ফিরে দেখা ২০২১ : আশার বছর হতাশায় মোড়ানো
বছরের শুরুটা হয়েছিল দারুণ প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু, সময় গড়াতে আশা রূপ নিল হতাশায়। বিশ্বকাপের বছর হওয়ায় অর্জনের সুযোগ ছিল অনেক। কিন্তু, বছর শেষে অর্জনের পাল্লাজুড়ে শূন্যতা। সঙ্গে যোগ হলো নানা বিতর্ক।
২০২১ সালে তিন সংস্করণ মিলিয়ে ২০ ম্যাচে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। জয়ের সংখ্যাটা দেখলে খুশি হওয়ার কথা। কারণ, জয়ের হিসাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্বিতীয় সফলতম বছর এটি। কিন্তু, এ জয়ের সংখ্যাটা নিছক সংখ্যাই। কারণ, যে মঞ্চে জয়ের প্রত্যাশা প্রবল ছিল, সে মঞ্চ থেকেই খালি হাতে ফিরেছে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের দুঃস্বপ্নের কথা ভাবলে হতাশই হবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটভক্তরা। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বছরজুড়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে যত ঘটনা।
জয়ের স্মৃতি নিয়ে বছর শুরু
২০২১ সালের শুরুটা ছিল দারুণ। বছরের প্রথম মাসেই ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। যদিও আনকোরা দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসা ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে জয়টা প্রত্যাশিত ছিল। তবুও বড় জয়ে বছর শুরুর করার সুখকর স্মৃতি পেয়েছিল তামিম ইকবালের দল।
সাকিবের বাইশ গজে ফেরা
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এ সিরিজটি দিয়েই আইসিসির নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বাইশ গজে ফেরেন সাকিব আল হাসান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার সিরিজ নিজের মতো করেই রাঙান বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। দলের জয়ে ভূমিকা রেখে সিরিজটিতে ‘ম্যান অব দ্য সিরিজ’ হন সাকিব।
সাদা পোশাকে দুর্দশা
সাদা বলে ভালো শুরুর রেশ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লাল বলের ক্রিকেটেই দেখতে হলো বছরের প্রথম হারের মুখ। টেস্ট সিরিজে এই দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছেই হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ। বছরের শুরুতে সাদা পোশাকে হওয়া দুর্দশা লেগে থাকে পুরো বছর পর্যন্ত। বছরের শেষটাও হয়েছে পাকিস্তানের কাছে বাজেভাবে হার দিয়ে। সবমিলিয়ে ২০২১ সালে সাত টেস্টের পাঁচটিতে হারে বাংলাদেশ। স্রেফ একটিতে জয় পায়, আর একটিতে ড্র হয়।
ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে সাদা পোশাকে উজ্জ্বল ছিলেন একমাত্র লিটন দাস। এ বছর সাত টেস্টে একটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি পাঁচটি ফিফটি করেন ডানহাতি এ ব্যাটার। ৪৯ দশমিক ৫০ গড়ে মোট করেছেন ৫৯৪ রান।
অধিনায়ক মুমিনুল হক ও নাজমুল হোসেন শান্ত দুটি করে সেঞ্চুরি করলেও সব ম্যাচে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। বোলিংয়ে উজ্জ্বল ছিলেন তাইজুল ইসলাম। এ বছর টেস্টে তিনি নিয়েছেন ৩০টি উইকেট।
ওয়ানডে ক্রিকেট
ওয়ানডেতে বরাবরই ভালো দল বাংলাদেশ। ২০২১ সালেও মোটামুটি ভালোই ছিল এ ফরম্যাটে। যদিও ওয়ানডেতে এবার ম্যাচ ছিল খুব কম। পুরো বছরে ১২টি ওয়ানডে খেলেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে আটটিতে জিতেছে। হেরেছে চারটি ম্যাচে।
এ ১২ ম্যাচই ছিল আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপ সুপার লিগের অংশ। তাতে ৮০ পয়েন্ট নিয়ে এখন দুইয়ে আছে বাংলাদেশ। ফলে, আগামী বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করার পথে কিছুটা এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে, এর জন্য ২০২২ সালে খুব কঠিন সিরিজে লড়তে হবে বাংলাদেশকে।
ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে উজ্জ্বল ছিলেন তামিম ইকবাল। ১২ ইনিংসে এক সেঞ্চুরি এবং চার ফিফটিতে ৩৮.৬৬ গড়ে ৪৬৪ রান করেছেন ওয়ানডে অধিনায়ক। অন্যদিকে, নয় ইনিংস খেলে ৪০৯ রান করেন মুশফিকুর রহিম। ১০ ম্যাচে ১৮ উইকেট নিয়ে বোলিংয়ে সবার ওপরে আছেন মুস্তাফিজুর রহমান। সাকিব আল হাসান নিয়েছেন ৯ ম্যাচে ১৭টি উইকেট।
টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে হারানোর স্বাদ
এ বছরই টি-টোয়েন্টিতে প্রথম অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। অবশ্য দুটি সিরিজই ছিল ঘরের মাঠে। নিজেদের উইকেটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ক্রিকেটের দুই শক্তিশালী দলকে পরাস্ত করে বাংলাদেশ। তা ছাড়া দুই দেশই মূল দল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসেনি। সে সুবিধাও অনেকাংশে কাজে দিয়েছে বাংলাদেশের।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে ৪-১ ব্যবধানে জয় পায় বাংলাদেশ। যেটি যেকোনো সংস্করণ মিলিয়েই তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জেতে ৩-২ ব্যবধানে। সেটিও কিউইদের বিপক্ষে প্রথমবার টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয়ের আনন্দ। পুরো বছরে টি-টোয়েন্টিতে এ বড় সাফল্য বলা চলে।
প্রত্যাশার বছরে টি-টোয়েন্টির উপাখ্যান
২০২১ সালের সবচেয়ে আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। কারণ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বছর এটি। ফলে, অনেকগুলো ম্যাচ খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে যতটা আশা ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে, সে আশানুরূপ ফল এনে দিতে ব্যর্থ লাল-সবুজের দল।
বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ড সফরে তিনটি ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরু হয় হার দিয়ে। পরের সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়টা প্রত্যাশিত ছিল। সেটাই হয়েছে। জিম্বাবুয়ে থেকে সিরিজ জিতে ফিরে বাংলাদেশ দল। এরপর ঘরের মাঠে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এ ফরম্যাটেই হারায় নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে।
টানা তিন সিরিজ জয়ে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল আকাশছোঁয়া। কিন্তু, প্রত্যাশার কিছুই পূরণ হলো না। বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচেই স্কটল্যান্ডের কাছে হার দেখে বাংলাদেশ।
পরে স্বাগতিক ওমান ও শেষ ম্যাচে পাপুয়া নিউগিনিকে হারিয়ে মূল পর্ব নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। কিন্তু, মূল পর্বে বাংলাদেশ দেখে আরও হতাশা। সুপার টুয়েলভে ব্যাটে-বলে দুই বিভাগেই ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ। পুরো সুপার টুয়েলভে একটি ম্যাচেও জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। অনেক আশা নিয়ে গিয়েও জয় থাকে অধরা। ১৪ বছর ধরে মূল পর্বে একটি জয়ের যে অপেক্ষা ছিল, সেটি আরও দীর্ঘায়িত হয়।
সব মিলিয়ে এ বছরে টি-টোয়েন্টিতে ২৭ ম্যাচ খেলে ১১টিতে জয় পায় বাংলাদেশ। হার দেখে ১৬ ম্যাচে। বিশ্বকাপের চরম ব্যর্থতায় ঢাকা পড়ে বছরের বাকি সাফল্য। বিশ্বকাপে দলীয় ব্যর্থতা ছিল তো বটেই, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সেও মলিন ছিলেন ক্রিকেটারেরা। বলার মতো পারফরম্যান্স কেউই করতে পারেননি।
নির্বাচন ও বিসিবির হটসিটে ফের নাজমুল হাসান
২০২১ সালেই অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচন। তবে, নির্বাচনকে ঘিরে উত্তাপ ছিল কমই। যথারীতি এবারও বিসিবি সভাপতির হটসিটে বসেছেন নাজমুল হাসান পাপন। এ নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো বিসিবির দায়িত্ব নিয়েছেন পাপন। এ ছাড়া আরেকবার পালন করেন সরকারের মনোনয়নে। সবমিলে এটি তাঁর চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব পালন।
অবশ্য বিসিবি পরিচালকদের মধ্যে কয়েকজন নতুন মুখ আসেন। আলোচনার জন্ম দেওয়া সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ এবং দেশের খ্যাতিমান ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব নাজমুল আবেদীন ফাহিম নির্বাচনে হেরে যান। সবমিলিয়ে ২৫ পরিচালকের মধ্যে ১৯ জনই পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। আর, পরিচালনা পরিষদে নতুন এসেছেন ৬ জন।
টেস্ট থেকে মাহমুদউল্লাহর অবসর
