ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড
প্রয়োজন আত্মজিজ্ঞাসা আর প্রতিরোধ
বারবারই কেবল মনে হচ্ছে একটি কথা যে একুশে বইমেলায় জাগৃতি প্রকাশনের স্টলে আর কোনোদিন ফয়সল আরেফিন দীপনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব না। আর কোনোদিন দেখব না তাঁর সেই উজ্জ্বল হাসিমাখা মুখ, শুনব না তাঁর স্মিত, কিন্তু উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর। বিশ-একুশ বছর ধরে প্রতিবার বইমেলায় দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। জাগৃতি থেকে প্রকাশিত নতুন বই নিয়ে হয়েছে কত আলোচনা। কিন্তু বইমেলায় তাঁকে আর দেখব না কোনোদিন। আর যেভাবে অত্যন্ত পরিশীলিত রুচির, শান্ত, মিষ্টভাষী এই প্রকাশককে চলে যেতে হলো পৃথিবী ছেড়ে, সেই ভয়াবহ অন্যায়ের কথা চিন্তা করলে মন একদিকে যেমন তীব্র ব্যথায় বেদনার্ত হয়ে ওঠে, তেমনি আবার প্রচণ্ড ক্ষোভে, প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করে। ফয়সল আরেফিন দীপনকে পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে, আর এই অতি নির্মম ঘটনা ঘটার পর এই দেশের প্রতিটি অনুভূতিসম্পন্ন মানুষই শোকগ্রস্ত, ক্ষুব্ধ।
একই দিন ঘাতকরা আক্রমণ করেছিল শুদ্ধস্বর প্রকাশনা সংস্থার কার্যালয়েও। ঘাতকদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হয়েও সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেছেন শুদ্ধস্বরের মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুল আর অন্য দুজন লেখক রণদীপম বসু আর তারেক রহিম। গত ফেব্রুয়ারি মাসে টিএসসিতে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ঘাতকরা হত্যা করেছিল লেখক অভিজিৎ রায়কে। অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ করার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছিল শুদ্ধস্বরের মালিক টুটুলকে। অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশিত হয়েছিল জাগৃতি প্রকাশনী থেকেও। অভিজিৎকে যেমন চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, আট মাস পর অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশকের ওপরও একই দিনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা এবং তাদের আঘাত করার পর তাদের কার্যালয়ের দরজায় তালা দিয়ে ঘাতকদের চলে যাওয়া প্রভৃতি বিভিন্ন দিকের মিল ইঙ্গিত করে যে অভিজিতের বই প্রকাশ করার জন্যই ঘাতকদের আক্রোশের সম্মুখীন হতে হয়েছে টুটুল আর দীপনকে। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর গত আট মাসে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে আরো তিনজন লেখক ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস আর নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়কে।
আর এবার আক্রান্ত হলেন প্রকাশকরা। বইমেলা চলার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বহু মানুষ আর পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতির মাঝেও ঘাতকরা অভিজিৎ রায় আর তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। সেই খুনিদের হদিস এখনো বের করতে পারেনি আমাদের দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। আর তিনদিন আগে দুপুরবেলা লালমাটিয়ার মতো জনবহুল এলাকায় শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে আক্রমণকারীরা তিনজন লেখককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুলি করে চলে গেল। আক্রান্তদের চিৎকার শুনেও সেই জনবহুল এলাকায় কেউ তাঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। প্রগতিশীল মানুষরা নিয়মিত সময় কাটান যে আজিজ সুপার মার্কেটে, সেখানে দুপুরবেলা জাগৃতি কার্যালয়ে ঢুকে খুনিরা দীপনকে হত্যা করতে ভয় পায়নি। এই খুনিরা হয়তো জানে যে আমাদের দেশের বহু মানুষ এখন আর অন্যায় দেখলে প্রতিরোধে এগিয়ে আসার মতো সাহসী নয়। এই খুনিরা হয়তো পৈশাচিক কাজ করতে সাহসী হয় এই কথা ভেবে যে কাউকে কুপিয়ে হত্যা করলেও পুলিশ তাদের সহজে চিহ্নিত করতে পারবে না, যেভাবে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের এখনো শনাক্ত করা যায়নি। এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর যদি অপরাধীদের গ্রেফতার করে দ্রুত যথাযথ বিচারের মাধ্যমে তাদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হতো তাহলে একের পর এক লেখক-প্রকাশকদের কুপিয়ে হত্যা করার সাহস ঘাতকদের হতো না।
এই বছর কয়েক মাস পর পরই কোনো লেখককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রায়ই হত্যার হুমকি দিয়েছে। ৩১ অক্টোবর দুপুরে একই সঙ্গে দুই প্রকাশকের কার্যালয়ে নির্মম হামলার ফলে বোঝা গেল এই হুমকি হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। লেখক-প্রকাশক-বুদ্ধিজীবীদের উদ্বিগ্ন হওয়া তাই অমূলক নয়। এই হামলার একদিন পরই হত্যার হুমকি পেয়েছেন সময় প্রকাশনের কর্ণধার ফরিদ আহমেদ। হুমকি পেয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের সংগঠক বাপ্পাদিত্য বসু। টিএসসি এলাকা আর আজিজ সুপার মার্কেটের মতো জায়গাতেও যখন ঘাতকরা চাপাতি হাতে একজন লেখক আর প্রকাশককে কুপিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারে, তখন মানুষের মনে শঙ্কা আসবেই। কোন স্থান তাহলে নিরাপদ এখন? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন ভয়ংকর হামলা থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে বা ধর্মান্ধ জঙ্গিদের অপরাধ ঘটানোর আগেই খুঁজে বের করতে কতটা সক্ষম এই সময়ে? যখন ঘাতকদের একের পর এক হামলায় প্রাণ হারাচ্ছেন লেখক-প্রকাশকরা, তখনো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল মনে করছেন এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তিনি মনে করেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনো অবনতি হয়নি। যখন ঘাতকরা কয়েক মাস পরপরই কোনো লেখক-প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যা করছে, দিনদিন নৃশংসতর হচ্ছে তাদের আক্রমণের ধরন, দিনের বেলা বহু মানুষের আনাগোনায় ব্যস্ত কোনো স্থানে যেয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটাতেও তারা ভয় পাচ্ছে না, হামলার পর তারা নির্বিঘ্নে পালিয়েও যাচ্ছে এবং কারা এমন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সে সম্পর্কে পুলিশের কাছে কোন তথ্য না থাকার পরিস্থিতিতেও যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক আছে তখন তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে না। বরং এই কথাই বলতে হয় যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্য দেশের সাধারণ মানুষদের উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে তুলবে। আর যারা সভ্য, যৌক্তিক চিন্তার তোয়াক্কা না করে কোনো লেখক বা প্রকাশককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করতে ব্যগ্র, সেই অন্ধকার মনের মানুষদের কি আদৌ কোনোভাবে উদ্বিগ্ন বা ভীত করবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন মন্তব্য? বরং তাদের ক্রমাগত পৈশাচিক হামলার পরও সরকারের নির্বিকারত্ব আর উদ্বিগ্ন না হওয়া দেখে তারা কি নিশ্চিন্ত বোধ করবে না?
ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক নিজের ছেলের এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বলেছেন, তিনি কোনো বিচার চান না। তিনি চান সমাজে মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। কোন সামাজিক পরিস্থিতি দেখে একজন বাবা সন্তান হত্যার বিচার চান না এমন উক্তি করতে পারেন সচেতন মানুষের জন্য তা অনুধাবন করা কঠিন নয়। বিদ্যমান সামাজিক পরিস্থিতি কেমন, আর কোন উদাসীনতা আর শৈথিল্যের কারণে সমাজে বেড়ে চলেছে অজ্ঞানতার অন্ধকার এবং বেপরোয়া হচ্ছে যুক্তিহীন, ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং সদ্য সন্তান হারানো একজন বাবা কতটা আক্ষেপ আর দুঃখ নিয়ে বিচার চান না এমন মন্তব্য করতে পারেন তা বুঝতেও অসুবিধা হয় না। অথচ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ মন্তব্য করলেন, অধ্যাপক ফজলুল হক হত্যাকারীদের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, তাই তিনি তাঁর ছেলে হত্যার বিচার চান না। এই মন্তব্য যে কতটা অনুভূতিহীন, অসাড় আর অগ্রহণযোগ্য, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে বহু মানুষের তীব্র নিন্দা জানানোর মধ্য দিয়েই তা স্পষ্ট হয়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অবশ্য নিজের এই বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের এই নেতা।
অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী বন্যা আহমেদও দুদিন আগে নিজের একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন দীপনের বাবার মতো তিনিও বিচার চান না। ঘাতকদের হামলায় চোখের সামনে বন্যা আহমেদ প্রাণ হারাতে দেখেছেন তার স্বামীকে, ঘাতকদের চাপাতির চারটি কোপ তাঁর মাথায় আঘাত করেছে, চাপাতির আঘাতে কাটা পড়েছে তাঁর হাতের আঙুল। সেই বন্যা আহমেদও বিচার চান না, তাহলে তিনিও অভিজিতের হত্যাকারীদের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী? মহান মুক্তিযুদ্ধে যে রাজনৈতিক দল নেতৃত্ব দিয়েছিল, আর যে দলে ছিলেন এই দেশের ইতিহাসের বরেণ্য, প্রজ্ঞাবান সব রাজনীতিবিদ বর্তমান সময়ে সেই দলের একজন প্রভাবশালী নেতা কোন ধরনের মন্তব্য করতে পারেন তা দেখে গভীর দুঃখ আর হতাশাই কেবল তৈরি হয় আমাদের মনে।
এই সমাজের প্রতিটি সচেতন মানুষকে এখন আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হবে। দৃষ্টি দিতে হবে যেভাবে আমরা এই সময়ে নিজের দায়িত্ব পালন করছি সেই দিকে। বর্তমান সময়ে সমাজে কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে যুক্তিহীনতা আর অজ্ঞানতার যে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে, যার বশবর্তী হয়ে তারা ভীষণ হিংস্রতায় লেখক, বইয়ের প্রকাশকদের কুপিয়ে হত্যা করতে তৎপর সেই অন্ধকার দূর করার জন্য কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে আমরা চেষ্টা করেছি বিভিন্ন সময়ে? ধর্ম যে রাজনৈতিক হাতিয়ার নয়, ধর্ম যে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির বিষয় নয়, ধর্ম মানে উদারতা, বিশুদ্ধতা আর শান্তিময়তা, নির্মমতা, হিংস্রতা আর সংকীর্ণতা নয় এই কথাগুলো দেশের বহু মানুষকে অনুধাবন করানোর জন্য কতটা সচেতনভাবে আমরা সচেষ্ট থেকেছি? বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমবয়সীদের যুক্তি আর অজ্ঞানতার পার্থক্য বোঝানোর জন্য আমরা কি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছি? যে মহৎ আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭১ সালে এই দেশের অগণিত মানুষ এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছিল, নতুন প্রজন্মের মানুষদের মনে মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রকৃত মূল্যবোধ যেন সমুন্নত থাকে সেই চেষ্টা কি কার্যকরভাবে আমরা করতে পারছি? মুক্তিযুদ্ধ কেবল রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য একটি স্লোগান কিংবা গৎবাঁধা বুলিতে পরিণত হলে তা কোনো শুভ ফল নিয়ে আসবে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মহিমা আর মূল্যবোধের সঙ্গে যদি নতুন প্রজন্মের মানুষদের একাত্ম করা যায় তাহলেই উগ্র ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক অসাধুতা আর শোষণ প্রভৃতি অন্ধকার দিকের প্রতি মানুষের প্রতিরোধ বৃদ্ধি পাবে। বৃদ্ধি পাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সাহস।
মনে রাখতে হবে দেশে যদি অজ্ঞানতার অন্ধকার সৃষ্টি হয় তার দায় সচেতন মানুষদেরও বহন করতে হবে। নেতিবাচক পরিস্থিতি হঠাৎ তৈরি হয় না, মানুষের নির্লিপ্ততা আর দায়িত্বহীনতার জন্যই ধীরে ধীরে নেতিবাচক পরিস্থিতি প্রকট হয়ে ওঠে। অন্যায় দেখেও যদি আমরা নিশ্চুপ থাকি, প্রতিরোধ না করি, তাহলে অন্যায় বৃদ্ধি পাবেই। আজ কোনো লেখক বা প্রকাশককে নির্মমভাবে হত্যা করার পর আমরা মানববন্ধন, সমাবেশ, লেখালেখির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু কিছুদিনের এই প্রতিবাদ কর্মসূচি সমাজে তৈরি হতে থাকা গভীর আঁধার দূর করতে পারবে না। যাঁরা সচেতন নাগরিক, যাঁরা যুক্তিহীনতা আর অজ্ঞানতার অন্ধকার দেখতে চান না, তাঁদের এই আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হওয়া প্রয়োজন যে সমাজে যুক্তিনির্ভর, আলোকিত চিন্তা প্রসারের জন্য কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁরা কাজ করছেন। রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক এবং অন্যান্য পেশার মানুষদের ভাবতে হবে সমাজকে তারা যুক্তিহীনতা আর বর্বরতার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে দেবেন কি না। গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে এই সময়ের ছাত্রছাত্রীদের, নতুন প্রজন্মের মানুষদের যে যুক্তিহীন আর অন্ধ চিন্তায় আচ্ছন্ন মানুষদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটি ভবিষ্যৎ তারা চায় কি না। লেখার জন্য এবং বই প্রকাশের জন্য যখন কাউকে কুপিয়ে হত্যা করা সমাজে নিয়মিতভাবে ঘটতে থাকে, তখন শিক্ষা আর শিল্পের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে মানুষের যুক্তিবোধ আর সচেতনতা সৃষ্টি করার দায়িত্ব হয়ে ওঠে অত্যন্ত জরুরি।
অন্ধচিন্তার মানুষদের আক্রোশ আর আক্রমণের শিকার হয় যুক্তিবাদী মানুষ। কারণ অন্ধ চিন্তার মানুষদের মনের জানালা বন্ধ। আলোকিত, মুক্ত, যুক্তিপূর্ণ চিন্তা তারা সহ্য করতে পারে না। যুক্তিপূর্ণ চিন্তার বিপরীতে পাল্টা যুক্তি দিতে এই উগ্র, হিংস্র মানুষরা অক্ষম। সভ্য মানুষের মতো আচরণ করার পরিবর্তে তারা বর্বরের মতো পৈশাচিকভাবে যুক্তিবাদী মানুষদের হত্যা করতে উদ্যত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত, তখন তাদের এ দেশীয় দোসররা বেছে বেছে হত্যা করেছিল দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের যেন বিজয়ের পর বাংলাদেশ চিন্তাশীল, আলোকিত মানুষদের দিকনির্দেশনা না পায়। সেই পৈশাচিক আক্রমণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। এখনো হত্যা করা হচ্ছে প্রগতিশীল লেখক-প্রকাশকদের, হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে যুক্তিবাদী, চিন্তাশীল মানুষদের। যদি আমরা এই অশুভ, পৈশাচিক তৎপরতা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হই, তাহলে অন্ধকার এক ভবিষ্যৎ আমাদের দেখতে হবে যেখানে যুক্তি আর আলোর কোনো উপস্থিতি থাকবে না। কিন্তু আমাদের প্রতিরোধ তৈরি করতে হবে গভীরভাবে; অজ্ঞানতা আর যুক্তিহীনতার বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য আন্তরিকভাবে নিজের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্ঞানচর্চা আর গণমাধ্যমের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেই বিশেষ শিক্ষা আমাদের সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে, যা নতুন প্রজন্মের মানুষদের সামাজিক সচেতনতা এবং মানবিকতা বাড়িয়ে তুলবে। যে শিক্ষার মাধ্যমে স্পষ্ট হবে যুক্তি আর অজ্ঞানতার পার্থক্য।
আর এই নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলোতে যারা যুক্ত, তাদের শনাক্ত এবং দ্রুত শাস্তি প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সমাজকেই আরো বিপদাপন্ন করে তোলা হবে। ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠেকানোর জন্য প্রয়োজন কাউন্টার টেররিজম ইউনিট যা বাংলাদেশে নেই। এমন অপরাধ দমনে পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগও দ্রুত গ্রহণ করতে হবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই। পাশাপাশি পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যথেষ্ট আন্তরিকতা এবং কর্তব্যনিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে কি না তাও গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। টিএসসিতে অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে অপরাধীরা যে পালিয়ে যেতে পারল সেই ব্যর্থতা সেই সময় টিএসসিতে উপস্থিত পুলিশ সদস্যদের এবং অন্য মানুষদের। ঢাকার রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা বা টিভি ক্যামেরা দেখলে অজস্র লোক ভিড় করে আসে দেখার জন্য, কিন্তু দুঃখজনক যে এমন শহরেই খুনিরা চাপাতি দিয়ে কোন লেখক-প্রকাশককে কুপিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাচ্ছে। ওয়াশিকুর রহমানকে আঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার সময় খুনিদের হিজড়া সম্প্রদায়ের দুজন মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে ধরে ফেলেছিল। শুদ্ধস্বর কার্যালয়ে হামলার সময় আক্রান্তদের চিৎকার শুনে লালমাটিয়ায় মানুষজন এগিয়ে আসতে পারলে সেদিন সেই হামলাকারীদেরও ধরে ফেলা যেত। নৃশংস অন্যায় যখন ঘটছে, তখন ভয়ে আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকলে বিপদ কেবল বাড়বেই। আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে, সম্মিলিতভাবে, নিজেদের সমাজ আর ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখার প্রয়োজনেই।
শরীরে গুরুতর আঘাত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল বলেছেন ‘আমি পিছু হটব না।’ টুটুলের এই সাহসী উচ্চারণ যেন অন্যায় আর অজ্ঞানতার অন্ধকার প্রতিরোধে এই দেশের প্রতিটি সচেতন, শান্তিপ্রিয় আর যুক্তিবাদী মানুষের সংকল্প এবং সাহস আরো শাণিত করে, তাই প্রত্যাশা করি।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।