বর্মীয় গুণ্ডামি, সুধীর ও অদম্য বাংলাদেশ
বাংলাদেশে ধ্বনিত হচ্ছে তিন নাম—মুস্তাফিজ, সুধীর ও রাজ্জাক। শেষের জন বিজিবির সদস্য নায়েক আব্দুর রাজ্জাক। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিজিপির হাতে বন্দী। বর্মীয় সন্ত্রাসের শিকার তিনি। গোটা বাংলাদেশ এখনো তাঁকে উদ্ধার করতে পারেনি। তাঁর পুত্র সন্তান জন্মেছে। পিতা-পুত্রের মিলন হয়নি এখনো। তাঁর পুত্র, বার্মা নামক দেশটিকে আমৃত্যু ঘৃণা করবে। বার্মার নাম উচ্চারণে, রোহিঙ্গাদের মতো আঁতকে উঠবে! জন্মভূমির প্রতিও হয়তো থাকবে অভিমান। এই ঘটনার প্রতিবাদে, বাংলাদেশের ১০জন তরুণও ঢাকায় একটা মানববন্ধন করেনি। অথচ এ দেশে দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হয়তো গুনে শেষ করা যাবে না। আমাদের জাতীয়তাবোধ এতই উজ্জ্বল, এমনই তীক্ষ্ণ!
দক্ষিণ এশিয়ার খেলার স্টেডিয়ামগুলো চিড়িয়াখানার পশুর খাঁচার মতো করে তৈরি। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় এমন না। স্টেডিয়াম থেকেই বুঝা যায় আমরা দর্শক হিসেবে কতটুকু শালীন। ২৫ হাজার মানুষের ভিড়ে একজন সুধীরকে কেউ না কেউ উসকানি দিয়েছে, কটূক্তি করেছে, হয়তো ধাওয়াও করেছে। এটা কাম্য নয় কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে এমনটি হয়েছে। তবে পুচ্ছ নাচিয়ে, তুচ্ছকে জগৎব্যাপী ছড়িয়ে দিতে কেউ কেউ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সুধীর কীর্তি এমন দাঁড়িয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে দাঁড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে হবে। তাতেও যেন কারো কারো মন উঠবে না! টাইমস অব ইন্ডিয়া থেকে দৈনিক সাতক্ষীরা—উপমহাদেশের এমন কোনো কাগজ নেই, এ নিয়ে দুই কলম লিখেনি। উপরন্তু ঘৃতে আগুন ঢেলে দিল বাংলার ‘জাতীয় ইজ্জত রক্ষাবাহিনী’। তাদের এক কথা—এ আমাদের জাতীয় লজ্জা!
এই যে মুখের জোরে শব্দ দুটি বের করে দিলেন, তাতেই কী সব খালাস? বলি, জাতির জন্য নিজে গৌরব বয়ে এনে তারপর জাতীয় লজ্জাটা ঢাকুন। আর জাতীয় শব্দটাই যখন টেনে-হিঁচড়ে বের করে এনেছেন তখন বলতে হয়, জাতীয় লজ্জাগুলো আর কী-সে হয় সেটাতে কী চোখ রাখেন!
২৫ হাজার বুদ্ধিজীবী খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে যায়নি। ওখানে গেছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। ওদের সবাই জাতীয় লজ্জা বুঝে না। এমনকি আমরা যে ধরাকে সরা করে ফেলছি, হয়তো ওরা এটাও জানে না। ওরাই বাংলাদেশ না। ওরাই জাতীয় সবকিছুর প্রতিনিধি না। বরং ওদের কাছ থেকে এমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা এড়ানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রশাসনের। যারা রাজ্জাককে মুক্ত করে আনতে পারে না, তারা সুধীরকেও নিরাপত্তা দিতে পারে না।
এ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন মুস্তাফিজ, সৌম্য সরকার, মাশরাফি বিন মুর্তজা। কোটি কোটি মানুষকে প্রত্যক্ষদর্শী করে যখন মুস্তাফিজকে গুঁতো দেওয়া হয়, তখনো সে এ জন্যই নিজের ভুল স্বীকার করে মৌন থাকে। বিশ্ব-ক্রিকেটে আমাদের যারা বছরের পর বছর কোণঠাসা করে রাখতে চেয়েছে, তাদের হারিয়েও মাশরাফি বলেন, ‘আমরা এখনো শিখছি’। এই অসীম তেজি অথচ বিনয়ী কতগুলো ধূমকেতুই বাংলাদেশ। ওরাই ছড়িয়ে দিচ্ছে এক শিহরণ। সে শিহরণ হ্যামিলিয়নের বাঁশির সুরেও নেই। সে শিহরণে শিহরিত হয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-তরুণী গালে, বুকে, পিঠে বাংলাদেশের পতাকা এঁকে বেরিয়ে পড়ছে জগৎ জয়ের নেশায়। তাদের ঠেকায়, এমন সাধ্য কার বলো?
এই দেশের মানুষ যখন বাংলাদেশ-বাংলাদেশ বলে চিৎকার করে গগন ভেদ করে, তখন কারো কারো গা জ্বালা করে। বাংলাদেশ এখানে প্রকট হয়ে না উঠুক—এমন প্রচেষ্টা বহুভাবেই সক্রিয়। কিন্তু ওরা জানে না, জাগরণের কালে কাউকে আর দমিয়ে রাখা যায় না। এ আগুন বারুদের আগুন, এ আগুন অশুভকে পোড়ানোর আগুন। এ আগুনের নাম বাংলাদেশ।
রাজ্জাক, আপনি সুস্থ হয়ে সন্তানের কাছে ফিরে আসুন। আমরা লজ্জিত, আমাদের ক্ষমা করুন। সুধীর, যে দেশের আঁচল সবুজ, সে দেশে অতিথিকে না খাইয়ে গৃহস্থ খায় না। তুমি এসো এখানে বারবার। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ তোমাকে নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। মুস্তাফিজ, তোর এই ছত্রিশ ইঞ্চি বুকে যে বাংলাদেশ, সেটার তেজ অসীম। তুই শুধু সেই তেজটাই ছড়িয়ে দে। যত পারিস।
রউফুল আলম : গবেষক, স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন।