জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাতা নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন

Looks like you've blocked notifications!

শ্রেষ্ঠ বাঙালি মনীষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-উত্তর বাংলা নাটকের ইতিহাসে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সর্বোৎকৃষ্ট নিরীক্ষাধর্মী নাট্যকার নিঃসন্দেহে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। নাট্যরচনা কিংবা নাট্যবিষয়ক তৃণমূল গবেষণা তাঁর নিরীক্ষাধর্মী সৃজনশীল বৈশিষ্ট্যকে করে তুলেছে অনন্য ও অসাধারণ।

মানবের প্রত্নবৈশিষ্ট্যের তৃণমূল নিরীক্ষায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে স্বসৃষ্ট নাট্য রচনার বিষয় ও আঙ্গিককে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিজে অতিক্রম করে বাংলা নাটককে এমন এক সমুন্নতিদান করেছেন যে, বাংলা নাটক খুঁজে পেয়েছে তার হাজার বছরের ঐতিহ্যিক কৌলিন্য ও শিকড় সন্ধানী পরিচয়। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ-ইংরেজ কর্তৃক মধ্যখণ্ডনোত্তর উপপ্লব দ্বারা বাঙালির নাট্যপরিচয়হীনতার যে বিষাদকলঙ্ক তৈরি হয়েছিল তা থেকে বের করে এনে বাঙালির নিজস্ব নাট্যপরিচয়ের এক বিভূতিপূর্ণ নন্দন ভাবনার ভুবনে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব একমাত্র একজন বাঙালিরই— তিনি একমেদ্বিতীয়ম নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন।

সেলিম আল দিন শুধু নাট্যবিষয়, নাট্যভাষা ও নাট্য-আঙ্গিককেই প্রতিষ্ঠিত করলেন না— তিনি বাংলা নাট্যের শিল্পরস পরিবেশনের এমন এক শিল্পসূত্র তুলে ধরলেন যা যেকোনো শিল্প রসপিপাসুর জন্য নির্গলিদার্থে অমৃত। অমৃত এই জন্য যে— এর মধ্যেই থাকে শিল্পের প্রাণদায়ী সমুদয় নির্যাস; সেটা আর কিছু নয়— শিল্পসূত্র 'দ্বৈতাদ্বৈতবাদ'।

‘অচিন্ত্যদ্বৈতাদ্বৈতবাদ'-এর মর্ম কথার ভেতর থেকে 'চিন্তাতীত' কিংবা 'তর্কাতীত' অথবা যুক্তির অতীত বিষয়গুলিকেই পরিহার করেছেন সেলিম আল দীন। কেননা কোনো শিল্পসূত্রই কখনো চিন্তাতীত, তর্কাতীত ও যুক্তির অতীত কোনো বিষয়কে আবরণ-আভরণ হিসেবে গ্রহণ করে তার অবয়ব তৈরি করতে পারে না।

মূলত বাংলা নাটকের এই আচার্য নাট্য নির্মাণে শিল্প-সাহিত্যের কোনো বিভাজনরেখা কিংবা শাখা-বিন্যাস রাখেননি। একটি রচনার ভেতর অখণ্ডভাবে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, আখ্যান, গদ্য-পদ্য-বর্ণনা, নাটক— এমনকি চিত্রকলা, ভাস্কর্যকলা, গীত-নৃত্য-অভিনয়সহ ইত্যাকার নানামাত্রিক আঙ্গিকের সুস্পষ্ট উপস্থিতি তাঁর প্রবর্তিত 'দ্বৈতাদ্বৈতবাদী' শিল্পতত্ত্বের মূল বিষয়।

বাংলা নাটকের দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় তিনিই প্রথম ভেঙে দিলেন পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত শিল্প-সাহিত্যের এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভাজননীতি— উপেক্ষা করলেন দুই'শ বছর ধরে চলা ঔপনিবেশিক আত্তীকরণকৃত পঞ্চাঙ্করীতি। 

