হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার শহরে কেন যাবেন, কখন যাবেন?

জার্মানির হ্যামেলিন শহরটি তার রহস্যময় ও বিখ্যাত লোককথা "হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা" এর জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এই শহরটি জার্মানির 'জার্মান ফেয়ারি টেল রুট' এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে রূপকথার জগতের সাথে ঐতিহাসিক স্থাপত্যের এক চমৎকার মিশ্রণ ঘটেছে।
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্পের পটভুমি
‘হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা’ হলো ১৩শ শতাব্দীর একটি জার্মান কিংবদন্তী, যার উৎপত্তি এই হ্যামেলিন শহরেই।
একসময় জার্মানির হ্যামেলিন শহর ইঁদুরের উপদ্রবে জর্জরিত ছিল। ইঁদুরেরা শহরের খাদ্যশস্য নষ্ট করত, জিনিসপত্র কেটে দিত এবং শহরের শান্তি বিঘ্নিত করত। শহরের বাসিন্দারা এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে মেয়রের কাছে ধরনা দিত। মেয়র এই সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়ে ঘোষণা করলেন যে, যিনি শহরকে ইঁদুরমুক্ত করতে পারবেন, তাঁকে প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণমুদ্রা (কারো কারো মতে ১০০০ গিল্ডার) পুরস্কৃত করা হবে।
একদিন, শহরে এক অদ্ভুত পোশাক পরা অপরিচিত ব্যক্তি এলেন। তাঁর পোশাক ছিল বিচিত্র রঙের , এবং তাঁর হাতে ছিল একটি বাঁশি। তিনি মেয়রকে জানালেন যে, তিনি তাঁর বাঁশির সুরের জাদুতে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করতে পারেন। চুক্তিমতো, কাজ শেষে তাঁকে পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো।
বাঁশিওয়ালা তখন শহরের রাস্তায় নেমে তাঁর বাঁশিতে এক মায়াবী সুর বাজাতে শুরু করলেন। সেই সুর শুনে শহরের প্রতিটি ইঁদুর গর্ত, বাড়িঘর ও দোকান থেকে বেরিয়ে এসে বাঁশিওয়ালার পিছু নিতে শুরু করল। বাঁশিওয়ালা ইঁদুরের সেই বিশাল দলকে ওয়েজার নদীর দিকে নিয়ে গেলেন এবং নদীর জলে ইঁদুরগুলো ডুবে মারা গেল। এভাবে হ্যামেলিন শহর ইঁদুরমুক্ত হলো।
বাঁশিওয়ালা যখন তাঁর প্রতিশ্রুত পারিশ্রমিক নিতে মেয়রের কাছে গেলেন, তখন মেয়র ও শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা তাঁর জাদু দেখেও চুক্তি ভঙ্গ করলেন। যেহেতু ইঁদুরের উপদ্রব আর নেই, তাই তাঁরা বাঁশিওয়ালাকে পুরো পারিশ্রমিক দিতে অস্বীকার করলেন এবং সামান্য কিছু মুদ্রা (কারো কারো মতে মাত্র ৫০টি) দিয়ে তাঁকে অপমান করলেন।
অপমানিত ও ক্রুদ্ধ বাঁশিওয়ালা প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে শহর ছেড়ে চলে গেলেন। কিছুদিন পর, যখন শহরের প্রাপ্তবয়স্করা চার্চে প্রার্থনা করতে ব্যস্ত ছিলেন (কিংবদন্তী অনুসারে ১২৮৪ সালের ২৬ জুন, সেন্ট জন ও পলের দিনে), তখন বাঁশিওয়ালা আবার ফিরে এলেন। এবার তিনি সবুজ শিকারীর পোশাকে সেজে তাঁর বাঁশিতে আরও একটি বিষণ্ণ ও মোহনীয় সুর বাজাতে শুরু করলেন।
