এইসব প্রেম মোহ

Looks like you've blocked notifications!

সব শেষ করে এসেছে, সব। দেনা-পাওনা, হিসাব-নিকাশ, যা কিছু জড়িয়ে রাখে, বেঁধে রাখে, বন্দি করে রাখে জীবনকে। গেট খুলে বের হতে হতে তার তীব্র চাহনি তবু পিছু হানা দেয়, তীব্র কিন্তু অক্ষম অসহায়। এ ছাড়া আর কিছু করার নেই তার। ছিল না গত পাঁচ বছর, হবেও না আগামীতে। আর পারা যাচ্ছিল না। তাই সব শেষ করে দিয়ে এসেছে, সব। হিসাব-নিকাশ, দেনা-পাওনা সব। বিগত জীবনের এবং অনাগত জীবনের।

বাড়ির সামনে প্যাসেজটুকু পার হয়ে, গেট খুলে দাঁড়িয়ে থাকা উবারের গাড়িটি চোখে পড়ে সুমনার। মিষ্টি মেরুন রঙের গাড়িটা, ঝকঝকে নতুন। মুখে চরম উপেক্ষার নির্বিকারত্ব মেখে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে ড্রাইভার। ভাড়ার গাড়িতে এমন যাত্রী তার প্রতিদিন বইতে হয়। যাত্রীর মুখে ক্লান্তি-দীর্ঘশ্বাস-স্বস্তি-প্রেম ইত্যাদি পড়ার অবকাশ তাদের নেই, নেই ইচ্ছেও।

সুমনা গাড়িতে উঠে বসে। এই ভোরে আশপাশে সুনসান, মানুষ নেই। একলা একটা ঝাড়ুদার অভ্যাসের এক হাতে ঝেড়ে এক করছে আগের দিনের পরিত্যক্ত সব আবর্জনা, অন্য হাতে ময়লার ঝুড়ি, থেমে থেমে একত্র করে তুলে নিচ্ছে এতে। বিচিত্র জিনিসের স্তুপীকৃত আবর্জনা, নানা আকার-প্রকারের কাগজ, বিস্কিটের প্যাকেট, মাটিমাখা আধখাওয়া শিঙারা, সিগারেটের খালি প্যাকেট। হঠাৎ এই ভোরের নিঃসঙ্গ ঝাড়ুদার মনে হয় নিজেকে, প্রতিদিন দুহাতে সরাতে চায় জীবনের জঞ্জাল, কিন্তু আবার জমে প্রতিদিন। অদূরে ঝাঁপ তুলছে চা-পরোটার দোকান। এখানে-ওখানে ফেলে দেওয়া বাসি খাবারের কণাগুলো ঘিরে কাকেদের তুমুল হল্লাচিল্লা। রাস্তার পাশে সারি সারি ঘন গাছের ডালপাতার ফাঁক খুঁজে উঁকি দেওয়া সূর্যের প্রথম আলোটা থমকে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির ছাদে।

পিছু নেওয়া তীব্র অক্ষম অসহায় দৃষ্টিটাকে এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলে গাড়িতে উঠে বসে সুমনা। এই মোলায়েম ভোরে বাইরে খুব বেশি গরম না হলেও ভেতরে এসির তীব্র শীতটাই জুতসই মনে হয় তার। সারা গায়ে অসহ্য জ্বলুনি, দায় টেনে টেনে ক্লান্ত হওয়ার জ্বলুনি। ভেতরে জন্ম নেওয়া, পরিপুষ্ট হওয়া সংস্কার কিংবা সংস্কারজাত অপরাধবোধের জ্বলুনি। এইসব শেষ করে দেওয়া, সব, দেনা-পাওনা, হিসাব-নিকাশ সব শেষ করে দেওয়া ঠিক হলো কি? দূর ছাই, ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেয় সে, আর গাড়িটা ছাদের উপর থমকে দাঁড়িয়ে থাকা ভোরের রোদটাকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে ছুটে চলে গন্তব্যে।

গন্তব্য। গন্তব্য খুঁজতে খুঁজতে এই জীবনের ঘাট থেকে ঘাটে নোঙর। এই নোঙর কি এবার আশ্রয় দেবে, মোহে-প্রেমে, দায় আর দায়িত্বে জীবনে জড়িয়ে থাকার সব আবশ্যিকতা নিয়ে। এই জড়িয়ে থাকাও খুব আবশ্যক কি জীবনের জন্য? সারা রাতের নির্ঘুম ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসে তার। এখন এসব ভাবার অবকাশ নেই, একজোড়া চোখের তীব্র চাহনি থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নতুন গন্তব্যে সংযুক্ত করার মাঝামাঝি সময়টুকু ঘুমের কাছে সমর্পণ করলেই এই আপাত অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। প্রাণপণে চেষ্টা করে সে, ঘুমটা চোখের পাতায় স্থির হতে না হতেই ছুটে যায়। ঘুম-অঘুমের মাঝখানে এক অর্ধচৈতন্যের অবকাশ। একটা হুইল চেয়ার, সারি সারি ওষুধের বাক্স, বেডপ্যান, প্রতিদিন খাওয়ানো-পরানো, প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারানো... দায়িত্ব থেকে দায়, দায় থেকে দায়ের বোঝা, মায়াময় হাসিমুখ থেকে হাসিমুখের অভিনয়, ভালোবাসার টান থেকে ভালোবাসার পরীক্ষা... সারা রাতের ঘুমহীন উৎকণ্ঠাময় ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে আসা অসাড়তার কাছে আত্মসমর্পণ করে। তার পর চলতে থাকা গাড়ির দুপাশে সারি সারি ক্রেতা ধরার ফাঁদ, লোভনীয় বিজ্ঞাপনের বাহার। কাপড়-কসমেটিকস-মিষ্টি-ওষুধ হরেক রকম বিপণীকেন্দ্রের সারিবাঁধা সাইনবোর্ড। সামনে আটকে থাকা দমবন্ধ যানজট, হর্নের প্রতিযোগিতা আর ক্রমাগত চড়তে থাকা রোদ কিছুই আর চলমান গাড়ির নিরাপদ কাচের সুরক্ষা ভেদ করে ভেতরে প্রবিষ্ট হয়ে সুমনার অসাড় ঘুমে বিঘ্ন ঘটানোর সুযোগ পায় না।

বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ড্রাইভার ক্রমাগত হর্ন বাজাতে থাকলে ঘুম ছুটে যায় সুমনার। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, কটা বাজে ঠিকঠাক আন্দাজ করতে পারে না হঠাৎ। কোথায় সে, কেন সে, তা-ও হঠাৎ বিস্মৃত হয় কয়েক মুহূর্ত। কাঁধে ঝোলানো বাঁশিতে ফুঁ দিতে দিতে নীল ইউনিফর্ম পরা গেটম্যান যখন গেটটা খুলে দেয়, গাড়িটা ভেতরে প্রবেশ করার জন্য, সব মনে পড়ে যায় সুমনার। ভীষণ এক ঘুম ঘুমিয়েছে, ভোরের মোলায়েম রোদ থেকে এই দুপুরের তেড়ে আসা গোঁয়ার আঁচ। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর যখন-তখন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঘুম ছেড়ে উঠতে বাধ্য হওয়ার বিরক্তিহীন নির্ঝাঞ্ঝাট ঘুম। সুমনা ঘড়ি দেখে, সাড়ে বারোটা। ড্রাইভার নেমে কয়েক মিনিট ব্যয় করে রিসেপশনে। আবার এসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

থামে নির্ধারিত কটেজের সামনে। সব আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। নাদিম ঠিকঠাক করে রেখেছে। এমনই কথা ছিল। কটেজের সামনে দাঁড়িয়ে মুহূর্তেই এক অভূতপূর্ব মুগ্ধতা গ্রাস করে নেয় ক্লান্ত অবসন্নতা। নির্ঘুম রাতের ক্লান্তি, পাঁচ বছর দায় আর দায়িত্ব টেনে নেওয়ার অবসন্নতা। কটেজের ঠিক সামনে টলটলে সরোবরে নানা রঙের শাপলা, সরোবরের চারপাশ ঘিরে বিচিত্র ফুল আর পাতাবাহারের পরিকল্পিত সজ্জা। পেছনে যত দূর চোখ যায়, শালবনের গভীর জঙ্গলে এই মধ্যদুপুরে আটকেপড়া অন্ধকার। ঝালরকাটা নকশার কারুকার্যময় বারান্দায় বসে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে আয়েশে চা খেতে খেতে হাত নাড়ে নাদিম, প্রত্যুত্তরে হাত নাড়ে সুমনাও। সেই নাড়তে থাকা হাতে সব হিসাব-নিকাশ, দেনা-পাওনা, শেষ করে আসার একটা আপাত স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ঝুলে থাকে। 

