দাঙ্গার ইতিহাস
আসানসোল থেকে ভারত শিক্ষা নেবে কি?
 
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে রামনবমীর উৎসবে যে কাণ্ডটি ঘটে গেল, এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যে ধরনের সংঘাত ভারতে আবার ছড়িয়ে পড়ার আশংকা ছিল তা থেকে মুক্তি দিয়েছেন ইমাম মাওলানা ইমদাদুল হক রাশিদি। ইমাম বলেছেন যে তিনি তার ছেলের হত্যার জন্য কোন ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে মেনে নিবেন না এবং যদি এর জন্য কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতার সূচনা হয় তবে তিনি আসানসোল ত্যাগ করবেন। এটি একজন সদ্য সন্তানহারা সংখ্যালঘুর কাছ থেকে কেউ আশা করে নি। কারণ, এমন একটি উদার চিন্তা কোনো সম্প্রদায়ের উঁচু আসনে বসা নেতার কাছ থেকেও ভারত কখনো দেখেনি; আর ইনি তো একজন ইমাম, যাদেরকে মুসলিম-বিদ্বেষীরা আখ্যা দেন সবচেয়ে ‘গোঁড়া মুসলিম’ হিসেবে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিঃসন্দেহে, একই সাথে যতোগুলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার কার্যকলাপ ভারতীয় উপমহাদেশে ঘটেছে তার মধ্যে অন্যতম, বলা উচিৎ।
১৬ বছর বয়সী সিবতুল্লা রাশিদিকে হিন্দুত্ববাদীরা ধরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে এবং তার লাশ ফেলে রেখে যায়। এটি নিঃসন্দেহে একটি নৃশংস ও জঘণ্যতম হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ড ভারতে সাম্প্রদায়িকতার তীব্রতার বিষয়টি আবার সারা বিশ্বকে জানান দিল; ‘গো-হত্যা’র নামে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যেমন জানান দিয়েছিল, বা তারও পূর্বে জানান দিয়েছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার মাধ্যমে, কিংবা গুজরাট দাঙ্গার মাধ্যমে। আর দেশভাগের সময়ের কথা না বললেই চলে।
ভারতে এ-রকম পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস বহু পূর্ব থেকেই আমরা দেখি, যদি দৃষ্টিপাত করি ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার ইতিহাসে; তার পরে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে খেয়াল করলে। সাম্প্রতিক সময়েও যদি নজর দিই, তবে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসটা ছোট হবে না। আর ক’দিন আগে, আসানসোলে যে হত্যাকাণ্ডটি ঘটে গেল তা তো গণতন্ত্র ও নয়া-উদারতাবাদের যুগে একটি বিস্মৃতপ্রায় কর্মপন্থারই পুনরুত্থান, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, কেউ কেউ মনে করতে পারে সেকুল্যার হিসেবে পরিচিত ভারতে কিভাবে এমন একটি হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে? তবে এটা যে ঘটতে পারে, অহরহ ঘটছে, এবং ঘটবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভারত তথাকথিত সেকুল্যার রাষ্ট্রের দাবী করে; যা তাদের সংবিধানেও স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু বাস্তবের ইতিহাস ভিন্ন। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, কোনো সময়ই ভারত সেকুল্যার রাষ্ট্র ছিলো না, যদিও তার নিদর্শন মেলে লেখাপড়ার মাধ্যমে; তা তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবিক বাস্তবতা ভিন্ন। আর বিষয়টা যদি থাকতো, তবে কিভাবে বিজেপির মতো কট্টরপন্থী একটি দল ক্ষমতায় আসতে পারে। জেনে রাখা উচিৎ যে ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ কোনো একটি দল নয়, কতোগুলো দলের সমন্বয়েই এই দল। এবং এই দলেরই স্বার্থভিত্তিক অনুপ্রেরণাই নতুনভাবে ‘সাম্প্রদায়িকতা’র বিষয়টি সমগ্র ভারতে আবারো ছড়িয়ে পড়ছে, দাবানলের মতো।
