বিশ্ব মিতব্যয়িতা দিবস
দারিদ্র্য বিমোচনে সঞ্চয়ের ভূমিকা

মিতব্যয়িতার সঙ্গে সঞ্চয়ের একটি বড় সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, কোনো মানুষ মিতব্যয়ী হলেই সেখান থেকে অর্থ বাঁচিয়ে সেটা সঞ্চয় করতে পারে। কবির কবিতায় আছে, ‘ক্ষুদ্র ক্ষদ্র বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল’, যা সঞ্চয়ের চেতনার সঙ্গে মিলে যায়। কোনো ভূখণ্ড, দেশ-মহাদেশ সৃষ্টির মূল একক যেমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা, ঠিক তেমনি বিন্দু বিন্দু জল মিলেমিশেই সৃষ্টি হয় কোনো জলাধার, সাগর-মহাসাগর ইত্যাদি।
এগুলো মূলত সঞ্চয়েরই উদাহরণ। গ্রামের বাড়িতে মা-বোনেরা ভাত রান্না করার সময় প্রতিবারই ভাতের চাল থেকে এক মুঠ করে চাল অন্য একটি পাতিলে জমিয়ে রাখত। আমরাও ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের মা-চাচিদের। এভাবে সপ্তাহখানেক জমানোর পর দেখা যেত, সেই জমানো চাল দিয়ে অন্য একদিনের রান্নার চাল হয়ে গেছে। অন্যদিকে, সেই চাল জমিয়ে কিছুদিন পরপর বিক্রি করে তা দিয়ে নারীরা তাঁদের প্রয়োজনীয় সাংসারিক কাজ সেরে থাকেন। আমরা ছোটবেলায় বাড়ির বিভিন্ন কাঁচাঘরে লাগানো বাঁশের খুঁটির একটি ফাঁপা অংশের ওপরে কেটে সেটাকে একটি সঞ্চয়ী ব্যাংক বানিয়ে তার মধ্যে ভাংতি পয়সা জমিয়েছি। সেখানে জমানোর জন্য হয়তো টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে, নয়তো বাবা বাজার থেকে এলে তাঁর পকেট চেক করে যে ভাংতি পয়সাগুলো পাওয়া যেত, সেগুলো সেই বাঁশের তৈরি করা চোঙায় জমিয়েছি।
এগুলো ভরে গেলে তা দিয়ে কোনো একটি ভালো কাজ করেছি, নয়তো বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছি ইত্যাদি ইত্যাদি। তার পর মাটির তৈরি করা ব্যাংকের টাকা-পয়সা জমিয়েছি। এখন তো বড় নামকরা প্লাস্টিক কোম্পানি বাচ্চাদের জন্য বিশেষ ধরনের টাকা-পয়সা জমানোর ব্যাংক তৈরি করেছে, যা সহজেই বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ বৃহৎভাবে দেখতে গেলে সামনের বড় ধরনের কোনো সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য এসব সঞ্চয় খুবই কার্যকর। আবার আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চাকরিজীবীদের বেতনের একটি নির্ধারিত অংশ ভবিষ্যতের জন্য বিভিন্ন নামে জমা করার বিধান চালু রয়েছে। সেটি অর্থবহ করতেই বিশ্বে মিতব্যয়ী ও সঞ্চয় দিবস হিসেবে পালন করা হয় প্রতিবছরের ৩১ অক্টোবরকে।
আর এটি পালনের জন্য রীতি চালু হয় ১৯২৪ সাল থেকে, যা প্রথম আন্তর্জাতিক সঞ্চয়ী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয়। ইতালির মেলানো শহরে অনুষ্ঠিত সেই কংগ্রেসের শেষ দিনে ইতালীয় প্রফেসর ফিলিপ্পো রাভিজ্জা এ দিনটিকে বিশ্ব সঞ্চয় দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তার আগে অবশ্য এমন একটি দিবস ১৯২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ও ১৯২৩ সালে জার্মানিতে পালিত হয়ে আসছিল। তার পর এটির গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ১৯৫৫ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এটি পালনের সুফলের বিষয়টি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ বিশ্বে সঞ্চয়ের জন্য অগ্রদূত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এ পূর্ববঙ্গে জমিদারি দেখাশোনা করার দায়িত্ব পান, তখন তিনিই সর্বপ্রথম তাঁর কৃষক প্রজাদের কল্যাণার্থে সঞ্চয়ের বিষয়টি চিন্তাভাবনা করেন। সেখানে তিনি একটি কৃষি ও সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খাজনা পরিশোধের জন্য যাতে প্রজাদের বেগ পেতে না হয়, সে জন্য সেই ব্যাংকের কাছে সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সমবায়ের জনক বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আখতার হামিদ খান কুমিল্লা অঞ্চলে সর্বপ্রথম সমবায়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সঞ্চয়ের মনোভাব সৃষ্টিতে সফল হন। সেই সফলতার সূত্র ধরেই সত্তরের দশকে স্যার ফজলে হাসান আবেদ সৃষ্টি করেন বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি (ব্র্যাক) নামে সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণদানকারী একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও), যা আজ বিশ্বের উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
ক্ষুদ্রঋণ ও সঞ্চয়ের একজন অগ্রপথিক হিসেবে ব্রিটিশ নাইট উপাধিসহ আরো অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। একই কনসেপ্ট ধারণ করে আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে সৃষ্টি হয় গ্রামীণ ব্যাংক নামে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সঞ্চয় ও ক্ষুদ্রঋণদানকারী আরেকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবশ্য এ কনসেপ্টটি বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে এর জন্য বিশ্বশান্তির জন্য সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল প্রাইজেও ভূষিত হন। তাঁদের ক্ষুদ্রঋণ ও সঞ্চয়ী কার্যক্রমকে ধারণ করে দেশে এখন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। তবে অভিযোগ রয়েছে, এসব সঞ্চয়ী সংস্থার মধ্যে কেউ কেউ মানুষের সরল বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে ভুঁইফোড় কিছু সংস্থা গরিবের অর্থ আত্মসাৎ করছে। সঞ্চয়ের জন্য পুরুষের চেয়ে নারীরা একটু বেশি উদ্যমী হন। সে জন্য এনজিওগুলোও মূলত নারীদেরই তাদের টার্গেট ক্লায়েন্ট করে থাকে। এখন স্কুলের শিশুদের জন্যও তাদের স্কুলের টিফিনের টাকা থেকে কিছু অংশ বাঁচিয়ে অর্থ জমানোর জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে, যা সারা দেশে বেশ সাড়া তৈরি করেছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক এখন লাভজনক সঞ্চয়ের জন্য বিভিন্ন মেয়াদি স্কিম অফার করে থাকে। তা ছাড়া কমিউনিটি ভিত্তিতেও বিভিন্ন ব্যাংক সৃষ্টি হচ্ছে, যেখানে সঞ্চয়ের সুযোগ রাখা হচ্ছে।
গ্রামীণ পর্যায়ে আনসার-ভিডিপি ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সর্বশেষ সংযোজন। দেশে বর্তমানে যে দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য এসেছে, সেখানে এসব ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের অবদান একেবারে কম নয়। মানুষ তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত অহেতুক ব্যয় না করে মিতব্যয়ী হয়ে সঞ্চয়ের দিকে নজর দেবে, যা ভবিষ্যতেও দারিদ্র্য বিমোচনে এগুলো সঞ্চয় কার্যক্রম আরো বেশি অবদান রাখবে—এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।