ওপরে কাঠের পাটাতন, নিচে কাঠের পাঠাতন, জানালা-পর্দায় ঘেরা টেবিল ল্যাম্পের রহস্যময় আলোর কক্ষটি বেশ পছন্দ হয় সুমনার। নাদিম উষ্ণ আলিঙ্গনে অভ্যর্থনা জানায়। হালকা একটা দুটো চুমু খায় কপালে ঘাড়ে কানের লতিতে। ভালো না মন্দ বুঝে ওঠার আগেই অপেক্ষা আর অভ্যাসে মিশে যায় অনুভূতিটা। ক্যানটিনের নম্বর চেপে সুমনার জন্য চায়ের অর্ডার দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে চায় নাদিম, নিড আ শাওয়ার, আই ওয়াজ জাস্ট ওয়েটিং ফর ইউর অ্যারাইভিং। টেক রেস্ট, আই অ্যাম কামিং বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে নাদিম।

সফেদ টানটান নরম বিছানাটা দুহাতে আলিঙ্গন করতে চাইলেও অগ্রাহ্য করে বারান্দার চেয়ারটাতে বসে সে। প্রথম দর্শনে এই নিভৃত প্রকৃতি খুব আকর্ষণ করেছে তাকে। নাম জানা না জানা নানা রকম পাখির বিচিত্র ডাক, একসুরে ভেসে আসা কিছু অচেনা ঝিমমারা টান... বনজ পোকা হয়তো বা। অদ্ভুত ভালোলাগার এই নীরব প্রকৃতির গা ঘেঁষে ধীরে ধীরে দিনটার পড়ন্ত বেলার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তনমানতা মোহাবিষ্ট করে রাখে তাকে। বিয়ের পর কিছুদিন সংসারটাকে দাঁড় করানোর প্রাণপণ সংগ্রাম আর দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই একটা দুর্ঘটনায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনে প্রেম-ভালোবাসার হাত ধরে কখনও নিসর্গ-প্রকৃতির কাছাকাছি আসা হয়নি এভাবে।

না, দূর থেকে চিনতে মোটেই ভুল হচ্ছে না তার। সাদমান। তীব্র অক্ষম অসহায় দৃষ্টিটা অনুসরণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত এখানে? আশ্চর্য! সে কী করে জানল সুমনা এখানে? সুমনা তো সব শেষ করে দিয়ে এসেছে, দেনা-পাওনা, হিসাব-নিকাশ সব। চিরদিনের জন্য। তবু সাদমান এ পর্যন্ত হানা দিয়েছে! কোনও ভনিতা ছাড়াই সাদমান কথা বলে, তার তীব্র তীক্ষ্ণ অসহায় দৃষ্টিতে এখন আকুলতা। সাদমান বলে, না এভাবে আমাকে ফেলে চলে আসতে পারো না তুমি। পারো না। এ রকম তো কথা ছিল না। কথা ছিল সুখে-দুঃখে, সংকটে-বেদনায় আমরা একসাথে থাকব।

অস্বস্তি লাগে সুমনার। অনেক কিছুই কথা ছিল না। কিন্তু কথাও তো ছিল অনেক কিছু। মনের ভেতরে যার জন্য বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় বেঁচে নেই,তার সাথে কী কথা ছিল আর কী কথা ছিল না, এই অপ্রয়োজনীয় অতীত-কাসুন্দি ঘাঁটার ধৈর্য নেই মোটেই। অনেক ভেবেচিন্তেই সব হিসাব-নিকাশ, দেনা-পাওনা মিটিয়ে এসেছে সে। সাদমান নাছোড়বান্দা, তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে কোনওদিন ছেড়ে যাবে না। হাসি নয়, অট্টহাসি পায় সুমনার। ওয়াশরুমে নাদিমের কথা ভেবে চেপে যায় সে। আমার সব শূন্যতা পূরণ করে দেওয়ার কথাও তো ছিল তোমার। কিন্তু আমি কী করব, কী করবো সুমনা, সব আমার নিয়তি। সাদমানের এই করুণ আকুল দৃষ্টিটা এত কাল আটকে রেখেছে তাকে। না, মহৎ হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়। নিজের বোধে জন্ম নেওয়া এক অপার দায়। নিত্য নিজের সাথে বোঝাপড়া, যদি তার নিয়তি এমন হতো! সাদমান কী করত। এই মোহ থেকে প্রেম, প্রেম থেকে দায়িত্ব, দায়িত্ব থেকে দায়ও জন্মাতে হয় কিছু। নইলে বাঁধন কেটে যেতে পারে তুচ্ছ অজুহাতে। আত্মোপলব্ধির বিবেচনায় সবকিছুকে স্বীকার করে নিয়েই টিকে ছিল সে।