তিনি তাঁর প্রাচ্যের শিল্পরুচি অনুযায়ী শুধু যে নাট্যে অঙ্ক-বিভাজনই পরিহার করলেন তাই নয়— একই সঙ্গে ঔপনিবেশিক প্রসিমিয়াম মঞ্চকেও পরিহার করলেন; তৎপরিবর্তে গ্রহণ করলেন বাঙালির চিরায়ত সাবলীল ভূমিসমতল পরিবেশনারীতির অবাধ ও উন্মুক্ত চৌকোনা খোলামঞ্চ। দুইশত বছরের ব্রিটিশ-ইংরেজ তথা ঔপনিবেশিক প্রসেনিয়াম কাঠামোর সীমাবদ্ধ মঞ্চ বাঙালি দর্শককুলকে বাধাহীন গৃহীত রসাস্বদনের পরিবেশন-মঞ্চ থেকে যতটুকু বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল; তা থেকে তিনি চৌকোনা খোলামঞ্চের রসাস্বাদনে সমবেত দর্শকজনকে আবার এক ও অভিন্ন করে তোলার প্রয়াস পেলেন।

অকস্মাৎ উপপ্লব দ্বারা বিখণ্ডিত ঔপনিবেশিকোত্তকালের হৃৎ-মঞ্চ ও বর্ণনাত্মক বাংলা নাট্যাভিনয়রীতির চিরায়ত পরিবেশনারীতিকে পুনরুদ্ধার করে আধুনিক নাট্যমঞ্চকে করে তুললেন এক ও অভিন্ন প্রাচ্যশিল্পের অবাধ পরিবেশনা ও সমবেত শিল্পরসপীপাসুজনের নিরবচ্ছিন্ন রসাস্বাধনের পরিতৃপ্ত-আধার।

একদিকে সেলিম আল দীন-এর রচনার অঙ্ক-বিভাজনরীতির ভেদলুপ্ত; অন্যদিকে বর্ণনাত্মক নাট্যাভিনয়রীতির মধ্য দিয়ে কথানাট্যের প্রচলন অর্থাৎ কথার মাধ্যমে নাট্য শাসন করার যে অভূতপূর্ব প্রক্রিয়া প্রয়োগের প্রয়াস পেলেন তিনি তাতে তাঁর এক-একটি নাটক হয়ে উঠলো ধ্রুপদী মহাকাব্যিক বাস্তবতার অংশ বা এপিক রিয়ালিজম। মহাকাব্যিক বাস্তবতার বিশালতায় নিরন্তর সংগ্রামী বাঙালি জীবনের অনালোকিত আখ্যান ও কথকতাকে এক পরিমিত গীতল দৃশ্যকাব্যে বর্ণনা ও সংলাপের পানসিতে আহরণ করিয়ে নৃত্যগীতাভিনয়ের এক অদ্বৈত পরিশীলনের মাধ্যমে উপস্থাপন করলেন। প্রমিত ভাষা ব্যতিরেকে একান্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক কথ্যভাষাও কী করে সেলিম আল দীন-এর সংলাপ ও বর্ণনায় মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায় সমুন্নতি অর্জন করলো— তা এক আশ্চর্য দৃষ্টান্তের আধার বইকি! শকুন্তলা, কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই থেকে শুরু করে চাকা, যৈবতী কন্যার মন, হরগজ, একটি মারমা রূপকথা, বনপাংশুল, পুত্র, নিমজ্জন, স্বপ্বরমণীগণ, ঊষা উৎসব, ধাবমান, স্বর্ণবোয়ালসহ প্রভৃতি মঞ্চনাটকে উল্লিখিত প্রমাণ সাপেক্ষ সহজলভ্যতায় ধরা দেয়।