বিশেষ করে দলের মূল উইংয়ের চেয়ে বেশি সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে ‘যুব-উইংগুলো’, সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীভিত্তিক সংগঠন ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে’র মতো কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলও বিজেপির সাথে একীভূত এবং এই দল যে আদর্শ নিয়ে চলে তার সাথে একটি বিশেষ নৈকট্য রয়েছে বিজেপির। যেমন গো-হত্যার বিষয়কে কেন্দ্র করে যে ধরনের প্রচার-প্রচারণা বিজেপির যুব উইংগুলো চালাচ্ছে তা আসলেই নিজেদের স্বার্থের সাথে জড়িত, এবং তা অবশ্যই বানোয়াট এবং পরিকিল্পিত হিসেবে বিবেচনা করা উচিৎ। জানা জরুরী যে, ভারত থেকে যে পরিমাণ গো-মাংস রপ্তানী হয়, এবং সেই মাংস রপ্তানী ব্যবসার সাথে যারা জড়িত রয়েছে তাদের একটি বৃহৎ অংশ বিজেপির রাজনীতি করে, তাদের অনেকের অবস্থান রয়েছে বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে। তাহলে একটি সেকুল্যার রাষ্ট্রে গরু জবাই করে মাংস রপ্তানী করা যাবে, কিন্তু মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গুরু জবাই করতে পারবে না! এ কেমন বিচার, কেমন সেকুল্যার রাষ্ট্রের নিদর্শন ভারত! বিস্মিত হবেন নিশ্চয়।
‘সাইকোলজি অব টোটালিটি’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। যেটি একটি জাতির বা দেশের মানুষ এবং তাদের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য জরুরী, জরুরী ক্ষমতা-কাঠামো বোঝার জন্যেও। ভারতে বিজেপির রাজকীয় উত্থান হয়েছে জনগণের হাত ধরেই, বিজেপি তো নিজে নিজেই ক্ষমতা দখল করে নি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি সম্ভবও নয়। তাই বলতেই হয় বিজেপি যে কট্টর মতবাদ প্রচার করে এবং নিজ দলের স্বার্থে এখন বিষয়টিতে আরো জোর দিয়েছে, তার প্রতি অবশ্যই ভারতের সাধারণ জনগণের সমর্থন রয়েছে। অবশ্যই রয়েছে। অনেকে সাম্প্রদায়িকতার বীজবোপনকারী হিসেবে জিন্নাহর নাম নিয়ে থাকেন, ঘেটে দেখেন না নবজাগরিত বাংলার ইতিহাস থেকে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস পর্যন্ত। দীর্ঘদিন ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরে থাকা মুসলিম কিংবা হিন্দু জনগণের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান। তাই বলতেই হয়, ভারতে সে সময় শুধু জিন্নাহ বা কয়েকজন মোল্লা-মৌলবি বা ক’জন ব্রাহ্মণ মিলে যে দেশভাগ করেছিলেন—এটি একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। ভারতভাগ এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সাথে দু’টি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জনগণের মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতি কাজ করেছে গভীরভাবে। আর এখন পর্যন্ত এটিই প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে স্বাধীন ও সেকুল্যার ভারতের সাম্প্রদায়িক সংঘাতে।
বিজেপি বাবরি মসজিদ ধ্বংস বা গুজরাট দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিয়ে কি ভুল করেছিল? কোনো ক্ষতি কি হয়েছিল বিজেপির, রাজনৈতিক দিক থেকে? না কি লাভবান হয়েছিল বিজেপি? ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে এ দুটি বৃহৎ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নেতৃত্ব দিয়েই ক্ষমতায় আসে বিজেপি। ফলে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি বা সাম্প্রদায়িকতা কখনই বিজেপির জন্য খারাপ ফল বয়ে আনে নি, আর আনবেও না; সবসময়ই ভালো ফল বয়ে আনবে। ১৯৯২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং গুজরাট দাঙ্গার মূল হোতা হিসেবে ‘কর সেবক সংঘ’ এবং ‘আরএসএস’ জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা কি গ্রহণ করা হয়েছে? যদিও হয় তা তো প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়, বলার অপেক্ষা রাখে না।