এ মুহূর্তে খুব ছোট খুব তুচ্ছ লাগে সাদমানকে, পাশের চেয়ারে বসে যখন হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিজের দুহাতে। এই ছোট হওয়া, নিজেকে তুচ্ছ করা সাদমানকে অসহ্য লাগে আজ। একদিন ক্লাসের সবচেয়ে দৃঢ় পৌরুষদীপ্ত মেধাবী ছেলেটাকে ভালোবেসে ছিল সে। সাদমান জানে, কিন্তু মানে না মানুষের আকর্ষণ সুউচ্চ পর্বত ছুঁয়ে অধরা আকাশের দিকে ধাবমান। আকর্ষণ করুণা অনুগামী হয় না। করুণায় মোহ আর তদজাত প্রেমের মৃত্যু ঘটে। এই মৃত্যুময় জীবন বেশি দিন টেনে নেওয়া যায় না। ক্লান্ত করে, হতাশ করে।

ভালোবাসা মানে কোনও এককালে দেওয়া কথা রক্ষার জন্য আজীবন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া নয়। ওয়াশরুমের দরজা খোলার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দটা বারান্দার গ্রিলে মৃদু কম্পন তুললে সাদমান উঠে দাঁড়ায়, আর বিষণ্ণতার ছায়াটুকু কোথাও ঝুলিয়ে রেখে চলে যায়। উঠে দাঁড়ায় সুমনা, নিজেরও ফ্রেশ হওয়া দরকার। দীর্ঘ পাঁচ বছরের ক্লান্তি ধুয়ে হালকা হওয়া দরকার।

তো সুমনা বিবি, শেষ পর্যন্ত পারলে। পেরে উঠলে শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে। বিছানায় গা এলাতে এলাতে প্রস্তুতি নেয় নাদিম। প্রস্তুত সুমনাও। নাদিমের বাহুডোরে খুব নিজেকে খোঁজে সেই প্রথম দিনের মতো। সেই যে ভয় আর শঙ্কার অপরিচিত শিহরণের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা। প্রথম অভিজ্ঞতার সাযুজ্য খোঁজে সে নাদিমের উষ্ণ আলিঙ্গনে, বোকামি জেনেও। নাদিমের গায়ে অচেনা গন্ধ। অনেক দিনের চেনা অভ্যাস হঠাৎ এই অচেনা গন্ধ ফিরিয়ে দিতে চায় অনীহায়। সংস্কারেও বা কিছুটা। নাদিম শক্ত বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ধরে, ঠোঁটজোড়া পুরে নেয় ঠোঁটে। আঙুল ভ্রমণ করে এলোমেলো শিহরণ বিলিয়ে বিলিয়ে। অনেক দিনের অভুক্ত শরীর একটু একটু করে জেগে উঠতে থাকে। বাধা দেওয়ার কিংবা অনভ্যাসের অনীহাটুকু হার মেনে যেতে থাকে ক্ষুধার্ত শরীরের তীব্র ডাকে। একটু একটু করে নিপুণ দক্ষ শিল্পীর মতো তুলির আঁচড় কাটে নাদিম। ঠোঁট থেকে বুক, কপাল, ঘাড়, নাভি সব একসাথে তুমুল সাড়া দিতে থাকে, একটা শরীর পুরো ছবি হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা। অনেক দিনের সুমনার একটা শুকনো খড়খড়ে জীবন কালো মেঘের প্রবল বর্ষণের সম্ভাবনায় স্নিগ্ধ হয়ে আসতে থাকে... তখন হঠাৎ নাদিমের সেলফোনটা বেজে ওঠে। ঝট করে নিজেকে সব আয়োজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নাদিম, ফোনটা হাতে নেয়, ওয়েট আমার মেয়ের ফোন। নিজেকে গুছিয়ে ফোনটা নিয়ে পেছনের দরজা খুলে বাইরে চলে যায় সে। সুমনা এক এক করে জড়ায় শরীরের বিস্রস্ত কাপড়গুলো। ছন্দটা হঠাৎ কেটে গেছে, আবার ফিরে পাওয়া মুশকিল। অপেক্ষা আর অপমৃত্যু ভীষণ ভাবে হতাশার দিকে মোড় নিতে থাকে। জেগে ওঠা শরীরের আকাঙ্ক্ষার অবসন্নতা আবার রূপ নিতে থাকে বিষণ্ণতায়। অথচ জীবন নিয়ে চরম হতাশা আর আক্ষেপ, ক্লান্তি আর একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই গন্তব্য খুঁজছিল সে। এটাই লক্ষ্য ছিল নাদিমের সাথে জড়ানোর।