২০২১ সালের জুলাইতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হঠাৎ করেই টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ানোর আভাস দেন মাহমুদউল্লাহ। সুদূর জিম্বাবুয়েতেই ম্যাচ চলাকালীন তাঁকে গার্ড অব অনার দিয়েছেন সতীর্থরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় তাঁর অবসরের ব্যাপার। কিন্তু, আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানাননি মাহমুদউল্লাহ। চুপ ছিল বিসিবিও। অবশেষে বছরের শেষ দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরের ঘোষণা দেন মাহমুদউল্লাহ। জুলাইয়েই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজের ৫০তম টেস্টটি শেষ টেস্ট হয়ে থাকল মাহমুদউল্লাহর।
আন্তর্জাতিক ইভেন্টের আয়োজক
এ বছর আন্তর্জাতিক ইভেন্ট আয়োজনের আবেদন করে বাংলাদেশ। ২০২৪ থেকে ২০৩১ পর্যন্ত চক্রে আইসিসির অনেকগুলো ইভেন্টের আয়োজক হতে চেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু, সে আশা পূরণ হয়নি। শুধু ২০৩১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। সেটাও অবশ্য ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে।
মেয়েদের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন ছোঁয়া
বছরের শেষ দিকে বড় সুখবর আসে মেয়েদের ক্রিকেটে। এ বছরই প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। কোভিড পরিস্থিতির কারণে বিশ্বকাপের বাছাই বাতিল হয়ে যায়। পরে র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে মূল পর্বের দল নির্বাচন করা হয়। সে হিসাবে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন জাহানারা-সালমারা।
মাঠের বাইরে বিতর্কে ভরপুর
মাঠের খেলা যেমনই হোক, বছরজুড়ে বিতর্কের কমতি ছিল না। বছরের শুরুতেই নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরা সাকিবকে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। দেশের হয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে না গিয়ে আইপিএল বেছে নেন তিনি। এর জন্য আলোচনা হয় প্রচুর।
এরপর ঘরের মাঠে মন্থর উইকেট বিতর্ক। নিজেদের মাঠে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ জিতলেও ওই দুই সিরিজের পিচ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
এরপর শুরু হয় বিশ্বকাপের সমালোচনা। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বাজে পারফরম্যান্স সমালোচনার জন্ম দেয়। টি-টোয়েন্টির মঞ্চে সুপার টুয়েলভের পাঁচ মাচে ৪৯ গড়ে ২৪৪টি ডট বল খেলে বাংলাদেশের ব্যাটাররা। এ নিয়েও কথা হয় প্রচুর।
তার ওপর সমালোচনার জবাব দিয়ে উল্টো উত্তাপ বাড়িয়ে দেন সাকিব, মুশফিকরা। প্রথম ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে হারের পর বাংলাদেশ দলকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। কিছুটা চাপ আসে বোর্ডের পক্ষ থেকেও। এ দুটি জিনিস চেপে বসে ক্রিকেটারদের ঘাড়ে। তাই ওমানের বিপক্ষে জয়ের পরই সমালোচনার কড়া জবাব দিয়ে ফেলেন অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ। পরের ম্যাচে পাপুয়া নিউগিনিকে হারিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসে সে উত্তাপ আরও বাড়িয়ে দেন দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিম। সমালোচনার জবাবে তিনি সবাইকে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে বলেন। যে আয়না দেখার ট্রলে এখনও ছেয়ে আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। পরে টুর্নামেন্ট শেষে দলের অধিনায়ক নিজেই জানিয়েছেন, ওমানের বিপক্ষে জিতে আবেগে সেদিন কথাগুলো বলে ফেলেছেন তিনি।
বিতর্ক হয়, মাহমুদউল্লাহর অধিনায়কত্ব, কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর ভূমিকা, দলের পরিকল্পনা ও দলের মানসিকতা নিয়ে। সবমিলিয়ে মাঠের লড়াই যেমনই হোক না কেন, বিতর্কের দিক দিয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে ছিল না বাংলাদেশের ক্রিকেট। এবার সব বিতর্ক পেছনে ফেলে নতুন বছর রাঙানোর অপেক্ষা। নতুন বছরের শুরুর দিন থেকে নিউজিল্যান্ড সফর দিয়ে নিজেদের মিশন শুরু করবে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল।