জুয়েল মাজহারের স্বনির্বাচিত ৫ কবিতা
দিওয়ানা জিকির
আমারে পড়বো মনে, জানি তুমি, ডাকবা আমায়
খাড়া-সোজা-উপ্তা হয়া দিওয়ানা জিকিরে অবিরাম;
বাঁশের ঝিংলা দিয়া, জালিবেত-সুন্ধিবেত দিয়া
কানমলা দিয়া মোরে আর কতো করবা প্রহার।
আমি এর প্রতিশোধ নিব ঠিক। খাল-বিল-নদীনালা বাইদ
পার হয়া চলে যাব একশো ক্রোশ দূরে একদিন।
যেন, কনফুসিয়াসের স্বপ্নে বিভোর কোনো চীনা
সারাদিন একা একা খালেবিলে কিস্তি ভাসায়
২
ডাকবা আমারে তুমি লুকায়া লুকায়া একদিন!
যেন এক ভেকশিশু, হাইঞ্জাকালে কচুর বাগানে
ডর পায়া, চিল্লায়া, মায়েরে একলা তার ডাকে।
যেমতি বাদলা দিনে পাইতা মোরে হাকালুকি হাওরে হাওরে
সাড়া তবু পাইবা না। যেনো বোবা কালেঙ্গাপাহাড়
চুপ মাইরা বইসা রবো; আর দেখব তোমার জিল্লতি
যতো জোরে ডাক পাড়ো কোনোদিন পাবা না আমায়।
লক্ষ ক্রোশ দূরে গিয়া তোমা হতে থাকব স্বাধীন!
খেলব, খেলার ছলে একা বসে তাস সারাদিন।
৩
আমারে খুঁজবা তুমি হবিগঞ্জে, তেকোনা পুকুরপাড়ে,
মিরাশির মাঠে আর উমেদনগরে,
করবা তালাস চুপে পুরান মুন্সেফি আর বগলা বাজারে।
দুই হাত উঁচা কইরা হাঁক দিবা যেন ক্যানভাসার:
চিফ রেইট,
দুই টেকা,
হলুদি ব্যাটাটা!
৪
বেফিকির উড়াধুড়া আমি এক ফকিন্নির পোলা
আন্ধা-কানা ঘুইরা মরি লালনীল স্মৃতির বাগানে;
চান্নি-পশর রাইতে জারুলের নিচে বেশুমার,
আবালের সর্দি যেন অবিরাম ফুল ঝরে পড়ে
৫
মগরা নদীতে আর লাফুনিয়া-কইজুরি বিলে
তোমার নাকের মতো বেঁকা ঘোলা জলে নাও লয়া,
মনভরা গোস্বা লয়া, পেটভরা ভুক লয়া আমি
অলম্ভুত কালা বাইদে ভাইসা রবো একলা স্বাধীন।
যেন আমি বাচ্চা এক উদ
খিদা লাগলে উপ্তা ডুবে আচানক কালবাউস ধরে
কুশার-খেতের ভিত্রে বইসা খাব ফুর্তি লয়া মনে;
৬
আসমানে লেঞ্জাহাঁস উইড়া চলে হাজারে-বিজারে
চিতলের পেটি যেন কলকলাবে সামনে ধনুগাঙ;
তার বুকে ঝাঁপ দিব, করবো আমি সেখানে সিনান
৭
আমারে না পায়া যদি নিজের জাগ্না চউখে মাখো তুমি নিদ্রাকুসুম,
আমি তবে পুটকিছিলা বান্দরের মতো
বসে রবো চুপচাপ
বদ্যিরাজ
গাছের
আগায়!
