মেঘ-পাহাড়ি বন আর জলের নাচন

ট্যুর প্ল্যান তো দূরের কথা, কোথায় যাব সেটাই নির্ধারণ করতে পেরেছি একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে! এভাবে হুট-হাট বেরিয়ে পড়ে হারিয়ে গেলাম মেঘের পাহাড়, গহীন অরণ্য, বিস্তৃত নদী-হ্রদ আর ঝরনার মাঝে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ফারহান ফোন দিয়ে জানালো সপ্তাহ দুয়েক পর ওর দুদিন ছুটি আছে। কক্সবাজার বা বান্দরবানের দিকে যেতে চায়। ইকবাল, সৈকতের সাথে কথা বলেছে, এনামের সাথেও কথা বলবে। আমি বললাম, সবাই যেহেতু রাজি আমিও যাব। শুক্র-শনি আমার ছুটি থাকে, সমস্যা নেই। ব্যস, সবার সময় মিলে গেল এবার ভ্রমণের স্থান নির্বাচন, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পালা। পাহাড়, ঝরনা, নদী অঞ্চল ঘুরার ইচ্ছা থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়। এছাড়া এক জায়গায় আর কতবার যাওয়া যায়! বান্দরবানের আলীকদম, লামা অঞ্চলে চাওয়া অনুযায়ী প্রকৃতি ও থাকার জায়গা মিললেও মিললো না সরাসরি যাওয়ার বাস। চকরিয়া হয়ে যেতে চাইছিলাম না। সরাসরি আলীকদমের বাসের টিকিট আছে একেবারে শেষের সারিতে। দূর পথে সারারাত ঝক্কি নিতে না চাওয়ায় এটাও বাদ। এরপর নানা রকম ভাবনা ও জায়গার সন্ধান করতে করতে অবশেষে টিকিট কাটা হলো রাঙ্গামাটির। আগে একাধিকবার যাওয়া হলেও নতুন করে আরেকটু দেখা আর বহুদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের পুনর্মিলনী।

শরতের সকালে গিয়ে পৌঁছলাম রাঙ্গামাটি। ঋতুতে শরৎ হলেও বাস্তবে চলছিল বর্ষা! টানা বর্ষণে কাপ্তাই হ্রদ পানিতে টইটম্বুর, খুলে দেওয়া হয়েছে কাপ্তাই বাঁধের জলকপাটও। সকাল সকাল পৌঁছে নাস্তা শেষে যথারীতি বৃষ্টির দেখাও পেয়ে গেলাম। বৃষ্টির মাঝেই শহরের মধ্যে প্রধান সড়কের পাশে ফিশারি বাঁধ ঘাটে চলে গেলাম। এখান থেকে লেকের সৌন্দর্য দারুণভাবে উপভোগ করা যায়। বিশেষত, এই সময়ে যখন পানিতে ভরপুর, একেবারে সড়ক ছুঁইছুঁই। রাস্তার পাশ দিয়ে দর্শনার্থীদের জন্য ওয়াকওয়ে, বসার জায়গা নির্মাণ করা হচ্ছে। যা সুন্দর এ জায়গায় পর্যটকদের আনাগোনা আরও বাড়িয়ে দিবে। ঘাট থেকে কাপ্তাই লেকে ঘুরার জন্য সময় ধরে বা দিনব্যাপী নৌযান ভাড়া নেওয়া যায়। আমরাও ভাড়ার খোঁজ-খবর নিলাম, দরদাম করলাম, কিন্তু সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারলাম না।
রিজার্ভ বাজার ঘাটে গিয়ে বরকল ও আশেপাশের এলাকায় লঞ্চে যাওয়ার খোঁজ নিলাম। দুপুর ২টার আগে লঞ্চ নেই। আর যেদিন যাব, সেদিন ফেরার সুযোগও নেই। ফিরতে হবে পরদিন সকাল ৭টার লঞ্চে। তাই আবারও দিনব্যাপী পর্যটন স্পটগুলোতে ঘুরতে নৌযান রিজার্ভ করার প্যাকেজের খোঁজ নিলাম। এবারও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিতে পেরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চলে গেলাম আসামবস্তি। কথায় কথায় এখানেই মিলে গেল আমাদের আরেক ভ্রমণসঙ্গী—অটোরিকশাচালক রাকিব। এবার পরিকল্পনা হলো আজ আর নৌভ্রমণ নয়, সড়কপথে কাপ্তাই যাওয়া-আসা করব। তাই অটোরিকশা রিজার্ভ নিয়ে নিলাম। সিদ্ধান্তটা কতটা সঠিক ছিল তা গাড়ি চলা শুরু করলেই বুঝতে পারলাম। আল্লাহ্ তায়ালা পরিবেশটাও ভ্রমণের উপযোগী ও প্রকৃতিকে আরও সুন্দর করে দিলেন। পাহাড়ের উপর মেঘের উড়াউড়ি, গা ছুঁয়ে যাচ্ছে দোল খাওয়া বাতাস। বেলা গড়ালেও রোদের উত্তাপ নেই। একপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়, গহীন অরণ্য; আরেকপাশে বিস্তৃত জলরাশিতে ভরপুর নদী-লেক—ছবির মতো সুন্দর দৃশ্য, যা ছাড়িয়ে যায় কল্পনাকেও। জায়গায় জায়গায় গাড়ি থামিয়ে চললো ফটোসেশন। ছবি তোলা ছাড়াও কয়েক জায়গায় থামতে হলো। উঁচু পাহাড়ে সিএনজি-অটোরিকশা বেশি যাত্রী নিয়ে উঠতে পারছে না। অগত্যা দু-তিনজনকে নামতে হচ্ছে। গাড়ি ঠেলতে না হলেও হেঁটে উঠতে হচ্ছে উপরে!

বড়াদম ব্রিজের পাশে লেকে গোসলের লোভ সামলাতে কষ্ট হচ্ছিল। এরপরও কাপ্তাই নৌঘাঁটিতে লেকের ভেতর প্রাকৃতিক সুইমিংপুলে গোসলের অভিপ্রায়ে গোসল না করেই বড়াদম ছাড়লাম। রাস্তার পাশে একাধিক ইকো-রিসোর্ট ও ছবি তোলার স্পট রয়েছে। এখানে সময় ব্যয় না করে চললাম কাপ্তাই নৌঘাঁটির উদ্দেশে। নৌঘাঁটির রুটে বন্য হাতির চলাচল রয়েছে। পথিমধ্যে কোনো হাতির সাথে সাক্ষাৎ না হলেও বানরের দেখা মেলে। দুপুরে রোদের মাঝে নৌঘাঁটিতে পৌঁছানোর পর কিছুটা গরমে কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও হেলিপ্যাডে উঠলাম। উঠেই অস্বস্তি বা ক্লান্তি যা-ই বলি উধাও! সম্ভবত, এখান থেকে রাঙ্গামাটির পুরো প্রাকৃতিক রূপের একটা প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। নীলাকাশে মেঘের উড়াউড়ি, একপাশে লেকের বিস্তৃত অংশ, আরেকপাশে রাঙ্গামাটির চিরাচরিত সৌন্দর্য পাহাড়ের মাঝে মাঝে এঁকেবেঁকে চলা নীল জলরাশি, অপরদিকে অরণ্যঘেরা পর্বতমালা। পাহাড়ের একেক দিক থেকে একেক সৌন্দর্য অন্য কোনো স্থান থেকে এত ভালোভাবে দেখা যায় বলে জানা নেই। এর জন্য সম্ভবত মৌসুমও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাপ্তাই লেকে যখন পানি কম থাকে তখন নিশ্চিতভাবেই প্রাকৃতিক ক্যানভাসে জলরাশির কিছুটা কমতি চোখে পড়বে।
ঘাঁটিতে লেকে কায়াকিং ও গোসলের সুযোগ থাকায় সেদিকে গেলাম। পাহাড়ের নিচে নামার আগেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একটানা প্রচুর বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি থামলে পাহাড়ের নিচে লেকের পানিতে গোসলের জন্য ঘেরাও দেওয়া জায়গা অর্থাৎ ‘প্রাকৃতিক সুইমিংপুল’-এ গেলাম। প্রস্তুত হয়ে গোসল করতে নামলাম। ঠিক তখনই দায়িত্বরত সেনাসদস্য এসে জানালেন, ‘সুইমিংপুল’ বন্ধ রয়েছে, এখানে নামা যাবে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ব্যর্থ মনোরথে সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপর উঠলাম। গোসলের জন্য ফিরতি পথের বড়াদম ব্রিজের কাছে নামলাম। লেকের স্বচ্ছ পানিতে