এতো কথার সূত্রপাতের কারণ ভারতের সাম্প্রদায়িকতার কয়েক দশকের ইতিহাস বোঝার জন্য; প্রয়োয়জনীয় বর্তমান অবস্থা বিশ্লেণণের জন্য। ইমাম ইদগাহ প্রাঙ্গণের জনসভায় যে বক্তৃতা করেছেন তা আসলেই প্রশংসার দাবীদার। কারণ, এমন একটি সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পর স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তীতে তা বৃহৎ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে, ইতিহাস তেমনটাই সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু ইমাম প্রাথমিক পর্যায়েই সেই দাঙ্গার আগুন নিভিয়ে দিলেন, জ্বলে উঠতে দিলেন না। যে ধরনের সাম্প্রদায়িকতার সূচনা হয়েছিল এবং যা পরবর্তীতে ভীষণ আকার ধারণ করতে পারত আসানসোলে, সেটা অবশ্যই রুখে দিয়েছেন ইমাম, নিজের অহিংস এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। ইসলামের সাথে শান্তির সম্পর্ক—তা সকলেই বলেন; কিন্তু ক্রুসেডের ইতিহাস কী সাক্ষ্য দেয়? এ কথা বলছি এই কারণে যে ইমামকে আবার মুসলিমরা নিয়ে যাচ্ছেন ‘ইসলামিস্ট’ ধারণার মধ্যে। প্রচার করতে চাচ্ছেন ইসলাম কতো ‘লিবারেল’ ধর্ম। যা একটি সাম্প্রদায়িক ভাবনার মধ্যেই চলে যাচ্ছে; কিন্তু যাওয়া উচিৎ নয়। এ আলোচনা অসাম্প্রদায়িকতাকে প্রচার করার জন্য, ইসলামের মহত্ত্বকে প্রচার করার জন্য নয়।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে গৌতম বুদ্ধই সর্বপ্রথম অহিংস নীতি বা অহিংসবাদের প্রচার করেন। মহাত্মা গান্ধী স্বয়ং এই নীতিকে সমর্থন করেছিলেন, ব্যবহার করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও তা পরবর্তীতে আর ভারতে দেখা যায় নি, যদি যেত তা হলে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মতো ঘটনা কি আবার ঘটতো? আবার কি দেশভাগ পূর্ববর্তী সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পুনরাবৃত্তি ঘটত গুজরাটে? গান্ধী বলেছিলেন যে, “যতদিন পর্যন্ত অহিংসাকে একটি জীবন্ত শক্তি হিসেবে স্বীকার করা না যাবে, ততদিন গণতন্ত্র বহু দূরের স্বপ্নই রয়ে যাবে।” ভারতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এটি বুঝতে আর কষ্ট হয় না। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে কোনো সরকার ভারতে অহিংসার চর্চা করেছে, এমনটা বলা যাবে না। আর বর্তমানে মোদি-সরকার তো অহিংসার সম্পূর্ণ উল্টো দিকে অবস্থান করে ভারত শাসন করছে। এই কঠিন সময়ে ইমামের অহিংস দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই প্রশংসনীয়। এমনকি ইমাম যে উদার দৃষ্টিভঙ্গির নিদর্শন তুলে ধরেছেন তার কর্মের মধ্য দিয়ে তা কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করা উচিৎ ভারতের, অহিংস ও উদার ভারত গঠনে।
ভারত কি এবার তাহলে তার বিগত সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ভুলে নতুন করে অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা গ্রহণ করবে ইমামের কাছ থেকে? এই প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। এ ব্যাপারে আসানসোলের ২৫ নং ওয়ার্ড কমিশনার নাসিম আনসারি বলেছেন, “এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্যই দৃষ্টান্ত নয়, একইসাথে এটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা উচিৎ সমগ্র ভারতে।” কারণ, ইমাম সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে যে ধরনের মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়েছেন তা অবশ্যই একটি রোল মডেল ভারতের জন্য। ইমামের এমন অসাম্প্রদায়িক, অহিংস, উদার মনোবৃত্তি অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার। এবং ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতার সমাধানে, সাম্প্রদায়িক ভারতকে অসাম্প্রদায়িক ও উদার ভারত হিসেবে গড়ে তুলতে জরুরী। ইমাম মাওলানা ইমদাদুল হক রাশিদির অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আচ্ছন্ন হোক সমগ্র ভারত, এমনটাই চাচ্ছেন সবাই।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 
                   সোহানুজ্জামান
                    সোহানুজ্জামান
         
 
 
 