উল্লিখিত এসব নাটকের উন্মুক্ত ও বহিরাঙ্গন পরিবেশনা ও অভিনয়রীতির পাশাপাশি একই সঙ্গে নাট্যের পাত্রপাত্রীর মুখের বর্ণনা ও সংলাপ তথা নাট্যের পরিভাষা নির্মাণেও সেলিম আল দীন এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। এটা বাংলা নাটকের এ নব ইতিহাস রচয়িতার এক প্রবল বিদ্রোহী চেতনার দারুণ উত্তুঙ্গ পরিচয়। এদেশের প্রকৃতি ও অন্ন-জলে লালিত লৌকিক জীবনের আখ্যান ও কথকতাকে একান্ত দেশীয় আবরণ-আভরণের রূপ-কাঠামোতে অর্থাৎ ভাষা ও লৌকিক আচারসর্বস্ব যাপিত জীবনের মূল অবয়বে সাজাতে না পারলে বাঙালি কখনোই তার মৌলিক পরিচয়ের নিজস্ব সংস্কৃতিতে দাঁড়াতে সক্ষম হবে না। সংগত কারণেই বাঙালির নাট্য পরিবেশনে এক অপরিহার্য-দার্ঢ্যতায় সেলিম আল দীন তীব্রভাবে প্রয়োজন অনুভব করলেন জাতীয় নাট্য আঙ্গিকের। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ভূখণ্ডের বিশাল জনগোষ্ঠীর যেখানে জাতীয় পতাকা রয়েছে— রয়েছে জাতীয় ফুল, জাতীয় ফল, জাতীয় পাখি, জাতীয় সংগীত, জাতীয় কবিসহ ইত্যাকার জাতীয় নামাঙ্কিত অনেক স্মৃতিস্মারক পরিচয়— সেখানে নেই কেবল শিল্প তথা নাট্য পরিবেশনের জন্য কোনো জাতীয় আঙ্গিক।

সেলিম অনুভব করলেন বাঙালি যতক্ষণ পর্যন্ত না শিল্পে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে ততক্ষণ পর্যন্ত একদিকে যেমন তার নিজস্ব পরিচয়ে সে উদ্ভাসিত হবে না— ঠিক একই সঙ্গে বহির্বিশ্বের সমৃদ্ধ ও উন্নত জাতিগোষ্ঠীগুলোও বাঙালিকে গ্রহণ করবে না— অন্তত শিল্পের নিজস্ব আঙ্গিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে তিনি বাঙালির তাবৎ জীবনাচার মন্থনকৃত একজন শ্রেষ্ঠ মনীষা হিসেবে যথার্থই বলেন— 'আমরা ঘরের হতে পারিনি পরের দুরাশায়; আর পর আমাদের গ্রহণ করে না আমরা ঘরের নই বলে।'

বাঙালির সমুদয় জীবনবোধকে বিশ্বশিল্প পরিচয়ের গগনবিস্তারি মর্মমূলে স্থাপন করতে কী অসাধারণ এ তত্ত্বকথা। বাঙালি সংস্কৃতির আদিঅন্ত লৌকিক শিল্পমন্থনে এমন শিল্পসমুন্নতি যিনি তাঁর বোধে ধারণ করবেন— তিনিই তো প্রয়াসী হবেন জাতীয় নাট্যাঙ্গিক নির্মাণে।

বলাবাহুল্য, সহস্র বছরের নাট্য-ঐতিহ্যের ধারায় বর্তমানকে অনুসন্ধান করতে গেলে জাতীয় নাট্য-আঙ্গিক নির্মাণের প্রয়োজনীয়তাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। বাংলা নাটকের সুদীর্ঘকালের মূলানুসন্ধানোত্তর এই শিল্পচিন্তা ও প্রয়োগে উত্তীর্ণ হলেন যে— আবহমান বাংলা নাট্যরীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এর বর্ণনাধর্মিতা— বর্ণনার প্রয়োজনেই সেখানে সংলাপের আগমন ঘটবে এবং নাট্যক্রিয়ায় যুক্ত হবে এক অমৃত শিল্প-অবিমিশ্রণ— কাব্য, গল্প, উপন্যাস, আখ্যান, গদ্য-পদ্য-বর্ণনা, উক্তি-প্রত্যুক্তি— এমনকি চিত্রকলা, ভাস্কর্যকলা, গীত-নৃত্য-অভিনয়সহ বাঙালি শিল্পাচারের নানামাত্রিক উৎকৃষ্ট আয়োজন।

আর কথার শাসনে যে নাট্য সেই কথানাট্যের মোড়কে এভাবেই শতভাগ বাঙালিয়ানায় তৈরি হয়ে ওঠবে জাতীয় নাট্যাঙ্গিক— যেখানে নিরঙ্কুশ রসপিপাসু বাঙালি গৌড়জনেরা সিক্ত হবে দ্বৈতাদ্বৈতবাদের এক উত্তুঙ্গ ভাববিমক্ষণে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী।