কবিতার স্বর্গাদপী গরীয়সী পথ

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : লেখক

আমার কবিতার প্রতিটি শব্দ আমার জীবননিঃসৃত মর্মের প্রতিশব্দ। কবিতা লেখার শুরু থেকে এই বোধ নিয়েই এই মার্গে হাঁটছি আজও। অন্তহীন এই পথচলায় হৃদয়ের ভেতর থেকে যে-বারতা পাই, তা উদ্দীপক, আনন্দদায়ক আর প্রলুব্ধকর। শব্দের ভেতর পৃথিবীর প্রতিটি নগরের, প্রত্যেক মফস্বলের, মফস্বলের ভেতরের মানুষের, তাদের আচরিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক রঙের আভাস পেয়ে আমি তা জড়ো করি আমার কবিতার একান্ত বাক্সে। এ এক জৌলুশময় উৎসব বটে। শব্দের সঙ্গে শব্দের, দৃশ্যের সঙ্গে দৃশ্যের, রঙের সঙ্গে রঙের, আসমানের সঙ্গে জমিনের, অরণ্যের সঙ্গে পবনের, পরম্পরার সঙ্গে বহুদূর পরম্পরার। সর্বোপরি, পৃথিবীর সকল প্রান্তের মানুষের সঙ্গে মানুষের জানাশোনা আর বোঝাপড়ার।

আমি আমার কবিতারচয়িতা সত্তাকে বলি, মরজীবনে এ অনন্ত স্বর্গযাত্রার পথের স্বাদ আর আনন্দ নেই কোথাও। এই রঙিন, শব্দ ও ছন্দ-মর্মরিত ভুবনে প্রবিষ্ট হওয়া গেলে সামগ্রিক জীবনযাপনে জগতের ধর্মবর্ণগোত্রসহ সকল সংস্কৃতি ও সভ্যতা একটি অপার বিচ্ছুরণময় সোনালি সুতোয় দুলতে থাকে অনুক্ষণ, অভিবাদনের মুদ্রায়। আর ওসবের বিভিন্ন আহ্লাদী আচরণ ও আমন্ত্রণে চিরসুখিজনের তকমা মেলে অনায়াসে। তাই এই পথ স্বর্গাদপী গরীয়সী। এ পথে কোনো যতিচিহ্ন নেই। শুধু কখনো-সখনো বিত্তশালীদের মতো লোক ডেকে মেজবান খাওয়ানোর মতো গদ্যের গরম মশলা পরিবেশনে কিঞ্চিৎ দায়িত্ববান হতে হয়। রাঁধতে জানতে হয় চলতি গদ্যের চচ্চড়িও। সাহিত্যলোকে এও এক খেলাই বটে। যেন ‘যুক্ত কর হে সবার সঙ্গে’।

আসলে বলতে চাচ্ছি, কবিতা কেন লিখি, এর কোনো টেকসই-যুৎসই গদ্যভাষ্য নেই আদতে। যদি-বা সেই প্রয়াস চালিয়েও যাই, বা চালিয়ে যায় কেউ, তাও কবিতারই আরেক কিসিমের গতরই শুধু খাড়া করে দেবে পাঠক সমীপে, অজান্তে। তাতেও কি কবিতার জন্যে ব্যয় করা উল্লাস, উন্মাদনা, উত্থাপন, উদ্ভাসন, উপোসযাপন, উদার-উদাস ও উপযাচক হওয়া, উদ্বাহু নৃত্যের ভঙ্গিমায় নিত্য সচল থাকা—এসব খোলসা হবে যথাযথ মাত্রায়? যদি তাই-ই হতো, তবে এই কবিতা কেন আর? সাহিত্যের এই কুলীন মাধ্যমটির আলাদা ঘরানা কেন তবে বিশ্বজুড়ে? কবিতা তো ষোলআনা কবিতাতেই নিহিত। যেমন গোলাপের নির্যাস কেবল গোলাপেই লভ্য। তাকে বৃন্তচ্যুত করে, পাপড়িসমূহ কসাই-চামারের মতো অপহরণ করে সেই নির্যাস নিতে হবে, এমন হন্তারক-কথা তো নেই কোথাও! তার পরও অপার কৌতূহলী বিদ্বৎসমাজ কবিকে নানাভাবে, নানা কৌণিক পরিমাপে ঝাড়াই-বাছাই করতে খুবই উৎসাহবোধ করেন যুগে-যুগে। তারা সমঝদারিত্বের নিরব আলখাল্লার নিচে ঢাকা থাকতে গররাজি বরাবরই। জগতের সার্বিক রহস্য উন্মোচনে তাদের দিগ্বিদিক গমনাগমনে তারা বহুদর্শী, বহুভাষী আর বহুরঙ্গী থাকতে চান। কবিকে ঘেঁটে, ছুঁয়ে-ছেনে তারা তো আসলে সময়ের সৌন্দর্যের দীপ্তিকেই ছড়িয়ে দিতে চান বিস্তৃত পরিসরে, যদি সেই তাগত থাকে ওই কবির! এটুকু মালুম করতে পারাটাও কবির আক্কেলের বড়াই বইকি।

তাই নিজের কাব্যবোধ ও কাব্য-অভীপ্সা কবিকে বয়ান করতে হয় সারস্বত সমাজের এজলাসে। এ বয়ান সুসংবদ্ধ,  বেশুমার টীকা-টিপ্পুনীযুক্ত হতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতাও নেই। আবার ওটাকে এড়িয়ে-এড়িয়ে কেবলি নীরবছবি হয়ে থাকারও যুক্তি নেই কোনো। তাই বুঝি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলতে হয়েছিল সঠিক অনুধাবনায় : ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক...’। মননশীল মানুষেরা এতে তৃপ্ত হলেন। কবি ও কবিতার দুর্বার রথ এগিয়ে চলল বন-বাদাড় পেরিয়ে, ব্রহ্মাণ্ড ভেদ করে ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে’...

বস্তুত আমার এ পর্যন্ত রচিত কবিতাগুলো নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য সর্বজন সমুখে একেবারে খোলতাই রূপে হাজির করতে বেশ আয়াসই বোধ করছি। এ তো ঠিক, কবিতার মহাসংসক্তির রাজপথে চলতে-চলতে কণ্টকিত হয়েছি হাজারবার। কতবার ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে তা লালাভ করেছে পরিপাশকে। সহজলভ্য লতাগুল্মের মমতার ব্যান্ডেজে তা ধারণ করে আছি অহরহ উৎকণ্ঠায়।

কেননা তার পরও তো চলতে হবে। ভাসতে হবে। উড়তে হবে। ডুবতে হবে অনন্ত মাথুরে। আবার উত্থিত হতে হবে মহা কবিসম্মেলনে। পুনরুত্থিত হবার সেই মহা ময়দানেও আমি তো আওড়াবো কবিতাই। আমার ভাষায়, বাংলায়। হে দয়াময়, জগতে ভূমিষ্ঠ হবার পর কবিতার ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা তো শেখাওনি আমাকে...