প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ : বিশ্ব পর্যটনের নতুন গন্তব্য

বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে আজ শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ‘ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম ডে’ বা বিশ্ব পর্যটন দিবস পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর এই দিবসটি বিশ্বব্যাপী পর্যটনের গুরুত্ব এবং এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মান তুলে ধরার উদ্দেশ্যে পালিত হয়। জাতিসংঘের পর্যটন সংস্থা (ইউএনডব্লিউটিও) ১৯৮০ সাল থেকে এই দিনটি উদযাপন করছে।
পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য পর্যটকদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা রাখে। সঠিক পরিকল্পনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে এই খাত অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। তবে, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রচারণার অভাবের কারণে এই শিল্পের বিকাশ এখনো বাধাগ্রস্ত।
অজানাকে জানার ইচ্ছা ও মানুষের বিনোদনের চাহিদা মেটানোর সব উপকরণ নিয়েই গড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। পর্যটন এখন শুধু ব্যক্তির মনের আনন্দের খোরাক নয়, এটি এখন শিল্প। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অতুলনীয় এই বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাময় খাত পর্যটন। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের পর্যটন নীতিমালার আলোকে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় এই খাতের সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল হয়েছে।
পর্যটকদের অভিমত, যথাযথ বিকাশের মাধ্যমে শুধু পর্যটনশিল্প থেকেই বছরে হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারে বাংলাদেশ। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বাংলাদেশে পর্যটনশিল্প খুবই সম্ভাবনাময়। পৃথিবীর যে-কোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করার মতো সকল উপাদান বাংলাদেশে আছে।
পর্যটন ব্যবসায়ীরে সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) এবং সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ২০২০ সালে যেখানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা ছিল ১ কোটি, ২০২৩ সালে তা আড়াই কোটিরও বেশিতে দাঁড়িয়েছে। অথচ পাঁচ বছর আগেও এ সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ লাখ ছিল। আর ২০০০ সালের দিকে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৩ থেকে ৫ লাখ। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত ১৫ লাখ মানুষ। আর পরোক্ষভাবে আরও ২৩ লাখ লোক এ খাতের সঙ্গে যুক্ত। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এ খাত। আর্থিক মূল্যে দেশীয় পর্যটন খাতের আকার দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪ হাজার কোটি টাকার।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য সূত্রে জানা গেছে, দেশে ২০১৭ সালে বিদেশি নাগরিক আগমন করেছেন ৫ লাখ ৬৬৫ জন। এছাড়া ২০১৮ সালে বিদেশি নাগরিক এসেছেন ৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৩০ জন। ২০১৯ সালে বিগত ১০ বছরে সর্বোচ্চ বিদেশি নাগরিক দেশে এসেছেন ৬ লাখ ২১ হাজার ১৩১ জন। করোনা মহামারির সময় ২০২০ সাল নাগাদ বিদেশি এসেছেন ১ লাখ ৮১ হাজার ৫১৮ জন। আর ২০২১ সালে বিদেশি নাগরিক এসেছেন শুধু ১ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৬ জন।
দেশে মোট ১ হাজার ৫১টি ট্যুরিস্ট স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। আকর্ষণীয় পর্যটন খাতে যেসব উপাদান থাকা দরকার যেমন-সমুদ্র, নদী, বন, পাহাড়, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঋতুবৈচিত্র্য সবই বাংলাদেশে বিদ্যমান রয়েছে। সরকারি হিসেবে দেশের নদীর সংখ্যা রয়েছে ৩১০টি। এ ছাড়া রয়েছে অসংখ্য হাওর-বাঁওড়-বিল। আছে সুবিশাল সমুদ্রতট। দেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
পর্যটন খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পর্যটকদের পছন্দের বেড়ানোর তালিকায় এক নম্বরে আছে কক্সবাজার। পরের অবস্থানে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি। পছন্দের তালিকার তৃতীয় অবস্থানে আছে সিলেট। হজরত শাহজালাল ও শাহপরানের মাজার জিয়ারত ছাড়াও সিলেটের চা-বাগানসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গাগুলোতে যাচ্ছেন পর্যটকেরা। বেড়ানোর তালিকায় আরও আছে সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিন, পাহাড়পুর প্রভৃতি। ঘুরতে যাওয়ার জন্য ঢাকার খুব কাছে গাজীপুরের বিভিন্ন রিসোর্টও এখন বেশ জনপ্রিয়।
চট্টগ্রামের কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরের সুবিশাল জলরাশি সমৃদ্ধ বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত হিসেবে তার গৌরব আর অহংকারকে ধরে রেখেছে। পাহাড়ি ঘন সবুজের আবর্তে পরিবেষ্টিত বান্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটের সুশোভিত প্রাকৃতিক সম্ভার পর্যটন শিল্পকে নানামাত্রিকে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিচ্ছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ডের মতো শহরগুলোর প্রকৃতির অপার মাধুর্য যেমন সারা বিশ্বকে আনন্দ আর ভ্রমণের খোরাক জোগায়, সে মাত্রায় বাংলাদেশও তার নৈসর্গিক ডালি সাজিয়ে ভ্রমণবিলাসী মানুষদের মনোরঞ্জন করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না। প্রকৃতিই তার সমস্ত সৌন্দর্য আর মাধুরী অবারিত করে শ্যামল বাংলাকে বিশ্ব দরবারে দর্শনীয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে শুধু প্রকৃতির দানে ভরপুর হওয়ার চাইতেও প্রাসঙ্গিক সব সুযোগ-সুবিধাও সংশ্লিষ্টদের মাঝে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। সময়ের নিরন্তর চাহিদায় সারা বিশ্ব নিয়তই গতিশীল। তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয়ে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন এক চলমান প্রক্রিয়া। সেই পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশকেও সমান তালে এগিয়ে যাওয়া সময়ের যৌক্তিক দাবি।
লেখক: প্রাবন্ধিক