চীনা পণ্যের দাম ও মানের চাপে জার্মান সৌর শিল্প

Looks like you've blocked notifications!

বাতিল চীনা সৌর শক্তি পণ্য ভিড় জমাচ্ছে জার্মানির বাজারে, যা আরো দুর্বল করছে দেশের সৌর শক্তি সংস্থাদের৷ ক্ষতির আবহেই তবে কেন দেশজুড়ে উৎপাদন বাড়াচ্ছে জার্মান সংস্থা সানম্যাক্স? 

জার্মানির ড্রেসডেন শহরের কাছে সানম্যাক্স সংস্থার উৎপাদন কেন্দ্র৷ আকারে খুব বড় না হলেও এই কেন্দ্রের ফাঁকা চেহারা যেন চোখে পড়ার মতো। একটা কনভেয়ার বেল্ট, চকচকে সৌর প্যানেল একদিক থেকে দেখা গেলেও সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ভিরহেলম স্টাইন এই প্রযুক্তি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে কিছুটা দ্বিধা করছেন।

স্টাইনের আশঙ্কা, যদিও বা সানম্যাক্স সংস্থা তার প্রযুক্তির পেটেন্ট নিয়েছে, চীনা কোম্পানিগুলোর খুব বেশি সময় লাগবে না একই মানের পণ্য বাজারে নিয়ে আসতে। জার্মানিতে আমদানি হওয়া সৌর পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশই জার্মানি কেনে চীন থেকে। বিশ্বজোড়া সৌর শক্তির বাজারে চীন এখন শীর্ষে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের ওপর নির্ভর করতে থাকলে তার প্রভাব এসে পড়বে জার্মানির পরিবেশ বিষয়ক লক্ষ্যমাত্রায়, যার মধ্যে রয়েছে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৮০ শতাংশই পুনর্নবায়নযোগ্য সূত্র থেকে সরবরাহ করা।

এক সময় চীনা পণ্যের পরিচিতি ছিল সস্তার, অনুন্নত মানের পণ্য হিসাবে। কিন্তু সেই দিন আর নেই। এখন চীনা পণ্য তৈরি হয় ‘গিগা ফ্যাক্টরির’ মতো বড় আকারে ও সমমানের, জানান ফ্রাউনহফার ইন্সটিটিউট ফর সোলার এনার্জি সিস্টেমসের ফটোভোল্টায়িক বিভাগের প্রধান রালফ প্রয়। সে কারণেই জার্মানির বাজারে চীনা সংস্থারা তাদের পণ্য কম দামে বিক্রি করে স্থানীয় উৎপাদকদের সমস্যায় ফেলছে।

ডয়চে ভেলেকে প্রয় বলেন, ‘দামের ওপর এটা বিশাল চাপ ফেলছে ও বাজারের সকল অংশগ্রহণকারীদের ইউরোপের বাইরে উৎপাদন নিয়ে যেতে বাধ্য করছে।’

কিন্তু সানম্যাক্সের স্টাইন ইতিবাচক যে, তাদের প্রযুক্তি এখনও প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এক বা দু‘বছর এগিয়ে আছে।

যে কারণে আলাদা সানম্যাক্সের সৌর শক্তি পণ্য

সাধারণত, সৌর প্যানেলের কর্ম ক্ষমতা থাকে ২০ শতাংশ। বাকি সৌর শক্তি বর্জ্য তাপ হয়ে যায়, কিছু পরিমাণ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে ও বাকি তাপ সৌর মডিউলের ভেতরেই আটকে থাকে৷ স্টাইনের দাবি, ‘আমাদের পণ্যের কার্যক্ষমতা ৮০ শতাংশ।’

এই বাড়তি কর্ম ক্ষমতার কারণ হচ্ছে বিদ্যুতের সাথে ৬০ শতাংশ শক্তি জমতে থাকা তাপ থেকেও আসে। সানম্যাক্সের সৌর মডিউল শুধু সূর্যের রশ্মিকেই বিদ্যুতে পরিণত করে না। সাথে, সৌর তাপকে আটকে তা থেকে থার্মাল প্রযুক্তিও বানায় তারা।

স্টাইন বলেন, ‘এই থার্মাল ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি, যা মূলত অটোমোটিভ শিল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তার সাথে সৌর প্রযুক্তিকে মেলানোটাই অভিনব।’

সানম্যাক্সের বার্ষিক উৎপাদন বর্তমানে ৫০ মেগাওয়াটে সীমিত। এই একই কেন্দ্র থেকে উৎপাদনকে ৫০০ মেগাওয়াটেও নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

বিশাল সাগরে এক ফোঁটা মাত্র

বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউরোপীয় সৌর সংস্থাগুলো তখনই চীনা পণ্যের সাথে পাল্লা দিতে পারবে, যদি তারা তিন গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে, বর্তমান খরচ কমিয়ে।