গোসলের পর শুধু মনের দুঃখ নয়, শরীরের ক্লান্তিও দূর হয়ে গেল। বিকাল হয়ে গেলেও গোসলের পর চনমনে মনে দুপুরের খাবার খেতে গেলাম সেখানকার তারুম লেকভিউ রেস্টুরেন্টে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের পরিচালিত এই রেস্টুরেন্টে ঠিক রেস্টুরেন্টের অনুভূতি পাওয়া যায় না। নিজ ঘরের একপাশের অংশকে রেস্টুরেন্ট বানানো, খাবার রান্নাও হয় ঘরেই। সম্পূর্ণ ঘরোয়া রান্না ও ঘরোয়া পরিবেশে লেকের মাছ দিয়ে খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা মনে থাকবে অনেক দিন। খাবার আমাদের এতই ভালো লেগেছিল যে, পরের দিন বোট ভাড়া নিয়ে সারাদিন লেকে ঘুরার পর বিকালে শহরে ফিরে সিএনজি-অটোরিকশা নিয়ে সেখানে গিয়ে দুপুরের খাবার খাই!
ভ্রমণের শুরুতে লেকের পাড়ে ইকো-রিসোর্টে থাকার ইচ্ছা থাকলেও পরে সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়। শহরে ফিরে নানা মতভেদ, বিভিন্ন হোটেল দেখার পর রিজার্ভ বাজারের কাছেই লেকের পাড়ে একটা হোটেল দুটি রুম নেই। পরদিন সকালে উঠে সারাদিন কাপ্তাই লেকের বিভিন্ন স্পট ঘুরার জন্য বোট রিজার্ভ করলাম। প্রচণ্ড ঢেউয়ের মাঝে ছুটে চলল ইঞ্জিনচালিত বোট। প্রথমে পলওয়েল পার্কে গেলেও নামলাম না। পর্যটন বিভাগের আওতাধীন রাঙ্গামাটির আইকন ঝুলন্ত ব্রিজ পানির নিচে ডুবে আছে। সেখানেও নামা হলো না। মূলত, আমাদের মতো শহুরে মানুষজনের কাছে কৃত্রিম স্পটগুলোর তুলনায় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশের আবেদন তুলনামূলক বেশি। এবার ছুটলাম সুবলং ঝরনার পথে। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে জলরাশির আঁকাবাঁকা পথে নৌ-ভ্রমণ না করলে রাঙ্গামাটির আনন্দ অর্ধেকই অপূর্ণ থেকে যায়। তবে একাধিকবার এসব জায়গা ভ্রমণ করায় অনুভূতিতেও মরচে পড়েছে বৈকি। নইলে কি আর অপরূপ সৌন্দর্যের মাঝে ভেসে চলতে চলতে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া যায়! বৃষ্টিপাত চলমান থাকায় সুবলং ঝরনায় পানি পেলাম। তবে পর্যটকের সংখ্যা এর চেয়েও বেশি! জানিয়ে রাখি, সুবলং ঝরনার উপরের দিকে পাহাড়গুলোতে নৃগোষ্ঠীদের বিভিন্ন পরিবারের বসবাস রয়েছে। তারা দৈনন্দিন কাজে এই পানির উপর নির্ভর করায় সুবলংয়ের পানির প্রবাহ সব সময়ই বেশ কম থাকে। অর্থাৎ, পূর্ণ প্রবাহে কখনোই ঝরে পড়ে না। ঝিরিপথের বিভিন্ন স্থানে লোকজন তাদের প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহের পরেই বাকি পানি ঝরনার গা বেয়ে পড়ে।

সুবলং ঝরনার ঠান্ডা পানিতে গোসলের পর গেলাম ছোট সুবলং ঝরনা। যেটা ঠিক ঝরনা নয়, জলপ্রপাত বলা যায়। কারণ, এর উৎসমুখ দেখা যায়। উৎসমুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে পানি ঝরে পড়াও দেখা যায়। তবে জায়গাটা পিচ্ছিল হওয়ায় বর্ষায় বেশ সাবধানী হতে হয়। এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বরকল গেলাম, সেখান অন্যান্য স্পট ঘুরে গেলাম পেদা টিং টিং। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে যাচ্ছে, তাই দুপুরের খাবার পেলাম না। খাবার না পেলেও পেলাম গোসলের স্পট। প্রচণ্ড বৃষ্টি ও প্রচুর বাতাস থাকায় লেকের পানিতে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কর্ণফুলী নদীর এই বিস্তৃত অংশে এসে যেন ঝড় শুরু হয়েছে। ঢেউয়ের তোড়ে পাহাড়ের পাড়েও ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা জানালেন, অন্যান্যবারের তুলনায় নদীতে এবার পানি বেশি। পাশাপাশি বৃষ্টিপাত ও বাতাসের গতিবেগও বেশি। এমন অবস্থায় সোজা পানিতে নেমে পড়লাম। প্রচণ্ড ঢেউয়ে বেশি দূর সাঁতরানো যাচ্ছিল না। তাই নৌকায় থাকা লাইফজ্যাকেটও নিলাম। বৃষ্টির মাঝে বড় বড় ঢেউয়ে ভেসে চলার দারুণ অনুভূতি। তবে সাঁতার না জানলে এই অনুভূতি ভয়ংকর অভিজ্ঞতায় রূপ নেবে। অবশ্য সাঁতার জানা সত্ত্বেও বেশিদূর যাওয়া যাচ্ছিল না। ঢেউ ডিঙ্গিয়ে ফেরত আসা যাবে না। তাই আশেপাশেই সাঁতার ও গোসল চলল। এই প্রথমবারের মতো আমাদের সামনে নিজের সাঁতারের দক্ষতা দেখাল ইকবাল। নিয়মিত উৎসাহ দেওয়ার পর অবশেষে বেশ অবাক করে দিয়েই ঢেউয়ের মাঝে নেমে গেল সাঁতার না জানা সৈকত! পাড়ে কোমর পানিতে থাকলেও ঢেউ এসে গায়ে আছড়ে পড়ছিল। এ কারণে সৈকতের সাথে কাউকে না কাউকে থাকতে হতো। সাহস করে নামার পর সৈকতের অনুভূতিও দারুণ! সম্ভবত, আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছে ও-ই।
গোসল শেষে ফেরার পালা। প্রচণ্ড ঢেউয়ে নৌযান দুলছিল। পানির আছড়ে পড়ছিল গায়ে। বোট এতটাই দুলছিল যে, সালাত (নামাজ) আদায় করলাম চেয়ারে বসে। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের ভাগ্যে প্রাকৃতিক সব সৌন্দর্য অবলোকনই লিখে রেখেছিলেন। রাঙ্গামাটি সদরে পৌঁছানোর বেশ খানিক আগে বিদায় জানাতে এসে হাজির হলো রংধনু। ঢেউয়ের বিপক্ষে যুদ্ধ করে এগিয়ে চলছে নৌযান, ওদিকে পেছনে পাহাড়ের উপর আকাশজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে রংধনু। জলরাশির বুকে পাহাড়, তার উপর রংধনু—এ যেন সৌন্দর্যের ষোলকলা! দুলন্ত নৌকার ছাদে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে অসাধারণ এই মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দি করলাম।

সদরে ফিরে খাওয়ার জন্য আবারও কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি সড়কের বড়াদমে যাওয়ার কথা তো আগেই বলেছি। সন্ধ্যায় ফিরতি পথে দেরি করে ফেলায় সেনাক্যাম্পে পরিচয় দেওয়া ও চেকিং-এর পর ছাড়া পেলাম। ঢাকামুখী বাস ধরার তাড়নায় দ্রুত ফেরার পথেও আসামবস্তি বাজার থেকে সেখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার বাঁশফুল কিনলো কেউ কেউ। সময় বয়ে চলছে আপন গতিতে। সময়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে ফিরতে হচ্ছে ঢাকার পথে। শরীর গাড়িতে উঠলেও মন যেন রাঙ্গামাটির আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর পানির ঢেউয়ের মাঝেই দুলছে।