্ষ হয়তো চেয়েছিল এমন একটা অ্যাড বানাতে যেটা দেখে আসন্ন ভারত-বাংলাদেশ সিরিজ দেখতে দর্শকরা আগ্রহী হয়। বিশেষ করে ভারতীয় দর্শকরা। তাঁদের হয়তো ধারণা ছিল, ভারতের মতো ক্রিকেট পরাশক্তির বিপক্ষে বাংলাদেশের মতো দুর্বল একটি দেশের ম্যাচ, কেউই দেখতে আগ্রহী হবে না। তাই অ্যাডের মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা—খেলাটা সেয়ানে সেয়ানে না হলেও দেখা যেতে পারে। সময়টা একেবারে নষ্ট হবে না।
অ্যাডটা বানাতে গিয়ে হয়তো (?) অনিচ্ছায় কিংবা সবার যা ধারণা, ইচ্ছাকৃতভাবেই বাংলাদেশ দলের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখানো হয়। অন্তত বাংলাদেশি দর্শকদের তাই ধারণা। আর স্টার স্পোর্টসের বেশির ভাগ দর্শক যেহেতু ভারতীয়, তাই হয়তো ভারতীয় দর্শককে উদ্দেশ করেই অ্যাডটা বানানো হয়েছিল। কিছুদিন আগে বানিয়েছিল ‘মওকা’ অ্যাড। যদিও অ্যাডগুলো তৈরি হয় দর্শক টানার জন্য, তবে সেখানে এই তাচ্ছিল্য জরুরি কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে ‘মওকা’ থেকে শুরু করে, হালের ‘বাচ্চে’ অ্যাড, একটা ব্যাপার উসকে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, ‘মুই কি হনু রে’। এমনটা করলে সম্ভবত ভারতীয় দর্শক ভালো খায়। তবে সেটা করার সময় তাঁরা একবারও বোধহয় ভাবেনি, খেলার ফলাফল উল্টো হলে কী হবে। অ্যাডগুলো দিয়ে তাঁরা এক ঢিলে যে দুই পাখি মারছিল, ভারতীয় জাতীয়তা বোধে কিছুটা উসকানি দিচ্ছিল, ‘ভারত দারুণ এক টিম’ আর সঙ্গে ‘বাংলাদেশ ইদানীং ভালো খেলছে’ টাইপ সান্ত্বনা, সেই ফর্মুলা যে পুরোটাই বুমেরাং হয়ে যাবে যদি বাংলাদেশ জেতে—তা তারা মনে হয় স্বপ্নেও ভাবেনি।
বিপক্ষ দলকে বিভিন্ন কটাক্ষ করে রাগিয়ে দেওয়া, কাজটা ক্রিকেটে একেবারে যে নতুন, তা বলব না। ক্রিকেটের মাঠে তো ব্যাপারটা হরহামেশাই হয়। ‘স্লেজিং’ এখন প্রায় ক্রিকেটের অংশই হয়ে গেছে। ক্রিকেটাররাও এখন আর আগের মতো, স্লেজিংয়ে বিভ্রান্ত হন না। স্টিভ ওয়ার মতো ক্রিকেটাররা তো স্লেজিংয়ের পরেই উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। তবে কাজটা এতদিন করত খেলোয়াড়রা। মাঠে কিংবা মাঠের বাইরে ‘প্রেস কনফারেন্সে’। হতো মেন্টাল গেম। অস্ট্রেলিয়া হয়তো বলত, ‘ভারত উপমহাদেশের বাইরে ভালো খেলে না’ আর ভারতের অধিনায়ক হয়তো মনে করিয়ে দিত ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্পিনে কাঁচা, অতএব আমাদের সম্ভাবনা বেশি’। ইদানীং এই স্লেজিং ব্যাপারটা চলে গেছে মিডিয়ার দখলে।
মিডিয়ায় শুরু হওয়া এই স্লেজিংয়ের সমস্যা হচ্ছে, এর ক্ষেত্রে তেমন কোনো নীতিমালা নেই। যে যা খুশি বানাতে পারে। ইউটিউব আর ফেসবুকের কল্যাণে, ব্যাপারটা আর টেলিভিশনের ওপরও নির্ভর করছে না। দেদার চলছে শেয়ার। সুরুচিপূর্ণ, কুরুচিপূর্ণ, যৌনতার মিশেল দেওয়া অ্যাড-কী নেই সেখানে। ‘বাম্বু’ দেওয়া টাইপ অ্যাড নিয়ে যেমন বেশ সমালোচনাও হলো, তেমনি আবার একদল এসব অ্যাডকেই যোগ্য প্রত্যুত্তর ভাবলেন। ‘ওরা আমাদের পচাতে পারে আমরা পারব না কেন’? টাইপ মানসিকতার বেশ প্রসার ঘটল। ব্যাপারটা আর খেলা না হয়ে ‘বিদ্বেষ’ বা ‘ঘৃণা’র জায়গা হতে শুরু করল। অবস্থা যা হয়েছে, মনে হয় না ব্যাপারটা অচিরেই থামবে। আর ব্যাপারটায় বাধা দিতে গেলে, যেমনটা হয়, নিষিদ্ধ যেকোনো কিছুর প্রতিই যেমন আগ্রহ বাড়ে, তেমনভাবে কাজগুলোর জনপ্রিয়তা তখন হয়তো মাত্রা ছাড়াবে।
একটা উপায় হতে পারে যদি আমাদের অ্যাডমেকাররা অশ্লীলতা বাদ দিয়ে, নান্দনিক কোনো অ্যাড উপহার দেন আর সেটা সবাই পছন্দ করে। তখন হয়তো অশ্লীল অ্যাড প্রস্তুতকারীরা দ্বিতীয়বার ভেবে দেখবেন, ‘বাম্বু’-জাতীয় অ্যাড বানিয়ে ভারতের ‘মওকা’ লাইনেই উসকানি দেওয়ার পথে যাব, না নান্দনিক কিছু বানিয়ে দেশবাসীকে উৎসাহ দেওয়া টাইপ কিছু উপহার দেব। যৌনতার মিশেল না দিয়েও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়। প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার জন্য তাঁদের দেখানো ফর্মুলার কপি করা তো জরুরি না। সব সময় তো গায়ের জোরে জেতা যায় না। ক্রিকেটে তো না-ই। ক্রিকেট তো দক্ষতার চেয়ে অনেক বেশি মনস্তাত্ত্বিক খেলা। মুস্তাফিজ তো গায়ের জোরে বল করেননি। বল করেছেন বুদ্ধি খাটিয়ে। দুই মাচে ১১ উইকেটের মধ্যে সাতটিই পেয়েছেন ‘স্লোয়ার’ বলে।
ক্রিয়েটিভ ফিল্ডে যাঁরা আছেন, তাঁরা ব্যাপারটা হয়তো ভেবে দেখবেন। সিরিজ জয়ের পরে যখন ‘বাচ্চে আব বাচ্চে নাহি রাহে’ অ্যাডটা আবার দেখাচ্ছিল, তখন পাশে বসা ১০ বছরের ছেলেটি বলে উঠল, ‘বাড়ে আব বাড়ে নাহি রাহে, বাড়ে আব বাচ্চে হো গ্যায়ে’। কেবল টিভির দৌরাত্ম্যে ছানাপানারা হিন্দি খারাপ বলে না, অনেক অ্যাডের ট্যাগলাইনও ওদের মুখস্থ। তবে মনে হলেঅ, এই পিচ্চিগুলো, যারা এখনো যৌনতার মিশেল দেওয়া কথাবার্তা বলতে শেখেনি তাদের কাছ থেকে আমাদের অ্যাড মেকাররা অনেক আইডিয়া নিতে পারেন। খেলার ছলে, গুরুত্ব না বুঝেও এরা আমাদের অ্যাড মেকারদের চেয়ে ভালো ভালো উত্তর তৈরি করছে।
আজকে ছেলেটি স্কুল থেকে ফিরে এসে আরেকটি মজার গল্প শোনাল।
-আব্বু জানো, মাশরাফি মুস্তাফিজুর রহমানকে কী জিজ্ঞেস করেছিল?
জানতে চাইলাম, ‘কী?’
বলল, মাশরাফি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কি রে মুস্তাফিজ, কী খেয়ে এসেছিস?’
মুস্তাফিজ বলল, ‘ধোনির ধাক্কা খেয়ে এসেছি। ধোনির ধাক্কায় ভিটামিন আছে।’
মনে হলো, এই পিচ্চিগুলোর দেশপ্রেমে যে সরলতা আছে, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়। যৌনতা, অশ্লীলতা ছাড়াও প্রতিপক্ষকে টিপ্পনি কাটা যায়, ‘স্লেজিং’ করা যায়। শুরু হোক না নতুন একটি প্রচেষ্টা। নান্দনিক কিছু স্লেজিং, যেখানে বুদ্ধিমত্তা থাকবে, হিউমার, টিপ্পনিও থাকবে, কিন্তু পারস্পরিক সম্মানও থাকবে। আরেকজনকে তাচ্ছিল্য করার মাঝে তো কোনো গৌরব নেই। পরিশেষে এটা তো একটা খেলা। কে কত পচা, নোংরা গালি দিয়েছে, সে তো আর জিতবে না। জয় হবে তার, যে ভালো খেলবে। প্লিজ, খেলাকে খেলা থাকতে দিন।
যায়নুদ্দিন সানী : লেখক ও সহকারী অধ্যাপক, রংপুর মেডিকেল কলেজ।