দৃষ্টিপাত
অবশেষে পাঠ্যবইয়ের ভাষা সহজীকরণে উদ্যোগ

অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা শিশুদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বেশ আগে থেকেই চলে আসছিল। তার ওপর আবার বিজ্ঞান বইয়ে বর্তমানে থাকা দুর্বোদ্ধ ও কঠিন ভাষাকে সহজীকরণের বিষয়ে অনেক শিক্ষবিদেরও আপত্তি ছিল দীর্ঘদিন থেকে। দেরিতে হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে শিশুদের ঘাড়ে অসংখ্য বইয়ের বোঝা কমানোর এবং সেসব বইয়ের ভাষা সহজীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিশুদের কাঁধে বইয়ের বোঝা—এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিষয়টি তাঁর বিভিন্ন আলাপে ও বক্তৃতায় নিয়ে আসতে শোনা গেছে।
সেটারই অংশ হিসেবে তিনি নিজে চলতি বছর (২০১৬) ২৬ জুলাই ঢাকায় শুরু হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রথমে আলোচনার অবতারণা করলে ডিসিরাও তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। তখনই প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণার্থে নির্দেশনা প্রদান করলে, সেখানে ডিসিরাও পাঠ্যবইয়ের বিষয়ে তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, কয়েক বছর ধরে অনেক শিশুই তাদের ক্লাসের বইয়ের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় তার ওজন বহন করতে পারছে না। সে জন্য স্কুলে যাওয়া-আসার পথে অভিভাবকরা তাদের বইয়ের ব্যাগ বহন করে থাকেন। সেসব বইয়ের এত ওজন যে সেগুলোতে অভিভাবকরা পর্যন্ত হিমশিম খেয়ে যান। সেখানে শ্রেণিভিত্তিক বইয়ের সংখ্যাও অনেক বেশি বলে মত দেন ডিসিরা। উদাহরণস্বরূপ তাঁরা বলেন, পঞ্চম শ্রেণিতে পাঠ্যবই হলো মাত্র ছয়টি, অথচ এক শ্রেণি ওপরে উঠলেই মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে সেই বইয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় ১৩টিতে।
সেখানে শারীরিক শিক্ষা, চারুপাঠসহ অনেক অপ্রয়োজনীয় বই রয়েছে, যেগুলো আলাদা বই হিসেবে না দিয়ে বরং বইয়ের সংখ্যা কমানোর জন্য বর্তমানে চালু থাকা সমাজ কিংবা বিজ্ঞান বইয়ে সংযুক্ত করে নিতে পারেন সহজেই। কারণ দেখা গেছে, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য একদিকে যেমন এতগুলো বইয়ের বোঝা বহন করা কষ্টসাধ্য, অন্যদিকে এত বড় সিলেবাস আত্মস্থ করাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সে সময় সবকিছু শুনে প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন। তদানুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বিষয়টি জানিয়ে গত ২৯ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে চিঠি দেওয়া হয়।
সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্রায় চারটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক উপকমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি প্রফেসর ড. আখতারুজ্জামান, শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, বুয়েটের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর ড. মনজুর আহমেদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিকে নিয়ে কমিটিগুলো গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিগুলো কারিকুলাম পর্যালোচনা করে নির্বাচিত পাঠ্যপুস্তকের মানোন্নয়ন ও ভাষার প্রাঞ্জলকরণের মাধ্যমে পরীক্ষার জন্যও নির্ধারিত একটি প্রশ্নব্যাংক তৈরি করে শিক্ষকদের কাছে রাখার ব্যবস্থা করবে।
এরই মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইন, এনসিটিবির সদস্য রতন সিদ্দিকীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি মিটিং করা হয়েছে, যেখানে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং বিশেষত শিশু-কিশোরদের জন্য মননশীল লেখক হিসেবে পরিচিত প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন একটি উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এ বিষয়ে তাঁর দিক থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন তিনি। এ সময় তাঁরা বলেন, নবম শ্রেণির বিজ্ঞানের পদার্থ, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি বইগুলোর ভাষা অনেক কঠিন। তা ছাড়া বিজ্ঞান বইয়ে নিউটনের সূত্রটি এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, যা দেখলেই শিক্ষার্থীরা ভয় পায়। কাজেই এ বইগুলো শিশুদের জন্য সহজ করে তুলে ধরতে হবে, যেন শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান শিক্ষায় আগ্রহী হয় এবং আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা নিতে পারে। আর স্বস্তির বিষয় হলো, এ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিশুদের অতিপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকেই।
সহসাই এ কষ্টসাধ্য কাজটি সাধন করার জন্য এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। ২০১৭ সালের মধ্যে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলা শিক্ষাবর্ষে তা চালু করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে। আর এ কাজটি করতে পারলে একদিকে যেমন কোমলমতি শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থাটা আরো সহজতর হবে, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিও রক্ষা হবে। সমাধান হবে দীর্ঘদিন ধরে চলমান একটি সমস্যারও। আর তখন সেটি বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।