শিক্ষা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তপনা
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার এইম এম সেন রোডে অবস্থিত বন্দর শিশুবাগ বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র তাসীনুর রহমান সাফির স্কুল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বেতন না নেওয়া এবং বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনিশ্চিয়তা নিয়ে গত ২ ডিসেম্বর একাধিক জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়। স্থানীয় একটি স্কুলের একজন ছাত্রকে নিয়ে এ খবরটি ‘স্থানীয় খবর’ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার কথা। কিন্তু খবরটি জাতীয় খবরে পরিণত হয়েছে, কারণ ছাত্রটি প্রথম শ্রেণির। ছোট্ট একটি ছেলে বা শিশু এ খবরের উপাদান হওয়ায় খবরটির সংবেদনশীলতার মাত্রা অনেক বেশি। সব ক্রিয়ারই প্রতিক্রিয়া থাকে। এই প্রতিক্রিয়া পক্ষে-বিপক্ষে হতে পারে। মানুষ এই পক্ষে-বিপক্ষের কুশীলব। মানুষের মধ্যে বয়সের ভেদাভেদ আছে। ছোট্ট শিশুও মানুষ। কিন্তু শিশু সব হিসেবের বাইরে। তাবৎ দুনিয়ার অবস্থান শিশুর পক্ষে। শিশুর বিপক্ষে কেউ নেই, থাকেও না। এ অভিমতের বিপরীতে কেউ হয়তো বলতে পারেন, এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের যুদ্ধে কিংবা দেশের অভ্যন্তরে জাতিগত বা সম্প্রদায়গত দাঙ্গায় নিরীহ অনেক শিশু কী মারা যায় না? সহজ উত্তর অনেক নিরপরাদ ও নিরীহ শিশু মারা যায়, তবে এটা নিশ্চিত যে, ওই হামলা বা আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু নিশ্চয় শিশু না। ঘটনা চক্রে এ ধরনের ঘটনায় শিশুরা শিকার হয় মাত্র। নারায়ণগঞ্জের বন্দর শিশুবাগ স্কুলের সাফির ঘটনাটি একেবারে ভিন্ন। প্রথম শ্রেণির ছাত্র ছোট্ট শিশু সাফি মনুষ্য জাতির একদল সংঘবদ্ধ লোকের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই লক্ষ্যটি অশুভ।
মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতা হয়, সেটা কী লেখাপড়া, খেলাধুলা, আয়-উন্নতিসহ নানা ক্ষেত্রে হতে পারে। প্রতিযোগিতা অপরের অংশগ্রহণকে মানসিকভাবে গ্রহণ করার সংস্কৃতি জাগায়। এ জন্য প্রতিযোগিতা সবার কাছে ইতিবাচক শব্দ হিসেবে গণ্য। বন্দরের শিশুবাগ স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাথে কয়েকজন ছাত্রের অভিভাবকদের ভালো-মন্দের কিংবা শিষ্ট-অশিষ্টের যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান চলছে, সেটাকে প্রতিযোগিতা বলা যায় না। বন্দর শিশুবাগ স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে কয়েকজন ছাত্রের অভিভাবক জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অভিযোগ করেছেন। স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি এ অভিযোগ করার ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির ছাত্র সাফির বাবার সম্পৃক্ততা আছে মনে করে প্রতিশোধ হিসেবে সাফির ওপর যে মানসিক নিপীড়ন করছে, সেটাকে প্রতিযোগিতা নয়, যুদ্ধও নয়, সরাসরি দুর্বৃত্তপনা বলা যায়। এই দুর্বৃত্তপনার শিকার প্রথম শ্রেণির একজন ছাত্র হতে পারে না। সবার কাছ থেকে স্নেহভরা আচরণ শিশুর প্রাপ্য। এই প্রাপ্যতা শিশুর অধিকার, দয়া বা অনুকম্পা নয়। বন্দরের শিশুবাগ স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি শিশু সাফির প্রতি যে আচরণ করেছে, সেটা অবশ্যই অন্যায়। এই অন্যায়ের প্রতিকার হওয়া জরুরি। কিন্তু প্রতিকারের মতো এই জরুরি কাজ করবে কে? ন্যায়-অন্যায়ের প্রতিকার আজকাল উপেক্ষিত। এসব কথা অনেকটা আদর্শিক কথাবার্তায় রূপ নিয়েছে। এখন আদর্শিক কথাবার্তা শুধু চিন্তা, চেতনায় সীমিত রাখতে হয়, বাস্তবে প্রয়োগে নয়। আমাদের এ ধারণা অমূলক হবে না যে, শিশু সাফির প্রতি অন্যায় আচরণের প্রতিকার তো হবেই না, উল্টো আসছে নতুন শিক্ষাবর্ষে শিশু সাফিকে ওই স্কুল ছাড়তে হবে। গণমাধ্যম ও প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারি এবং জবাবদিহিতার ভয়ে হয়তো স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি সাফিকে স্কুল ত্যাগের ছাড়পত্র দিবে না। কিন্তু এ কথা সহজবোধ্য যে, ওই স্কুলে শিশু সাফির লেখাপড়া করার মতো পরিবেশ নেই। প্রাণে ভরপুর পরিবেশের খোঁজে সাফির বাবা নিজেই তাঁর সন্তানের জন্য অন্য স্কুল বেছে নেবেন।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী অভিভাবকদের নামের মধ্যে সাফির বাবার নাম নেই। এতদসত্ত্বেও অভিযোগকারীদের মধ্যে সাফির বাবা রয়েছেন, এমন ধারণার ওপর নির্ভর করে ব্যবস্থাপনা কমিটি সাফির বাবাকে শায়েস্তা করার জন্য তাদের হাতের মুঠোয় থাকা সাফিকে বেছে নিয়েছে। পাঠক হিসেবে মনে হয়েছে, অভিযোগপত্রে সাফির বাবা স্বাক্ষর করলেই বা এমন কী দোষের ছিল? স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি অভিযোগ খণ্ডন করবে, সেটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যবস্থাপনা কমিটি সে পথে না গিয়ে প্রতিশোধ হিসেবে শিশু সাফিকে বেছে নেওয়া, লোকগুলোর কুৎসিত মানসিকতা উন্মোচিত হয়েছে। সরকারি প্রশাসনের হস্তক্ষেপে শিশু সাফির বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ রাখলেও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা সাফির বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথম শ্রেণির একটি শিশুর খাতা মূল্যায়নের বিদ্যার বাহাদুরি প্রকাশ, এক প্রকার মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ। প্রকাশিত রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন ব্যবস্থাপনা কমিটি ভেঙে দিয়ে এডহক কমিটি গঠন করতে চেয়েছিল। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্যের বাধারমুখে তা করতে পারেনি।
মানুষ মাত্রই নৈকট্যে আকৃষ্ট হয়। বৃহত্তর ঢাকা জেলার প্রতি আমার নৈকট্য রয়েছে। বিশেষত নারায়ণগঞ্জের প্রতি নৈকট্য আরো বেশি। নারায়ণগঞ্জের ওপর দিয়ে আমার নিজ বাড়ি মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরে যেতে হয়। এ কারণে নারায়ণগঞ্জ আমার অতি পরিচিত। আমি নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকদের সঙ্গে ফোনে এ স্কুলের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি যে, স্কুলটি এখনো এমপিওভুক্ত (মান্থলি পে অর্ডার, সংক্ষেপে ‘এমপিও’) হয়নি, চেষ্টা চলছে। এমপিওভুক্ত হওয়ার আগেই ব্যবস্থাপনা কমিটির যে দুর্বৃত্তপনা; এমপিওভুক্ত হলে এই দুর্বৃত্তপনা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, বিষয়টি উদ্বেগের।
বন্দর শিশুবাগ স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্বৃত্তপনা দেশের একটি খণ্ড চিত্র বলা যায়। দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই দুর্বৃত্তপনা কমবেশি ঘটছেই। এর কারণও জানা। বাংলাদেশে যেটা যেভাবে চলছে, চলুক- এ সংস্কৃতি গেঁড়ে বসেছে। নিগ্রহের শিকার ব্যক্তি নিগৃহীত হবে, বঞ্চিত ব্যক্তি বঞ্চিত হতে থাকবে, এটা স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে। প্রতিরোধের যেন কেউ নেই। ব্যাপারটা যেন পারলে এ অবস্থায় অভ্যস্ত হও, নয়তো চোখ বন্ধ করে থাক।
খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, দেশে সরকারি স্কুল ও কলেজ রয়েছে প্রায় ৩০০। বিপরীতে বেসরকারি স্কুল ও কলেজ রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। বেসরকারি স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় সরকারি নিয়মের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের নিয়ম কানুন অনুসরণ করা হয়। বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাগুলোতে স্কুল পর্যায়ে ম্যানেজিং কমিটি এবং কলেজ পর্যায়ে গভর্নিং বডির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্যের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের ডান হাত-বাম হাতের অনুসারী দলীয় নেতা-কর্মীরাই এসব পদে মনোনয়ন লাভ করেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সদস্য হতে যোগ্যতার কোনো মাপকাঠি নেই। স্থানীয় সংসদ সদস্যের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত, দলীয় চ্যালা-চামুন্ডা, মাস্তান, রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত, মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি যে কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি, বিদ্যায় উৎসাহী সদস্য হতে পারেন। ধারণা করি, এ কথা কারো অজানা নয় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদ প্রতিষ্ঠানের অর্থ তহবিল গোজামিলের খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ এবং শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে বাণিজ্য করাই এদের মুখ্য উদ্দেশ্য। প্রচলিত রেওয়াজের ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই থাকে। এখানেও ব্যতিক্রম থাকা স্বাভাবিক। হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এবং অন্য ব্যক্তিরা শিক্ষিত, বিজ্ঞ ও সৎ হতে পারেন। তাদের সংখ্যা অতিমাত্রায় কম।
গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে খবরের কাগজগুলোতে রাজধানীর মিরপুরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি খবর প্রকাশ করে। প্রকাশিত খবরে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের শিক্ষক মূল্যায়ন পরীক্ষা নেওয়ার আড়ালে ব্যবস্থাপনা কমিটি কার্যত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অযোগ্যতার অভিযোগে পর্যায়ক্রমে চাকরিচ্যুত করার অভিপ্রায় তুলে ধরে। খবরের কাগজগুলো ওই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির ‘বাড়া ভাতে ছাই দেওয়ায়’ এ যাত্রায় এমপিওভুক্ত ওই শিক্ষকরা বেঁচে গেলেও এই বাঁচা কতদিন স্থায়ী হবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। কারণ, দুর্বৃত্তপনা যাদের আয়-রোজগারের পথ; সে পথে তারা বেশি দিন নীরবে থাকতে পারে না।
এ কথা সবার জানা যে, চূড়ান্ত অবনতির পর, ঘটনা ইতিবাচকের দিকে রূপান্তর ঘটে। মনে হয়, স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্বৃত্তপনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ কারণে, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। বর্তমান সরকার বেসকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে পিএসসির আদলে পৃথক বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশন (এনটিএসসি) গঠন করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেটা এই ইতিবাচক পরিবর্তনেরই লক্ষণ। এরফলে ব্যবস্থাপনা কমিটির নিয়োগ বাণিজ্য ও অন্যা দুর্বৃত্তপনা কমে আসবে। আমরা সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষক