মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন কয়রার মসজিদকুঁড় মসজিদ

খুলনার দক্ষিণ অঞ্চলটি একসময় ঘন বন ও বিভিন্ন গাছ-পালায় ভরপুর ছিল। সিপাহী বিপ্লবের সময় সুন্দরবনের ঘন জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করেন বদিউল্লাহ নামের এক সৈনিক। পরে তার বংশধর হারেস সানার ছেলে তাহের সানা অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জঙ্গল কেটে মাটি খুঁড়তে যেয়ে প্রাচীন একটি স্থাপনা পান। পরবর্তী ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর প্রাচীন স্থাপনাটি মসজিদ হিসেবে স্বীকৃতি পায় ও নামাজ পড়া শুরু হয়। মাটির নিচ থেকে খুঁড়ে মসজিদটি আবিষ্কৃত হয় বলে একে মসজিদকুঁড় নামে নামকরণ করা হয়েছিল। আর মসজিদের নামানুসারে গ্রামটির নাম রাখা হয় মসজিদকুঁড় গ্রাম। জেলা শহর খুলনা থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে কয়রার আমাদি ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের পাশে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ মসজিদকুঁড় মসজিদের অবস্থান।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানা যায়, মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ নদ। পাশেই কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ। বাঁধের গা ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে মসজিদে যাওয়ার সিঁড়ি। মসজিদটি ৪৫ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এটি ইট-সুরকি দ্বারা তৈরি। পুরো মসজিদটি বর্গাকার। প্রতি পাশের মাপ হচ্ছে ১৬ দশমিক ৭৬ মিটার, ভেতরের মাপ ১২ দশমিক ১৯ মিটার করে। কেবলামুখী দেয়াল বাদে বাকি তিন দেয়ালে মসজিদে ঢোকার জন্য তিনটি করে খিলান আছে। মধ্যের খিলানগুলো অপেক্ষাকৃত বড়। তবে শুধু পূর্ব পাশের মধ্যের খিলনাটি মানুষ প্রবেশের জন্য উন্মুক্ত করা। বাকি সব খিলান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দেওয়াল ও ছাদের পুরত্ব অনেক বেশি থাকায় গরমের দিনেও মসজিদের ভিতরে শীতল থাকে। কেবলামুখী দেয়ালে অর্ধবৃত্তাকার মিহরাব তৈরি করা হয়েছে। চারটি ইটের তৈরি স্তম্ভের ওপর মসজিদটি ছাদ ভর করে আছে। চারটি স্তম্ভ মসজিদের ভেতরের অংশকে নয়টি সমবর্গক্ষেত্রে ভাগ করেছে। বর্গক্ষেত্রগুলো গম্বুজ দিয়ে ঢাকা। মাঝখানের গম্বুজটি অন্যগুলোর চেয়ে আকারে বড়। ভেতরের খিলান গম্বুজগুলোর নির্মাণকৌশল খুবই উঁচু মানের। দর্শনার্থীদের কাছে মসজিদকুঁড় মসজিদের প্রধান আকর্ষণ এর অসাধারণ নির্মাণশৈলী।
বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পাশাপাশি স্থানীয়রা মসজিদটির দেখাশোনা করে। মসজিদটির কোনো শিলালিপি না পাওয়ায় নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ ও মসজিদকুঁড়ের ৯ গম্বুজ মসজিদের গঠন প্রণালি ও স্থাপত্যে সাদৃশ্য রয়েছে।
ফলে ধারণা করা হয়, এটি খানজাহান আলী (র.) নির্মিত বা তার সমসাময়িক। অপর একটি মত হচ্ছে, ১৪১৮ থেকে ১৪৩৩ সালে বাংলার সুলতান ছিলেন জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ শাহ। ওই সময় হজরত খানজাহান আলী (রহ.) দক্ষিণ বঙ্গে আসেন। তিনি যশোরের মুড়লী পর্যন্ত পৌঁছে কাফেলাকে দুই ভাগে ভাগ করেন। একদল সঙ্গী নিয়ে তিনি নিজে বাগেরহাটের দিকে রওনা দেন। আরেক দল খানজাহান আলীর (রহ.) বিশ্বস্ত সহচর বোরহান খাঁ ওরফে বুড়া খাঁ ও তাঁর ছেলে ফতে খাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ দিকে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রার আমাদী এলাকায় চলে আসেন।
খানজাহান আলীর শিষ্য বুড়া খাঁ ও ফতেহ খাঁ ১৪৫০-১৪৯০ সালের দিকে আমাদী গ্রামে কাছারি করে এলাকা শাসন করতেন। ওই সময় তারা এটি নির্মাণ করেন। সিপাহী বিপ্লবের সময় সুন্দরবনের ঘন জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করেন বদিউল্লাহ নামের এক সৈনিক। পরে তার বংশধর হারেস সানার ছেলে তাহের সানা অষ্টাদশ শতাব্দির প্রথমদিকে জঙ্গল কেটে মাটি খুঁড়তে যেয়ে প্রাচীন একটি স্থাপনা পান। পরবর্তী ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের পর প্রাচীন স্থাপনাটি মসজিদ হিসেবে স্বীকৃতি পায় ও নামাজ পড়া শুরু হয়। মসজিদটি একসময় টেরাকোটা দিয়ে সজ্জিত ছিল। মসজিদের বাইরের দেয়াল দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তর দিকে পোড়ামাটির চিত্রফলক দ্বারা অলংকৃত ছিল। খিলান ও কার্নিসের ওপরেও অনুরূপ অলংকারের কাজ ছিল। অলংকৃতের মধ্যে আছে পদ্মফুল, মালা, বিলম্বিত রজ্জু ও ঘণ্টাসহ বিভিন্ন প্রতিকৃতি।
মসজিদটি দেখাশোনার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে একজন কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হলেও তিনি সেখানে থাকেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখানে পরিচ্ছন্নগত ঘাটতির পাশাপাশি নানাবিধ সংকট রয়েছে। মসজিদটি পরিচালনার ব্যয়, একটি উন্নতমানের ওযুখানা ও বাথরুম, কপোতাক্ষ নদের পাড়ে পর্যটকদের বসার স্থান তৈরিসহ মসজিদটি ঘিরে ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানান এলাকাবাসি।
কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দীন বলেন, মসজিদটি দক্ষিণ বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন প্রত্নসম্পদ হিসেবে খ্যাত। দীর্ঘদিন সংস্কার ও ব্যবস্থাপনার অভাবে এর প্রকৃত সৌর্ন্দয্য ও প্রাচীনকালের শৈল্পিক কারুকাজ বিলীন হতে চলেছে। এটি সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আরও আন্তরিক হওয়ার দাবি জানান তিনি। এ ছাড়া এটি ঘিরে একটি ইসলামিক সংস্কৃতি ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন বলেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে একজন কর্মচারী দেয়া রয়েছে। তিনি যদি দায়িত্বে অবহেলা করে থাকেন তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতায় ইসলামিক সাংস্কৃতি ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার কোনো সুযোগ নেই বলেও জানান তিনি।