অন্যরকম রোমান্টিক উপন্যাস ‘প্রত্যাবর্তন’

Looks like you've blocked notifications!

জীবন বয়ে চলে জীবনের নিয়মে। সে জীবন-বিধানের এ পিঠটা সরলতার তো ও পিঠটা জটিলতায় পূর্ণ। আধুনিক শহুরে জীবনাচার সেই ‘কমপ্লেক্সিটি’র দিকে আমাদের নিয়ত প্রলুব্ধ করে। জটিলতার মায়াফাঁদে আমরা আটকে যাই। নাতিদীর্ঘ আয়ুষ্কালের একটা বৃহৎ অংশ ফুরিয়ে যায় নারী-পুরুষের আবেগীয় সম্পর্কের দোলাচলে। তাও আবার যৌবনে; বয়সের স্বর্ণসময়ে! তবুও কেন আমরা এ ফাঁদে পড়ি?

না-হলে যে জীবন সায়াহ্নে জীবনই আফসোস করবে—আমার জনম, মানব-জনম তো ব্যর্থ হলো!  প্রণয়ের সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের জটিলতা আছে বলেই জীবন তো এত মধুর, এত অপ্রাপ্তির মাঝে স্বল্প প্রাপ্তির উল্লাস! কবি ও কথাসাহিত্যিক নওশাদ জামিলের এক অন্যরকম রোমান্টিক উপন্যাস ‘প্রত্যাবর্তন’ পড়তে পড়তে কথাগুলো মনে পড়ল।

উপন্যাসে দেখা যায়, সম্পর্কের জটিল ঘূর্ণির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে রাহাত। যাপিত জীবনে সে সরকারি চাকুরে। জ্ঞাতব্য, এই রাহাতই উপন্যাসের কথক। তারই বয়ানে একটানা চমকিত গল্প বলে যাওয়া উপন্যাসের নাম ‘প্রত্যাবর্তন’। এই ‘গল্পের’ এলোপথ কতকটা মসৃণ, আবার কোথাও অমসৃণ। উপখ্যানের মোহে একটানা পড়ে যাওয়া, কোথাও আকস্মিক থেমে যাওয়া; ভাবান্তরের উদয়। কোথাও আবার দারুণ রোমাঞ্চে মেতে ওঠা!

আখ্যানটা শুরু হয়েছে কনে দেখার ছিমছাম আয়োজনের মধ্য দিয়ে। বিয়ের কনে বীথি। একালের সুন্দরী তন্বী অথচ প্রেমের পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত! গোটা উপন্যাসে কেবল বীথি চরিত্রে কোনো প্যাঁচ নেই। সাহিত্যের বিদগ্ধ সমালোচকের বিবেচনায়—‘ফ্ল্যাট ক্যারেক্টার’। রাহাতের সঙ্গে সংসার গড়ার সিদ্ধান্তে তার কেবল একটিই শর্ত—পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। অথচ আমরা দেখব, এই ঋজু চরিত্রটি রাহাত-হুমায়রার প্রেমের জটিলতার আবর্তে যেন বলির অর্ঘ্য। জগতের এসব সরল, অনাড়ম্বর মানুষগুলোই কেবল যাত্রা-মঞ্চের পুতুলের মতো অদৃশ্য কারিগরের খেয়ালে নাচতে থাকে। নির্ঝঞ্ঝাট একটা জীবন চেয়েছিল বীথি; অথচ তার জীবনকে তেতিয়ে তোলার অদৃশ্য নিয়ন্তা হয়ে উঠল রাহাত-হুমায়রার সম্পর্কের জটা।

উপন্যাসের আরেকটি জুটি মুনিয়া-তুহিন। কুটুম্বের সম্পর্কে তারা মাসতুতো ভাই-বোন। তাদের সম্পর্কের একটা মধ্যস্থতা আছে, অতটা জটিলতায় পৌঁছেনি। এ জুটি চরিত্র প্রত্যাবর্তনে অতটা মুখ্য নয়, বীথি-রাহাত-হুমায়রার এই ত্রিকোণ সম্পর্কের দ্বন্দ্বটা এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুঘটক মাত্র। উপন্যাসকে তারা গতি দিয়েছে।

প্রত্যাবর্তনকে রোমান্টিক উপন্যাসের বৈচিত্র্য দিয়েছে উপন্যাসের নায়িকা হুমায়রা। রাহাতের প্রাক্তন প্রেমিকা হুমায়রা এ উপন্যাসের সবচে’ সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাকে ঘিরেই এ উপন্যাসের সম্পর্কের জটিলতার আখ্যান। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, উপন্যাসের শুরুতে তার ছিটেফোঁটা পাঠক টের পাবেন না। রাহাত-বীথির বিবাহ পরবর্তী কক্সবাজারের হানিমুন-দৃশ্যপটে তার আগমন। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের বিনোদিনীর আদলে গড়া—শিক্ষিত, মার্জিত, স্মার্ট এই ভাগ্যাহত হুমায়রার জন্য বড্ড দুঃখ হয়। জীবনদেবতার সুপ্রসন্নতায় বিশ্বভুবনে কিছু মানুষ ষোলোকলায় পূর্ণতা পেয়েও জীবনকে গুছিয়ে নিতে পারে না; ভাগ্যের বিড়ম্বনায় জীবনপথে তারা কেবল পিছলে যায়। হুমায়রাও ঠিক এমনই। উপন্যাস-অন্ত্যে তার জন্য পাঠকের বড় মায়া জাগবে। হয়তো অস্ফূট স্বরে বলে উঠবে, আহারে!

একদিকে তার প্রাক্তন হুমায়রা, অন্যদিকে বধূ বীথি। এই ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক এতটা জটিলতায় পৌঁছাবে, যা পাঠককে ভাবিয়ে তুলবে রীতিমতো। এরপর কতগুলো খণ্ডগল্প ও চরিত্রের মিশেলে তরতর করে কাহিনি এগিয়েছে। তুহিন-মুনিয়া প্রেমের পূর্ণতা পেয়েছে। কিন্তু হুমায়রার স্বপ্নপুষ্প কি প্রস্ফূটিত হয়েছিল! সে কি রাহাতের জীবনে ফিরে এসেছিল! একসময় ভাববিলাসী পাঠক চাইবে, প্রাক্তনকে নিয়ে রাহাত হারিয়ে যাক; তাদের সাজানো জগতে গড়ে তুলুক টোনাটুনির আজন্মকালের লালিত সংসার। কিন্তু পাঠকের সে রোমান্টিক ভাবনায় কি ছেদ পড়বে? নাকি না?

লেখক নওশাদ যে বড়ই রিয়েলিস্টিক! সব প্রত্যাবর্তন তো ফিরে আসার গল্প নয়। ঔপন্যাসিকের গল্প বলার ভাষাটা বেশ ঝরঝরে, সুখপাঠ্য বলা চলে। পড়তে পড়তে ক্লান্তি স্পর্শ করবে বলে মনে হয় না। কোনো শব্দের অর্থানুসন্ধানে আপনাকে থমকে যেতে হয় না। অতি বর্ণনা এড়িয়ে শাখা-কাহিনি ‘স্কিপ’ করে মূল কাহিনিস্রোতে চলে যাওয়া; অথচ তা মোটেও হুমায়ূনীয় নয়। চরিত্রের সংলাপ কিংবা উপন্যাসের বর্ণনা হঠাৎ স্তব্ধ করে লেখক তার নিজের অনুভূতি, উপলব্ধির কথা বলেন। এটিই গদ্যসাহিত্যের ‘এপিগ্রাম’। গদ্যালংকারে ঠাসা ‘প্রত্যাবর্তন’-এর উদ্ধৃতিতে :

“ছাদ থেকে ঘরে আসার পর বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বীথি। চাঁদের আকর্ষণে যেমন নদী-সমুদ্রের জোয়ারের জল ফুলে ওঠে, মানুষ শরীর-মন কি তেমন উথলে ওঠে? জোয়ারের মতো তার শরীর দুলে দুলে উঠল। শরীরজুড়ে ঝড় উঠল। সে নদী-সমুদ্র পছন্দ করে। এজন্য কি তাকে জলপরি মনে হয়? ঝড়ের তোড়ে যেন ভেসে উঠল রাঙা জলপরি।”

উপন্যাসের সংলাপের ক্ষেত্রে বহুমুখিতা আছে; কিন্তু সংলাপে অতিকথার বাহুল্য নেই। প্রতিটি চরিত্রের মুখে লেখক কাঙ্ক্ষিত ভাষাটিই তুলে দিয়েছেন। গৃহকর্মী সুরাইয়ার মুখে আঞ্চলিকতা কিংবা ভবঘুরে বাউলের মুখে দার্শনিকতা শোভা পেয়েছে। নওশাদ আপনাকে ম্যাজিশিয়ানের মতো আয়োজনের শেষ অবধি ধরে রাখার কৌশল জানেন। হোক সেটা টানটান উত্তেজনায়, চমকিয়ে দিয়ে, নয়তো রতিক্রিয়ায় শৈল্পিক বর্ণনায়। পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার এই বিদ্যেটা, গদ্য-বাক্যের শিল্পটা ঔপন্যাসিক বেশ দারুণভাবে রপ্ত করেছেন। এজন্য তাঁকে সার্থক গদ্যশিল্পীর তকমা দেওয়া চলে।

‘প্রত্যাবর্তন’ কেবলই যে ঊর্ণনাভের জড়ানো জালে-বাঁধা সম্পর্ক-জটিলতার উপন্যাস, তা কিন্তু নয়। চরিত্ররা কেবল উপন্যাসের জন্য কলমে গড়া কৃত্রিম নয়, তারা আমাদের চারপাশেরই মানুষ। যাপিত জীবনে নিরন্তর ছুটে চলা শহুরে সংগ্রামী এক জনস্রোত। মানসিক দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েনের মাঝে কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখতে হয়, তারই উপলব্ধির প্রাতিস্বিক প্রকাশ ‘প্রত্যাবর্তন’। এ যে বাস্তবতার গিরিপথে নেমে জীবনবোধের প্রাথমিক পাঠ।

‘প্রত্যাবর্তন’ উপন্যাসের কিছু উক্তি

★ মানুষের ভেতর যখন দ্বিধা ঢুকে যায়, তখন সহজে তা সরানো সম্ভব নয়। দ্বিধাহীন, ভয়হীন, শঙ্কাহীন জীবন আনন্দের জীবন। এ জীবনের স্বাদ সবাই পায় না।

★ পৃথিবীকে যারা খুব সিরিয়াসভাবে নেয়, তারা অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ। সংবেদনশীল মানুষ বারবার কষ্ট পায়।

★ সুখী হওয়ার মানে হলো আমি যা চাই তা সব পাওয়া না, বরং আমার যা আছে তা সুন্দরভাবে উপভোগ করা।

★ ভালোবাসা ও প্রেম এক নয়। দুটোর মধ্যে সামান্য তফাৎ আছে। আবেগের তারতম্য আছে। সম্পর্কের মাত্রাভেদ আছে। ভালোবাসাটা সবার। প্রেমটা বিশেষের।

★ মাঝেমধ্যে মনে হয় জীবনে তিনটা কাজ খুব কঠিন। প্রথমত, একা থাকা। দ্বিতীয়ত, অপেক্ষা করা। তৃতীয়ত, ক্ষমা করা। যারা একা থাকতে পারে, অপেক্ষা করতে পারে, ক্ষমা করতে পারে, দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ তারা।

★ মাছের কাঁটা গলায় বিঁধলে হজম করা যায়, মস্তিষ্কের কোষে যদি প্রেমের স্মৃতি বিঁধে যায়, মানুষ কখনও তা দূর করতে পারে না।

★ মানুষের মস্তিষ্ক ও মন বড়ো অদ্ভুতুড়ে। মস্তিষ্ক ও মন যদি এক সুরে বেজে না ওঠে, তাহলে জীবনের লয় কেটে যায়, জীবন বেসুরো হয়ে যায়।

★ সত্যিকার প্রেম, ভালোবাসা হৃদয় থেকে যতটা সঞ্চারিত হয়, মস্তিষ্ক থেকে ততটা নয়। প্রেমের অনুভূতি হৃদয়জাত, মস্তিষ্কপ্রসূত নয়।

★ প্রেম-ভালোবাসায় সঙ্গম তো খারাপ কিছু নয়। সঙ্গম ব্যাপারটা আনন্দময় ও স্বর্গীয়। সঙ্গমকে যারা নারকীয় বানায়, মূলত তারাই ধর্ষক। বৈবাহিক সম্পর্কেও যারা সঙ্গমকে নারকীয় বানায় তারাও ধর্ষক।

★ দুনিয়ার অনেক কিছু জয় করা যায়। প্রকৃতির রহস্য জয় করার মতো বীর তেমন নেই। দিনশেষে আমরা যতটুকু চেষ্টা করি, যত দূর এগোতে পারি, আমাদেরকে প্রকৃতির হাতে পুতুল হয়ে থাকতে হয়।

★ মাতৃত্ব ছেলেরা কখনও বুঝতে পারবে না। এ ব্যাপারটা ছেলেদের বোঝার ক্ষমতা হয়তো প্রকৃতি দেয়নি। সবাই মনে করে মাতৃত্বের রূপ কোমল, নমনীয়। সত্যি কথা তা নয়। মাতৃত্ব অত্যন্ত সাহসী ও শক্তিশালী ব্যাপার।

★ ব্রেকআপ আলাদা কিছু নয়, এটা প্রেমেরই বর্ধিত অংশ। যাকে তুমি ভালোবাসো, সে জীবন থেকে যদি হারিয়ে যায়, তাকে হারানোর কষ্ট অন্য কিছু দিয়ে ভুলতে পারবে না।

প্রত্যাবর্তন

লেখক : নওশাদ জামিল

প্রকাশক : নালন্দা

পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৬৮

দাম : ২২৫ টাকা

প্রচ্ছদ : রাজীব দত্ত