প্রয়ের মতে, সানম্যাক্স এমন একটি ব্যবস্থা যাদের ‘পদ্ধতি উদ্দীপনা জাগানো’ হলেও ‘ছোট ফটোভোল্টায়িক পণ্যের বাজারে বিকাশের ভালো সুযোগ’ দিচ্ছে। সৌর পণ্যের বাজারে জার্মানির যে রমরমা ছিল, তা আবার ফিরে আসবে কি না, সেটাই মূল প্রশ্ন, জানান প্রয়।

তিনি আরো বলেন, ‘জার্মানির সৌর শিল্প তখনই টিকে থাকবে যদি বিশাল আকারে উৎপাদন হাব ও সরবরাহ প্রকল্প সৃষ্টি করা যায়৷ দুঃখের বিষয় তেমনটা হচ্ছে না কারণ এই আকারের কোনো হাব বা কেন্দ্র আমাদের এই মুহূর্তে নেই।’

এত সহজ চীনের সাথে সখ্য?

রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসন ও তারপর পশ্চিমা রাষ্ট্রের রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় জার্মানির রাশিয়ান জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতার বিষয়টি এখন প্রকাশ্যে। এখন, বাণিজ্য দুনিয়ার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন সৌর শক্তি খাতে চীনের ওপর জার্মানির নির্ভর করার বিরূপ প্রভাব বিষয়ে।

কিন্তু এই তুলনা ত্রুটিপূর্ণ, মনে করেন জাক ডেলোয়া সেন্টারের বাণিজ্য নীতি প্রধান নিলস রেডেকার। তার মতে, ‘চীনের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে হলে তা জার্মানির সৌর ইন্সটলেশন পরিকল্পনায় বাধা দিতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে ঝুঁকি (গ্যাসের তুলনায়) অনেকটাই কম।’

ইউরোপীয় ইউনিয়নের সোলার গুদাম উপচে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, আগামী দেড় বছরের সৌর শক্তির রসদ আছে তাদের কাছে। ফলে, বিকল্প খুঁজতে আরেকটু বেশি সময় পাবে ইইউ, যা দেশের ভেতরের উৎপাদনকেও চাঙা করছে। ভবিষ্যতে ভারত বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সরবরাহ করতে পারে।

জার্মানির সৌর শক্তি খাতের ভবিষ্যৎ

জার্মান সৌর শক্তি সংস্থাদের নালিশ, সরকারি অর্থায়ন খুব কম। সমালোচকদের বক্তব্য, শুধু সরকারি ভর্তুকিতে সমাধান হবে না। অন্যদিকে, ভর্তুকি-সমর্থকরা চাইছেন উৎপাদনে গতি আনতে আরো সরকারি সাহায্য।

জার্মান সোলার ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর কারস্টেন ক্যোর্নিগ বলেন, ‘স্থানীয় সংস্থাদের প্রতিযোগিতার ময়দানে টিকে থাকার লড়াইয়ে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে সরকার সৌর প্রকল্পগুলোকে প্রাথমিক ধাপে থাকাকালীন সমর্থন করে কি না।’

সানম্যাক্স সহমত পোষণ করে চীনা পণ্যের ওপর কড়াকড়ি বাড়ানোর প্রস্তাবের সাথে। বেশ কিছু চীনা সংস্থাদের বিরুদ্ধে উঠেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। কিন্তু এক দশক আগে এমনভাবেই চীনা সংস্থাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় জার্মান সৌর খাত ধসে যাবার পর্যায়ে চলে এসেছিল।

দেশের সৌর খাতকে কীভাবে বাঁচাবে জার্মান সরকার, তা এখন দেখার বিষয়। মায়ার বুর্গার, সোলারওয়াট বা হেকার্টের মতো বড় সংস্থারা উৎপাদন কমানো, বন্ধ করা বা জার্মানির বাইরে উৎপাদন নিয়ে যাবার কথাও বলছে।

কিন্তু হাল ছাড়ছে না কয়েকটি সংস্থা। সানম্যাক্স ছাড়াও আরেকটি এমন উদাহরণ ব্রান্ডেনবুর্গের অক্সফোর্ড পিভি, যারা উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সৌর বিদ্যুৎ সেল তৈরি শুরু করেছে। ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ কর্মক্ষমতা দেখিয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে এই সংস্থা।

তবুও চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীর ধারে কাছে নেই উৎপাদন। অক্সফোর্ড পিভি’র অর্থনৈতিক প্রধান ফ্রাংক নওরোথ বলেন, ‘এই মুহূর্তে, সবার নজর দামের দিকে। কিন্তু যদি প্রযুক্তি উন্নত হয়, তাহলে হয়তো লোকে আরো বেশি দাম দেবে।’

চীনা পণ্যের সবচেয়ে কাছাকাছি যেতে পারে এমন পণ্য বানাচ্ছে এই দু’টি সংস্থাই, তবুও তা চীনের দাম ও মানের চেয়ে অনেক দূরে। সৌর শক্তি পণ্যের খাত এখনও আমদানি-নির্ভর। কিন্তু ভবিষ্যদ্বমুখী উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ওপর ভর করে জার্মানির এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখা ছাড়ছেন না তারা।