অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত বাংলাদেশের সেরা পাঁচ স্থান

প্রতি বছর শীতকাল এলেই বাংলাদেশের প্রকৃতিতে ঘটে এক মনোমুগ্ধকর রূপান্তর। উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া, ইউরোপ এবং হিমালয়ের পাদদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে উষ্ণতার খোঁজে আসে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী পাখি। নিজেদের জায়গা থেকে তুলনামূলকভাবে কম শীতল হওয়ায় বাংলাদেশকে বেছে নেয় এই 'অতিথি পাখিরা'। তারা এখানে খুঁজে নেয় খাদ্য, প্রজনন এবং ছানাদের লালন-পালনের উপযুক্ত পরিবেশ। প্রকৃতির এই নৈসর্গিক বিস্ময় উপভোগ করতে এবং শীতের ডানায় ভেসে আসা রঙের মেলা দেখতে, আমরা ঘুরে দেখব বাংলাদেশের এমন কিছু স্থান, যা অতিথি পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।
ঢাকার কাছাকাছি প্রকৃতির ছোঁয়া: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা ও এর আশেপাশে অতিথি পাখির দেখা মিললেও, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের ভিড় প্রাণ ভরে উপভোগ করতে হলে যেতে হবে ঢাকার নিকটেই অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)। নয়নাভিরাম এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে ২০১৪ সালে অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। শীতকালে এখানকার লেকগুলো লাল শাপলা আর পরিযায়ী পাখিদের কোলাহলে যেন এক পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়। খুব সকালে বা বিকেলে লেকের ধারে শান্তভাবে বসে থাকার অভিজ্ঞতাটি সত্যিই অসাধারণ।
সিলেটের হাওড়ে প্রাণের স্পন্দন: জল আর পাখির মিতালী
হাওড়, নদী ও পাহাড়ের সমৃদ্ধ ভূমি সিলেটে অতিথি পাখিরা খুঁজে পায় পরম আশ্রয়। সিলেট বিভাগজুড়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওড়, মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিল, হাইল হাওড় ও পাত্রখোলা লেক, এবং সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড় ও রোয়া বিল এগুলো প্রতি বছরই মুখরিত হয়ে উঠে অতিথি পাখির কলকাকলিতে। নৌকা করে হাওড়ের বিশাল জলরাশিতে ভেসে বেড়ানো এবং বাইক্কা বিলের ওয়াচ টাওয়ার থেকে দূরবীন দিয়ে পাখিদের জলকেলি দেখার অভিজ্ঞতা চিরস্মরণীয়।
চট্টগ্রামের দ্বীপাঞ্চল ও উপকূলের পাখিরা
বন্দর শহর চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, উড়ির চর ও চরণদ্বীপে অতিথি পাখি দেখার জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়াও নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত নিঝুম দ্বীপ, হাতিয়া দ্বীপ, অতিথি পাখিদের জন্য এক নিরাপদ স্বর্গ। অন্যদিকে, পর্যটন শহর কক্সবাজারের মহেশখালী ও সোনাদিয়া, টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপ, শাহপরীর দ্বীপ ও হোয়াইক্যংও শীতের সময়টাতে ভরে ওঠে রঙ-বেরঙের অতিথি পাখিতে। সমুদ্র উপকূলের বিশালতার মাঝে এই পাখিদের ওড়াউড়ি এক অন্যরকম দৃশ্যপট তৈরি করে।
বরিশালের চরাঞ্চলে নাম না জানা অতিথিরা
বৃহত্তর বরিশালের দুর্গাসাগর, ভোলা জেলার মনপুরা দ্বীপ, চর কুকরি-মুকরি, ডাল চর এবং সুন্দরবনের দক্ষিণ উপকূলের চরাঞ্চল এই জায়গাগুলো শীতের সময়টায় নাম না জানা হরেক রকম অতিথি পাখির দেখা পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। পটুয়াখালী জেলার জনপ্রিয় পর্যটন স্থান কুয়াকাটার পাশাপাশি খেপুপাড়া বা কলাপাড়া, চরমন্তাজ, সোনার চর, এমনকি আগুনমুখা নদী বা গলাচিপা নদীতেও দেখা মেলে অতিথি পাখিদের জলকেলি। চরাঞ্চলের নীরবতা আর পাখিদের কিচিরমিচির প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করে।
মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের শান্ত জলাধার
বাংলাদেশের উত্তরের জেলা নীলফামারীর নীলসাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জুড়ে বিস্তৃত চলন বিল এবং পঞ্চগড়ের ভিতরগড়-এ প্রতি শীতে দেখা যায় পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁক। এছাড়া মধ্যাঞ্চলের নেত্রকোণার কলমকান্দার হাওর, কিশোরগঞ্জের নিকলি হাওর ও কলাদিয়াও সুপরিচিত অতিথি পাখি দর্শনের জন্য। এই স্থানগুলো প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতা আর জীববৈচিত্র্যের এক দারুণ মিশ্রণ।
দায়িত্বশীল ভ্রমণ: পাখিদের অভয়ারণ্য বাঁচানোর অঙ্গীকার
প্রকৃতির সৌন্দর্য্যের হাতছানি আদিম ও অকৃত্রিম। কিন্তু সেই সৌন্দর্য্যকে উপভোগ করতে গিয়ে তা নষ্ট করা উচিত নয়। অতিথি পাখি শুধু অপরূপ প্রকৃতির অংশ নয়; পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই ভ্রমণকালে আমাদের কিছু বিষয় অবশ্যই মেনে চলতে হবে:
পাখিদের খুব কাছে যাওয়া বা ঢিল মেরে তাদের ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকুন।
পাখির ছবি তোলার সময় নীরবতা বজায় রাখুন এবং ফ্ল্যাশ ব্যবহার না করাই ভালো।
পাখিদের আবাসস্থল বা অভয়ারণ্যের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
আইন মেনে চলুন পাখি শিকার বা কেনার চেষ্টা কখনোই করবেন না।
অতিথি পাখিরা আমাদের দেশের প্রকৃতিকে সাময়িকভাবে যে ঐশ্বর্য দান করে, তা উপভোগ করার জন্য আমাদের সচেতন ও দায়িত্বশীল ভূমিকা অপরিহার্য। আসুন, প্রকৃতির এই নৈসর্গিক বিস্ময়কে টিকিয়ে রাখতে আমরা সবাই এগিয়ে আসি।