এই সুর এবার শহরের সমস্ত শিশুদের আকর্ষণ করল। প্রায় ১৩০ জন শিশু (কিছু কিংবদন্তী অনুসারে) মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদের ঘর ছেড়ে বাঁশিওয়ালার পিছু নিল। বাঁশিওয়ালা শিশুদের নিয়ে শহরের দরজা পেরিয়ে নিকটবর্তী পাহাড়ের দিকে চলে গেলেন এবং এক গুহার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সেই শিশুরা আর কখনো হ্যামেলিনে ফিরে আসেনি। বলা হয়, কেবল কয়েকজন শিশু পিছিয়ে পড়েছিল কেউ খোঁড়া হওয়ার কারণে, কেউ অন্ধ হওয়ার কারণে, আর কেউ বধির হওয়ার কারণে যারা পুরো ঘটনাটি কাউকে বলতে পারেনি বা অনুসরণ করতে পারেনি।
কিংবদন্তীর বাইরেও জার্মানির এই ঐতিহাসিক শহরটি ভ্রমণ করার মতো বহু কারণ রয়েছে
১. রূপকথার আকর্ষণ : এই শহরে প্রতি পদক্ষেপে বাঁশিওয়ালার কিংবদন্তীর ছোঁয়া পাওয়া যায়। আপনি শহরের রাস্তায় ইঁদুরের প্রতীক হিসেবে আঁকা পাথুরে চিহ্ন দেখতে পাবেন, যা আপনাকে প্রধান আকর্ষণীয় স্থানগুলোতে নিয়ে যাবে।
২. ঐতিহাসিক স্থাপত্য : হ্যামেলিনের পুরোনো শহর ওয়েজার রেনেসাঁ স্থাপত্যশৈলীর এক চমৎকার নিদর্শন। ১৫শ ও ১৬শ শতকের সুন্দরভাবে সংরক্ষিত কাঠের ফ্রেমে তৈরি বাড়ি, যেমন পিইড পাইপার'স হাউজ এবং ডেম্পটারহাউস, শহরের ঐতিহাসিক আকর্ষণকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
৩. বাঁশিওয়ালার অনুষ্ঠান ও পরিবেশনা: গ্রীষ্মকালে এই শহরের মূল আকর্ষণ হলো কিংবদন্তীর ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পরিবেশনা:
ওপেন-এয়ার প্লে : মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতি রোববার দুপুরে শহরের কেন্দ্রে বাঁশিওয়ালার গল্পের একটি বিনামূল্যে পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় ৮০ জন স্থানীয় বাসিন্দা অংশগ্রহণ করেন।
গাইড ট্যুর: এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত প্রতিদিন বাঁশিওয়ালার পোশাক পরা একজন গাইডের সাথে শহর ভ্রমণের সুযোগ থাকে।
৪. আরামদায়ক পরিবেশ: ওয়েজার নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি শান্ত ও মনোরম। ঐতিহাসিক রাস্তা, ক্যাফে এবং ছোট দোকানগুলো পর্যটকদের জন্য এক আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করে।
কখন যাবেন?
হ্যামেলিন শহর ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময় হলো গ্রীষ্মকাল (মে থেকে সেপ্টেম্বর)।
গ্রীষ্মকাল (জুন থেকে আগস্ট): আবহাওয়া উষ্ণ এবং আরামদায়ক থাকে (গড় তাপমাত্রা সাধারণত ১৭ থেকে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মধ্যে থাকে)। এটি শহর ভ্রমণের জন্য সেরা সময়। বিশেষ করে বাঁশিওয়ালার গল্পের ওপর ভিত্তি করে যে প্রধান ওপেন-এয়ার প্লে এবং অন্যান্য ইভেন্টগুলি এই সময়েই অনুষ্ঠিত হয়।
বসন্ত ও শরৎকাল (এপ্রিল/মে এবং সেপ্টেম্বর/অক্টোবর): এই সময়গুলোতে ভিড় কিছুটা কম থাকে এবং আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকে। তবে প্রধান ওপেন-এয়ার প্লে দেখতে চাইলে আপনাকে মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই যেতে হবে।
শীতকাল (নভেম্বর থেকে মার্চ): শীতকালে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা থাকে এবং দিনের আলো কম থাকে। তবে যারা ক্রিসমাস মার্কেট পছন্দ করেন, তারা ডিসেম্বর মাসে যেতে পারেন, যখন শহরটি ক্রিসমাসের সাজে সেজে ওঠে। কিন্তু বাঁশিওয়ালার প্রধান পরিবেশনাগুলো এই সময়ে বন্ধ থাকে।