ডায়েরির উল্টো পৃষ্ঠায়
একটা ডুবোজাহাজ শত্রুর নজর এড়িয়ে ধীরে
ডুব দিল সাগরের অতল গভীরে
নাবিকেরা অবসন্ন। তাদের ঘুমের প্রয়োজন
জলের অলস দোলা, নৈঃশব্দ্যের নিজস্ব গুঞ্জন আর রঙিন
মাছেদের আনাগোনার ভেতর ঘুমে-ভারী, নিকষ আকুয়া-রাত
ধীরে ধীরে গিলে নিল টাইটানিয়াম-মোড়কে ঢাকা ধাতব তিমিটিকে;
প্রখর গ্রীষ্ম-জানালার ওপাশে তুমিও ঘুমাতে গেলে বিবসনা
রক্তে অল্প মধুমেহ, রক্তে অল্প রতিক্ষুধা নিয়ে
অপর গোলার্ধে, ধরো, ডায়েরির অপর পৃষ্ঠায়
শ্বেত-হিম রাত্রির ভেতরে জ্বলছে তাপহীন প্রকাণ্ড জড়ুল
বহুবার মনে-উঁকি-দেওয়া ড্রিমবল যেন
যেন আকাশে পেরেক দিয়ে গাঁথা;
নড়ছে না একটিবারও;
রাত্রির তৃতীয় প্রহর অব্দি লটকে আছে
মূর্তির গ্রীবার মতন স্থির হয়ে আছে
কেউ একে লাথি মেরে মেরে না সরালে
নর্স দেবতার হিমজমাট অণ্ডের মতো
মেরুবৃত্তটির উপরে কেয়ামত অব্দি থেকে যাবে এভাবেই
মনে হলো, থাক তবে বরফমণ্ডিত আর শান্ত-অনড় হয়ে থাক
মেরু সাগরের পার্মা ফ্রস্ট ভেদ করে এরইমধ্যে উঁকি দিল
একটা শক্ত মিশকালো কোনিং টাওয়ার
ঘুমের ভেতর কেবলই বরফের চাঙড় ভাঙছে
সারা গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে শাদা শাদা রেণু ও পরাগ
আর শুধু অবিরাম উৎক্ষেপ, আক্ষেপ
অবিরাম আহ আহ আহ
অবিরাম অব্যয়, অব্যয়!
এই প্রান্তে গ্রীষ্মবগল থেকে ছড়িয়ে পড়ছে তীব্র ঝাঁজালো ঘ্রাণ
সে-আরকে মত্ত হয়ে সলোম ঈশ্বরী তুমি শুরু করলে নাচ
হঠাৎ তোমার নাচ ঘুরে গেল কাগজের অপর পৃষ্ঠায়
মেরুরাত্রির ভেতরে এক সমুত্থিত মাংসের বুরুজ আঁকা হলো
তাতে তুমি আন্দোলিত, শীৎকৃত, বিদ্ধ আর তীব্র সমাসীন
আরোহণ
রাত্রিকাল। পাহাড়ে উঠছি একা
কাছেপিঠে আর কেউ নেই;
এখানে পাথরগুলো কী নরম স্পঞ্জে বানানো!
সেদ্ধ ডিমের মতো, ডাঁসা ও বর্তুল;
#
তাতে আমি টের পাই আঁচ। টের পাই
অপার্থিব দোলা ও স্পন্দন।
#
এদেরই দুটোকে আমি আঁকড়ে ধরে পর্বতের গাত্র বেয়ে উঠি;
এ ছাড়া আমার যেন কাজ নেই তীর্থ নেই মোক্ষ নেই কোনো
#
পার্বত্য এলাকা বড়ো বিপদসঙ্কুল। তবু,
আরোহীমাত্রই জানে ভয় পেলে চলবে না
#
ঝড়-ঝঞ্ঝা, হাওয়ার চাবুক সয়ে তাকে তার মোক্ষে যেতে হবে
অনেক-অনেক চূড়া জয় করে যেতে হবে কাঞ্চনজঙ্ঘায়
#
আরোহণ শেষ হলে তৃপ্ত সুখী জয়ী সে-আরোহী
সাবধানে নেমে আসবে নিচে। তারপর
#
কামিনীফুলের ঘ্রাণ বুকে নিয়ে ভেসে যাবে প্রস্রবণে
—আরো দূরে তপ্ত, গাঢ় লবণ-সাগরে।
ইতিহাসের বই
এক হাতে ফুল ও মরিচা
অন্য হাতে মৃত কৃকলাস
তোমার দুয়ারে রোজ ছায়া হয়ে, উবু হয়ে আসি
নদীর খাঁড়ির কাছে দলছুট বসে
কয়েকটি শিশুমেঘ, পরিশ্রান্ত-ক্ষীণতনু মেঘ
নিজেদের নাট-বল্টু খোলে আর জোড়া দিয়ে চলে
হাই তোলে। ঘড়ি দ্যাখে। হোসপাইপে হালকা মরিচা
ঘষে ঘষে তুলে ফ্যালে তারা;
আর একটু দূরে বসে
একটি কিশোরী-মেঘ ভাইটির জামা
ধীরে ধীরে রিফু করে ভাসমান সেলাইমেশিনে
অপলক চোখ মেলে
শান্ত হয়ে দ্যাখে গোল চাঁদ!
