জীবন যখন যেমন
প্রাপ্তির আনন্দ আর অপ্রাপ্তির বিষাদে পূর্ণ মানুষের জীবন। কখনো কি মনে হয়েছে, জীবনের সুবর্ণ সময় পার হয়ে গেছে? যদিও এটি ঘটেছে নিজের অজান্তেই।
পশ্চিমা বিশ্বে একটি কথা প্রচলিত, চল্লিশে হয় জীবনের শুরু। আর ষাটে হলো নতুন পঞ্চাশ। তাহলে মানুষের সুস্থতা, কর্মদক্ষতা আর অন্যান্য বিষয়ের নিরিখে মানুষের জীবনের কোন সময়টি কোন কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত?
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য থেকে মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি ও বয়সের সঙ্গে শরীর আর মনের পরিবর্তনের একটি সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসির বিজ্ঞানবিষয়ক বিশ্লেষকরা।
শারীরিক ক্ষমতা
সব মানুষের মধ্যে শারীরিক সক্ষমতা সমান নয়। ১০০ মিটারের দৌড়বিদ, বর্ষা নিক্ষেপের মতো হঠাৎ বিপুল পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন হয়-এমন খেলোয়াড়দের ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়টি থাকে ২০ থেকে ৪০-এর মাঝামাঝি। এর পরে দ্রুত তাঁদের শারীরিক সক্ষমতা কমে যায়। তবে ফুটবলারদের সবর্ণ সময় শুরু হয় এরও আগে।
তবে খেলোয়াড়দের মধ্যে ব্যতিক্রমও দেখা যায়। সাধারণত ৩০-এর শেষে বা চল্লিশের শুরুতে ক্যারিয়ার পড়তে থাকার কথা থাকলেও অনেক দৌড়বিদকে ৭০ বছর পর্যন্ত ক্যারিয়ার টেনে নিতেও দেখা যায়।
স্মৃতিশক্তি
বিস্ময়কর মনে হলেও বয়স ২০-এর পূর্ব থেকেই মানুষের স্থায়ী স্মৃতির ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। চল্লিশে পৌঁছে কয়েক বছর স্থির থাকার পরে আবার নিম্নগামী হয়। ৮০ বছরের পর স্থায়ী স্মৃতির ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে যায়।অপরদিকে স্বল্প সময়ের স্মৃতির ক্ষমতা ২০ থেকে ৪০-এর কিছু পর পর্যন্ত একই অবস্থায় থাকে। পরে দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। স্থায়ী স্মৃতিক্ষমতার মতোই অস্থায়ী স্মৃতিক্ষমতাও ৮০ বছরের পর প্রায় শূন্যে পৌঁছায়।
গবেষকদের মতে, ৪০ বছর হলো স্মৃতির জন্য সবচেয়ে সুবর্ণ সময়। এই সময় স্থায়ী ও অস্থায়ী স্মৃতি প্রায় একই অবস্থায় থাকে। দেখা গেছে নোবেল জয়ী অধিকাংশ আবিষ্কার বা কাজের অধিকাংশই ঘটেছে ব্যক্তির ৪০ বছর বয়সে। আর অন্যের মুখ চেনার স্মৃতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে ২০ থেকে ৪০ বছরের মাঝামাঝি। আর স্মৃতিহ্রাসের সঙ্গে চুল হারানোরও সম্পর্ক দেখা যায়।
জ্ঞান, বিশ্লেষণক্ষমতা ও বোধশক্তি
সাধারণ জ্ঞান, বিশ্লেষণক্ষমতা ও বোধশক্তি মানুষের জ্ঞানের তিনটি বিষয়ই ২০ বছর বয়সের পর ঊর্ধ্বমুখী হয়। ৪০ থেকে ৬০ বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। এরপর এই ক্ষমতাগুলো হ্রাস পেতে থাকে। হ্রাস পাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি হয় বিশ্লেষণ ক্ষমতার। এর চেয়ে কম হারে হ্রাস পায় বোধশক্তি। সবচেয়ে ধীরে কমে সাধারণ জ্ঞান। জ্ঞানের তিনটি ক্ষমতাই ৮০ বছরের পর দ্রুত হ্রাস পেয়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়।
জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি ও যৌন সম্পর্ক
বয়স ও সক্ষমতার সঙ্গে জীবনের সন্তুষ্টি এবং যৌন সম্পর্ক ও এর ইচ্ছার (সেক্সুয়াল রিলেশন) বিপরীতমুখী সম্পর্ক দেখা যায়। যৌন সম্পর্ক ও এর ইচ্ছা হ্রাসমুখী হলে মানুষের মধ্যে জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি বাড়তে থাকে। নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই এই হ্রাস বৃদ্ধি প্রায় একই হারে ঘটে। দেখা গেছে, নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ২০ থেকে ৪০-এর কয়েক বছর পরেও নারী ও পুরুষের যৌন সম্পর্ক ও এর ইচ্ছা প্রায় একই থাকে। ৪০ থেকে ৬০ বছরের মাঝামাঝি সময়ে মানুষের মধ্যে এটি হ্রাস পেতে শুরু করে। তবে নারীর মধ্যে এমন হ্রাসের হার বেশি থাকে। ৬০-এর পর যৌন সম্পর্ক ও এর ইচ্ছা নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। ৮০ বছরের কিছু পূর্বেই এটি সর্বনিম্নে নেমে আসে। অপরদিকে ২০-এর কিছু পূর্বেই জীবনের সন্তুষ্টি হ্রাস পেতে শুরু করে। ২০ থেকে ৪০-এর মাঝামাঝি এটি কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়। তবে ৪০-এর কিছু আগেই এটি হ্রাস পেতে শুরু করে। তবে ৪০ বছরের কিছু পর থেকেই জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি ঊর্ধ্বমুখী হয়। ৬০ থেকে ৮০ বছরের মাঝামাঝি এর হার থাকে সর্বোচ্চ। তবে এর পর থেকে এটি হ্রাস পেতে থাকে।
স্মৃতি, জ্ঞান এবং জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি ও যৌন সম্পর্কের চার্টভিত্তিক এই বিশ্লেষণ স্বাভাবিক জীবনযাপনকারী মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই থেকে বলা যায়, মানুষের যৌন সম্পর্ক ও এর ইচ্ছা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে ২০ বছরে। সর্বোচ্চ শারীরিক সক্ষমতা থাকে ৩০ বছরে। মানসিক শক্তি সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ পর্যন্ত। আর সুখী হতে থাকে ৬০ বছরে। তবে এগুলো সবই পর্যবেক্ষণভিত্তিক গড়। সবার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে এমন ধারণা ঠিক নয়। এই সঙ্গে এখানে রোগে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আমাদের সবার উচিত বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা। আর চেষ্টা থাকতে হবে বয়সের বাঁধাকে হারিয়ে এগিয়ে যাওয়া।