বিল নিকোলসন : আড়ালে থাকা গত শতাব্দীর কোচিং মায়েস্ত্রো
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সেরা দল টটেনহাম হটস্পার। ক্লাবটিকে নিয়ে প্রচলিত এক রসিকতা হলো, প্রিমিয়ার লিগের রবিনহুড তারা! বড় ক্লাবগুলোর জন্য সব সময়ই আতঙ্কের এক দল টটেনহাম। তাদের কাছে হরহামেশা পয়েন্ট হারায় ম্যানইউনাইটেড, ম্যানসিটি, চেলসি, লিভারপুলের মতো দলগুলো। সেই টটেনহামই আবার ছোট দলের কাছে খুইয়ে বসে পয়েন্ট। মানে দাঁড়াল—বড়দের কাছ থেকে পয়েন্ট নিয়ে ছোটদের বিলিয়ে দেওয়া।
১৮৮২ সালে ১১ জন স্কুল বালকের হাত ধরে ক্লাবটির পথচলা শুরু হয়েছিল। তারপর কালের পরিক্রমায় গত হয়েছে ১৪২ বছর। সুদীর্ঘ সময়ে ক্লাবের ইতিহাসের পুস্তকে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে কতশত গল্প, কতজনের গল্প। কেউ কেউ ইতিহাসের অংশ হন, ‘উইলিয়াম বিল অ্যাডওয়ার্ড নিকোলসন’ নিজেই ইতিহাস। অন্তত টটেনহামের জন্য যা করেছেন তিনি, তাতে ক্লাবটির ভক্তরা তাকে কখনোই ভুলবে না। ক্লাবের স্বর্ণযুগের প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। খেলোয়াড় ও কোচ, দুই ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন দুর্দান্ত।
১৯১৯ সালের ২৬ জানুয়ারি নর্থ ইয়র্কশায়ারে জন্ম নেওয়া নিকোলসন ১৯৩৮ সালে পেশাদার ফুটবলে পা রাখেন। শুরুটা টটেনহামের হয়েই। তবে,. তাতে ছিল রোমাঞ্চ আর অনিশ্চয়তা। ১৭ বছর বয়সে যখন প্রথমবারের মত স্পার্সে (টটেনহাম ক্লাবটির ডাকনাম) ট্রায়াল দিতে আসেন, তখন ছিলেন সামান্য লন্ড্রি বয়। স্কুল থেকে প্রতিদিন যেতেন লন্ড্রিতে কাজ করতে। সঙ্গে চালিয়ে যেতেন ফুটবল।
ক্লাবের ট্রায়ালে টিকে যাওয়ার পর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৫৫ পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ান হোয়াইট হার্ট লেন (টটেনহামের মাঠ)। ১৯৫১ সালে টটেনহামের বিখ্যাত ‘পুশ অ্যান্ড রান’ এর অংশ ছিলেন নিকোলসন, যে মৌসুমে প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার লিগ জয়ের স্বাদ পায় স্পার্স।
এবার তার কোচিংয়ে আলোকপাত করা যাক। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্যার ম্যাট বাসবি, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন, আর্সেনালের আর্সেন ওয়েঙ্গার কিংবা এভারটন ভক্তদের কাছে ডেভিড ময়েস আছেন অনেকটাজুড়ে। ওপরের চারজনই ক্লাবগুলোর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে। প্রথম তিনজনের মতো ময়েস সফল না হলেও এভারটনের ডাগআউটে দাঁড়িয়েছিলেন ১১ বছর! বিল নিকোলসন ওপরের তিনজনের মতো সফল, আবার চারজনের মতোই ক্লাবের ইতিহাস বইয়ে ঢুকে গেছেন। রয়েছেন আবেগের বিশাল অংশ নিয়ে।
কোচ হিসেবে প্রথম দুই মৌসুম খালি হাতেই থাকা নিকোলসনের সাফল্য যাত্রা শুরু হয় ১৯৬০/৬১ মৌসুম থেকে, সঙ্গে স্পারদের পুনর্জন্ম। সেবার এফএ কাপ জিতিয়ে ঘুচান দশ বছরের শিরোপাখরা, যা ছিল চার দশক পর তাদের এফএ কাপ জয়!
কিন্তু, নিকোলসনের বলা কিছু কথা খেলোয়াড়দের রীতিমতো বদলে দিয়েছিল।‘এখানে আসা প্রতিটি খেলোয়াড়, হোক সে বড় তারকা কিংবা মাঠকর্মীর সন্তান, তাকে অবশ্যই ক্লাব অন্তঃপ্রাণ হতে হবে। নিজের পারফরম্যান্সে কখনোই তুষ্ট হতে পারবে না এবং পরাজয়কে অপছন্দ করতে হবে।’— কোচ হিসেবে যখন কেউ এভাবে বলতে পারে তখন দলের সাফল্য অনিবার্য।
১৯৫৮-১৯৭৪ পর্যন্ত টটেনহামে ছিলেন নিকোলসন, ক্লাবটি তাদের স্বর্ণযুগ কাটায় সেই সময়টায়। তার অধীনে প্রথম দল হিসেবে এক মৌসুমে দেশীয় ও মহাদেশীয় শিরোপা জেতার অনন্য কীর্তি গড়ে স্পার্সরা। ১৬ বছরে আটটি মেজর, দুটি নন-মেজর শিরোপা ও তিনটি কমিউনিটি শিল্ড জিতিয়ে পেয়ে গেছেন অমরত্ব।
ভদ্রলোক তার কোচিংয়ে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন। তার অধীনে লন্ডনের ক্লাবটি আস্বাদন করে বহু প্রথমের স্বাদ! ১৯৬৩ সালে তাদের একমাত্র ইউরোপিয়ান কাপের টাইটেলটি ছিল বিংশ শতাব্দীতে কোনো ব্রিটিশ ক্লাবের প্রথম ইউরোপিয়ান শিরোপা জয়।
ইউরোপের দুটি ভিন্ন টুর্নামেন্টে ট্রফি উঁচিয়ে ধরা প্রথম ব্রিটিশ ক্লাবও টটেনহাম। একাধিকবার লিগ কাপ জেতার পথ দেখিয়েছে তারাই। ১৯৬০-৬১ মৌসুমে লিগের প্রথম ১১ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড আজ অব্দি স্পার্সদের দখলে! ২০০৪ সালে ৮৫ বছর বয়সে না ফেরার দেশে গেলেও করলেও টটেনহাম ক্লাবকে সোনালি স্বাদ এনে দেয়া নিকোলসন ক্লাবের প্রতিটি ধূলিকণায় বেঁচে থাকবেন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে। ক্লাবের সবার জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে তিনি অদ্বিতীয়। ক্লাবের সবার জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে তিনি এক ও অদ্বিতীয়। নিকোলসন কোচিং আকাশের এমন এক তারকা, যার কোচিং দর্শন ছিল সময়ের চেয়ে এগিয়ে। যা আলো দিয়েছে টটেনহামকে।