অনন্য ক্রিকেট-ব্যক্তিত্ব রিচি বেনো
সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ‘ওয়াক অব অনার’ দিয়ে হেঁটে গেলে ‘দেখা’ হবে ডন ব্র্যাডম্যান, ভিক্টর ট্রাম্পার, ফ্রেড স্পফোর্থ, অ্যালান ডেভিডসন, রে লিন্ডওয়াল, কিথ মিলার, আর্থার মরিস, ববি সিম্পসন, বিল ও’রাইলি, ডগ ওয়াল্টার্সদের মতো কিংবদন্তির সঙ্গে। এই সম্মান-সরণি পেরিয়ে প্লেয়ার্স ড্রেসিংরুমের দিকে এগোলে দুদিকে দুটো ব্রোঞ্জ মূর্তি। একটা রিচি বেনো, অন্যটা স্টিভ ওয়াহর।
শুক্রবার স্টিভ ওয়াহকে ‘একা’ রেখে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন রিচি বেনো। ক্রিকেট-ভক্তরা যাঁকে স্মরণ করবে গভীর শ্রদ্ধায়, পরম ভালোবাসায়। ব্র্যাডম্যানের পর তিনিই অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত ক্রিকেট-ব্যক্তিত্ব। সেটা শুধু মাঠে যোগ্য নেতৃত্বের জন্য নয়, মাইক্রোফোন হাতে অসাধারণ অর্জনের জন্যও।
১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে সিডনিতে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক। ক্রিকেটার হিসেবে হোক বা অধিনায়ক, বেনোর জুড়ি পাওয়া ভার। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বে অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যের সূচনা। প্রথম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে দুই হাজার রান আর ২০০ উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়ার অনন্য কীর্তি বেনোর। এক যুগ স্থায়ী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট-জীবনে ৬৩ টেস্ট খেলে তিনটি সেঞ্চুরি আর নয়টি ফিফটিসহ ২,২০১ রান করার পাশাপাশি লেগব্রেক গুগলি বোলিংয়ে নিয়েছিলেন ২৪৮ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও বেনোর ক্যারিয়ার দারুণ সমৃদ্ধ। ১১ হাজার ৭১৯ রান আর ৯৪৫ উইকেট বুঝিয়ে দিচ্ছে, তিনি ছিলেন একজন নিখুঁত লেগস্পিনিং অলরাউন্ডার।
অধিনায়ক হিসেবেও দারুণ সফল। তাঁর অধীনে ২৮টি টেস্ট খেলে ১২টি জিতেছে অস্ট্রেলিয়া, ড্রও করেছে ১২টি, বাকি চার ম্যাচ হার। এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বেনোর অধিনায়কত্বে কখনো টেস্ট সিরিজ হারের তেতো স্বাদ পেতে হয়নি অস্ট্রেলিয়াকে। অধিনায়কত্ব সম্পর্কে তাঁর বিখ্যাত বাণী, ‘অধিনায়কত্ব ৯০ ভাগ ভাগ্য আর ১০ ভাগ দক্ষতা। কিন্তু সেই ১০ ভাগ ছাড়া দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টাও করো না।’
অবসরের পর ক্রিকেটের সঙ্গে আরো গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন বেনো। তিনি ছিলেন একাধারে ক্রিকেট বিশ্লেষক, গবেষক, সংগঠক, পরামর্শক, লেখক-সাংবাদিক এবং অতি অবশ্যই ধারাভাষ্যকার।
১৯৬৪ সালে অবসরের অনেক আগেই বেনোর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। ১৯৫৬ সালে বিবিসিতে একটি উপস্থাপনা কোর্স করার পর তিনি নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ডে সাংবাদিকতা শুরু করেন। আর অবসরের পর হয়ে যান পুরোদস্তুর ক্রীড়া সাংবাদিক ও ধারাভাষ্যকার। সত্তরের দশকে ক্রিকেট-দুনিয়া তোলপাড় তোলা কেরি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজের অন্যতম সংগঠক ছিলেন বেনো। ধারাভাষ্যকক্ষে তাঁর সপ্রতিভ উপস্থিতি, অননুকরণীয় বাচনভঙ্গি, শব্দচয়ন আর রসবোধ উপভোগ করতেন সহকর্মীরাও। টিভি দর্শকের প্রিয় ধারাভাষ্যকার তো ছিলেন অবশ্যই। বেনোর রসবোধের একটি উদাহরণ, ‘দুই রান করে আউট হলেন গ্লেন ম্যাকগ্রা, মাত্র ৯৮ রানের জন্য মিস করলেন সেঞ্চুরি!’ অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক চ্যানেল নাইনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে তাঁর বিশাল অবদান।
অফিসার অব দি অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (১৯৬১), স্পোর্টস অস্ট্রেলিয়া হল অব ফেম (১৯৮৫), লোগি অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৯), অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট হল অব ফেম (২০০৭), আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেম (২০০৯)—তাঁর বর্ণাঢ্য ক্রিকেট-জীবন এমন অজস্র সম্মান আর পুরস্কারে সমৃদ্ধ।
ক্রিকেট-ভক্তদের মনে অবশ্য এসব পুরস্কার দিয়ে নয়, ক্রিকেটার আর ধারাভাষ্যকার হিসেবে চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন রিচি বেনো।
প্রায় ৫০০ টেস্টের সাক্ষী এই অনন্য ক্রিকেট-ব্যক্তিত্বকে কি ভোলা সম্ভব!