ফেসবুকের বন্ধুর সাথে ম্যাসেঞ্জারে কুশল বিনিময় কখন যে এই আকর্ষণের জন্ম দেয়, আর আকর্ষণ পেরিয়ে সিদ্ধান্তের দিকেও যায়। এটা নাদিমের পরিকল্পিত কি না, নিশ্চিত করে জানে না সুমনা,  কিন্তু তারটুকু নানা ফাঁকফোঁকর প্রয়োজন গলে, বড়ই অনিবার্য। কুশল বিনিময় ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্ব বিনিময়ের দিকে এগোয়। ফোন, ভিডিও কল, বোদলেয়ার, জীবনানন্দ, বিনয় মজুমদার থেকে শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী; লোকটা দারুণ পাঠ করে সুমনার তৃষ্ণার্ত কানে... সুমনার মনে পড়তে থাকে একসময় দারুণ কবিতা পড়ত সে। আমি ভালোবাসি মেঘ... ওই চলিষ্ণু মেঘ... তার পাঠের ভরাট কণ্ঠের সুমনা পেছনের দিকে উল্টো হাঁটে স্মৃতি অভিমুখে। জীবনের আক্ষেপগুলো বিছার মতো হুল ফোঁটায় বর্তমানের এই একঘেয়ে হুইল চেয়ার ঠেলা বাস্তবতায়। একসময় দারুণ পাঠের নেশা ছিল তার, আবৃত্তিও করত বেশ। কোথায় গেল সব! নাদিম স্বপ্ন দেখায়, তুমি আবার আবৃত্তি করবে, সময় ফুরিয়ে যায়নি। সময় ফুরিয়ে যায় না। যে কোনও দিন শুরু হতে পারে স্বপ্নের মতো জীবন। বছর পনের আগের এক তৃষ্ণার্ত তরুণীকে নাদিম বাজাতে থাকে ঠিক তরুণীর ইচ্ছের মতো করেই। কত দিন এভাবে নিজেকে মেলে ধরতে ভুলে গিয়েছিল সুমনা। দুজনই বসে থাকত দুজনের অপেক্ষায়। ম্যাসেঞ্জার খুলে। সবকিছু ছাপিয়ে নিঃসঙ্গতার দুর্বহ ভার। নাদিমের ডিভোর্স হয়েছে বছর তিন। আর সুমনার জীবনসঙ্গী থাকা সত্ত্বেও একাকিত্বপীড়িত জীবন, সঙ্গী নামক দায়িত্ব টেনে টেনে বয়ে চলার একঘেয়েমি। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলেছিল। যে ফলাফল সুমনাকে এই সিদ্ধান্ত অবধি টেনে এনেছে। দ্বিধার হতাশা কাটিয়ে, যাপনের একঘেয়েমি কাটিয়ে...।

কিন্তু আজ সবকিছুর পর হঠাৎ কেটে যাওয়া ছন্দটা কাঁটার মতো বিঁধে থাকে পায়ে। সে কি সামনে এগোবে? আবার দ্বিধার একটা প্রশ্নবোধক বিশালাকার হয়ে তার সকল প্রস্তুতিজুড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। এভাবে বার বার আত্মজার ফোনের সাথে অতীত-জীবিত হয়ে বারবার মনে করিয়ে দেবে, এ তোমার দ্বিতীয় জীবন! প্রথম প্রেমের মতো, স্বপ্নের মতো, অপেক্ষার মতো, ঘোরের মতো জীবনের কোনও মূহূর্তের পুনরাবৃত্তি হয় না আর। সে প্রত্যাশার মতো বোকা নিজেকে ভাবেও না সুমনা। তবু কোথায় যেন একটা অস্বস্তি তার পথ আগলে বাধাগ্রস্ত করে।

দূর থেকে আবার সাদমানকে চোখে পড়ে। দ্রুত পায়ে আবার এ দিকে আসছে সে। এবার নিজেকে অসহায় লাগে নিজের কাছে। টানাপোড়েনের গহ্বর এত অতল গহীন হয়! বিপর্যস্ত বোধ করে সুমনা। তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উধাও হয়ে আবার সাদমানের দৃষ্টিতে নতজানুতা, কাতরতা, আমি তোমাকে কিচ্ছু দিতে পারিনি সুমনা, কিচ্ছু না। অনেক কিছুই পাওয়ার ছিল তোমার জীবনের কাছে। কী করব বলো, নিয়তি, সব নিয়তি। অসহ্য দমবন্ধ সাদমানের এই আকুতি। নিয়তি, নিয়তি তো সে মেনেই নিয়েছিল। বিয়ের পাঁচ বছর পার না হতেই দুর্ঘটনায় সাদমান পঙ্গু অচল হয়ে যাওয়ার পর শিলাবৃষ্টির মতো ক্রমাগত আঘাত করতে থাকা সংকটগুলোতে কোথাও হাল ছেড়ে দেয়নি সে। দায়িত্ব বা মায়া, কিছুরই কোনও কমতি ছিল না। দৃঢ়তার সাথে হালটুকু ধরেছে শক্ত হাতে। একটা চলমান মানুষের হঠাৎ অচল হয়ে যাওয়া, অনেক দূর যাওয়ার জীবনের স্বপ্নটার হঠাৎ থমকে পরা সে নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছিল। প্রতিদিন নিজেকে বুঝিয়েছে ভেঙে পড়লে চলবে না, হালটা ধরে রাখতে হবে। কিন্তু ক্লান্ত যাপনের পথ বেয়ে আজ নিজের ভিতরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে সুমনা কোনও ফাঁক পায় না, যে ফাঁক গলে একটুখানি অনুশোচনা জাগতে পারে সাদমানের জন্য। সব হিসাব-নিকাশ, দেনা-পাওনা শেষ করাটাকে ভুল আখ্যা দিয়ে সাদমানের জীবনে পুনরায় ফিরে যেতে পারে মায়ায়। কিছুটা করুণা যদিও বা তাতে মিশে থাকে, থাকুক না। কিন্তু কোথাও কিছুই খুঁজে পায় না সে।

দিনে দিনে সংসার আর হুইল চেয়ার ঠেলা একঘেয়ে জীবনটাকে মানসিক পীড়নের কাঁটায় যন্ত্রণাদগ্ধ করে তুলেছিল সাদমান। জীবিকার দৌড় আর রোগী পরিচর্যার বাইরে সুমনার ব্যক্তিগত কোনও সময় যাপন শেষ দিকে মেনেই নিতে পারত না সাদমান। একটুখানি বিছানায় গা এলিয়ে স্মার্টফোনে চোখ বুলাতে লাগলেই, সুমনা ওয়াশরুমে যাব, গরম লাগছে এসিটা ছেড়ে যাও... নানা তুচ্ছ প্রয়োজনে সুমনাকে ব্যতিব্যস্ত রাখাটা অভ্যাস করে ফেলেছিল সাদমান। প্রতিদিন, নিত্যদিন সাদমানের এই প্রয়োজনের অজুহাতে অপ্রয়োজনে সুমনাকে ব্যস্ত রাখা পুরোটাই সাদমানের অনিরাপত্তাজাত, বুঝেই প্রথম প্রথম বেশ গুরুত্ব দিয়েই কাজগুলো করত সুমনা। কিন্তু কত দিন দিনের ক্লান্তিজুড়ে এই অহেতুক ব্যাঘাত সহ্য করা! তার পর মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো, কথার খোঁচা। একটু বিরক্ত হওয়ার আভাস পেলেই, ও আমার প্রয়োজন তো শেষ!  আমি তো এখন বাতিলের খাতায়...। আজ এই নতজানু সাদমানের সামনে সব নিরুপায় সয়ে যাওয়া উগড়ে দিতে ইচ্ছে করে। সে যে মানুষ, নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে-সাধ-আনন্দ তারও কিছুটা আছে শেষদিকে একেবারেই অস্বীকার করছিল সাদমান। অক্ষম অসহায়ত্বের দোহাই দিয়ে একদা ভালোবাসা আর আইনি কাবিনের বিনিময়ে অধিকার জারি রাখতে চেয়েছিল। সাদমান স্বীকার করতে চাইত না এই মায়া কিংবা অধিকার জোর করে জারি রাখা যায় না।

সাদমান চলে গেছে। নাদিম  বাইরে এসে চেয়ার টেনে বসে, রিসোর্টটা দারুণ, কী বলো! সুমনার ছন্দকাটা বিষণ্ণতায় কোনও মনোযোগই দেয় না নাদিম। বলতে থাকে, আশ্চর্য ঢাকার এত কাছে এত সুন্দর একটা রিসোর্ট আছে জানতামই না। মেয়েটা তো শুনে খেপেখুপে অস্থির। ওকে নিয়ে আসতে হবে নেক্সট... বুঝেছ? আনমনে নাদিমের বলে যাওয়া কথাগুলো কোথায় কোথায় কী ভেঙেচুরে দিচ্ছে আঁচই করতে পারে না নাদিম। সুমনা তার দুপাশে দুজনকে দেখে, নাদিম—প্রেমিকার সাথে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে এসে যার হৃদয় টনটন করছে অপত্যে, সাদমান—দুর্ঘটনা যাকে শারীরিকভাবে অচল করে দিয়েছে অথচ মানসিকভাবে তা মানতে না পারার জটিলতা সুমনাকে ক্রমে মুক্তিপ্রত্যাশী করে তুলেছে।

ভোর ফুঁড়ে তেড়ে আসা আলো এখন শালবনের গভীর জড়াজড়ি করা ডালপাতা ডিঙিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতিতে মগ্ন। সাদমানের ফেলে যাওয়া ছায়ার দিকে তাকিয়ে নিজেকে যতটা অসুখী বোধ হয় নিজেকে, নাদিমের আনমনা উদাস পিছুটানমুখী দৃষ্টিটা ততটাই অসুখী করে। এক অস্থিরতার বন্ধন থেকে আরেক অস্থিরতার বন্ধন। না, মুক্তি চায় তার। মুক্তি চাই...।

সুমনার সিদ্ধান্তে চমকে যায় নাদিম, আজ রাতটা থেকে যাও। বিশ হাজার টাকা ভাড়া একদিনের। ভেতরে দুলতে থাকা দোদুল্যমান দোলকটা স্থির হয়ে যায় এবার। নাদিমের এই টাকার অংকটার উল্লেখ নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট করে দেয় সুমনাকে। অন্য কোনও কারণই পেল না সে সুমনাকে রাতটা আটকানোর? কেবল টাকার অংকটা উল্লেখ ছাড়া? অথচ সে তো সব শেষ করে এসেছিল, সব হিসাব-নিকাশ, দেনা-পাওনা, সব।

হ্যাঁ, তাই তো;  সে তো সব শেষ করে এসেছে, সব হিসাব-নিকাশ, দেনা-পাওনা। কোথায় ফিরবে সে? হুইল চেয়ারে বসে থাকা সাদমানকে ঠেলে ঠেলে জীবন কাটানোর অভ্যাসকে সে নিজ হাতে শেষ করে দিয়ে এসেছে। প্রতিদিনের অভ্যাসমতোই সুমনার দেওয়া ওষুধগুলো হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে খেয়ে ফেলেছে। টেরও পায়নি এগুলো একগাদা ঘুমের ট্যাবলেট। নিষ্প্রাণ হওয়া নিশ্চিত হতে সারা রাত অপেক্ষা করেছে। এতক্ষণে হয়তো পচন ধরেছে পেশিতে।

এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে সে? এত কিছু ভাবার সময় নেই, মুক্তি চায় সুমনার। সন্ধ্যার পোঁচপোঁচ অন্ধকার ঘন হয়ে জমাট বাঁধার আগেই, মোবাইল আ্যপসে উবার গাড়ি ডেকে আবার উঠে পড়ে রিসোর্ট ছেড়ে।