ধীরগামী, স্বচ্ছতোয়া এইসব নদীর কিনারে
কোলে নিয়ে মৃত কৃকলাস
সপ্তপর্ণ গাছ বেয়ে একা আমি,
দমে দমে উঠবো শিখরে। তবু যদি
রেখে আসা যায় ওকে—চুপে
শূন্যে শয্যা পেতে হাওয়ার রোদনে
খাঁড়ির আড়ালে বসে এভাবেই
ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলের মদ তুমি পেয়ে যাবে
ইতিহাস-বইয়ের পাতায়।
ধুতুরাগোধূলি
এখন সকাল খুব লাল। তবু হৃদয়ে গোধূলি। আমি সদ্য বানানো নৌকার খোলের ভেতর শুয়ে;
নৌকার একা-কারিগর
গাবের আঠার গন্ধে, তারপিনের গন্ধে নাক ভরে আছে।
ছুতোরের ছদ্মবেশে একদিন ঢুকে পড়েছিলাম এই জেলেপাড়ায়। তারপর থেকে তৈরি করে চলেছি নৌকা। উত্তল, অবতল নৌকা। সমুদ্রের ছোবলে জেলেপাড়ার মরদেরা সবাই একে-একে চলে গেছে ঢেউয়ের অতলে। এখন নৌকার মতো কাত হয়ে আছে জেলেপাড়া
সদ্যবিধবাদের সারি সারি ঝুপড়িঘর বিষণ্ণতায় ঠাসা
এখানে ভোর আর বিকেলের একটাই নাম—গোধূলি!
একা এক ঘেয়ো কুকুরের কান্নায় ভরে আছে আমার দু-কান
যে ঝুপড়িতেই আমি ঢুকতে চেয়েছি
বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রকাণ্ড এক মাকড়জাল।
মাকড়েরা আমাকে না দিয়েছে একাকিত্ব ঘোচাতে,
না দিয়েছে জেলেপাড়ার নম্র বিধবাদের বিষণ্ণতার গাদ সরাতে
প্রতিবারই উঁচিয়ে ধরেছে নিষেধের লাল তর্জনী
এবার রাগী বেড়ালের মতো নিজের ভেতরের মাকড়জাল ছিঁড়ে ফেলতে চাইছি আমি।
ফরশা হয়ে উঠছে আমার চোখ। বিধবাদের কামনাতুর দেহে জ্বলে উঠছে ফসফরাস।
আর সমুদ্র ঝিলকে উঠছে মাছের পেটির মতো।
ওই তো মরীচিকার ভেতরে পেখম তুলছে বিধবাদের ময়ূর
আমার পা টলছে ধুতুরার নেশায়। একটি একক মুহূর্তকে আমি সকাল ও গোধূলি
বানিয়ে ধরে আছি দু-হাতের মুঠোতে। এ-খেলা আমি অসংখ্য একা—আমিকে দেখাই বারবার।
একটা সরু দড়ির উপর দিয়ে একা—পিঁপড়ে হয়ে হেঁটে চলেছি
ধোঁয়ায় মোড়ানো আবছায়া এক বাড়ির দিকে।
আমার পাশাপাশি নতমুখ হেঁটে চলেছে ২০ বছরের পেনিলোপিহীন নৈশাঘাতে বিবর্ণ এক একা-ইউলিসিস। ছিন্নবস্ত্র ভিখিরির বেশে। শূকরপালক আর ছাগপালকের অবজ্ঞার ভেতর দিয়ে।
একবার সে আমার ছায়ার ভেতর ঢুকে পড়ছে
পরক্ষণে আমি তার ছায়ার ভেতরে
লাল সকালের ভেতর দিয়ে
আমরা বয়ে নিয়ে চলেছি গোধূলি
সব বিষণ্ণ লাল সকালই সব একা—মানুষের গোধূলি
সামান্য ভাতপচানো মদ আর ধুতুরার ভেতর থেকে
উঁকি দিচ্ছে সদ্যবিধবাদের স্পর্শ ও চুম্বন
ধূসরতার ভেতর রাংতার ঝিলিক
হঠাৎই হেসে উঠছে, গান গেয়ে উঠছে একা—একা মানুষেরা
তাদের তীব্র স্বমেহনের ভেতর ফেটে পড়ছে
শত-শত অসহ্য কামারশালা
মাকড়জাল সরিয়ে কামনাতুর বিধবারা আমাকে ডাকছে
তারা ময়ূর ছেড়ে দিয়েছে বৃষ্টিতে...
একা-মাছ লাফিয়ে উঠছে শূন্যে
একা-মাছ ঝিলকে উঠছে শূন্যে
একা-মাছ পার হচ্ছে মরীচিকা
একা-মাছ সওয়ার হচ্ছে ঢেউয়ের উপর