নওশাদ জামিলের কবিতা
রহস্য নোঙর
গভীর গহনাস্রোতে চোখ রেখে বলি
হাতে হাতখানি ধরো—এসো, ঝাঁপ দিই
অতল জলের পিঠে ভাসাব সংসার
পাখায় পাখায় মেলে দেব লীলানাট
হাতটি বাড়াও স্রোতস্বিনী—ভেসে ভেসে
স্বপ্নে-পাওয়া ভেলা নিয়ে যাবে দূরদ্বীপে
হৃদয়বরণ ঘাটে যদি থামে ভেলা
মনে রেখো প্রেম এক রহস্য নোঙর!
হৃদমূলে, রক্তস্রোতে কী এক দহন
হাতটি বাড়াও স্রোতস্বিনী—ঝড়জলে
ভেসে ভেসে পাড়ি দেব প্রলয়পিঞ্জর
কোথায় সে দূরদ্বীপ, জলে ভেজা ঘাস?
প্রেমের প্রবালদ্বীপে চোখ রেখে বলি
জীবন কি শুধু ভেসে যাওয়া, ডুবে যাওয়া?
ইশারালিপি
তোমার ইশারালিপি পাঠ করি ধীরে
মনে হয় আমরা ছিলাম মুখোমুখি
গুহার ভেতরে, অগ্নিপরিখার ঘরে
একদিন নিজেরই গলার স্বর শুনে
বুঝি যে চিৎকারে কেঁপে ওঠে শিলাখণ্ড
দুলে ওঠে প্রত্নত্রস্ত পূর্ণাঙ্গ শরীর
এত দিন কী দেখেছি—একে একে বলি
গুমোট, দুঃসহ, ভারী সেই নীরবতা।
অগ্নিপরিখার ঘরে দাঁড়াই আবার
দেখি আজ হাওয়ায় দুলছে বনলতা
কাঁপছে উদ্ভিন্ন স্তন তীব্র শিহরণে
একদিন নিজেরই গলার স্বর শুনে
বুঝি যে বিস্ফারে কেউ চলে যায় দূরে
কেউ থেকে যায়—মুখোমুখি গুহাঘরে।
হৃদয়ের আলপথ
মাঠের ভিতর দিয়ে আমি ছুটে যাব
অনেক অনেক দূরে—সূর্যাস্তের কাছে
জীবনমৃত্যুর মাঝে আবার দাঁড়াব
আবার হৃদয়ে নেব শূন্যতা, স্তব্ধতা
এমন নীরব হব যেন কোনোদিন
ছুঁইনি তোমার ঠোঁট, হৃদয়জমিন
এমন স্থবির হব যেন কোনোদিন
শিখিনি সাঁতার অশ্রুনদীতে, সাগরে!
খরস্রোতা নদীর মতন যেতে যেতে
হারাব অচেনা নদীমূলে, অন্ধকারে
মায়ার ভিতরে কেউ যদি ডেকে যায়
আকস্মিক তাকাব পিছনে—তারপর
হৃদয়ের আলপথ দিয়ে ছুটে যাব
অনেক অনেক দূরে—একান্ত নিভৃতে।
ভুলের ভ্রমর
সমস্ত চিন্তার বাঁকে স্পষ্ট মুখ, মেঘ
হঠাৎ আকাশ ভেঙে নামে ঝোড়োবেগ
অন্ধকারে হেসে ওঠে তার এলোচুল
ঢেকে দেয়—বলে, তবু ছিল কিছু ভুল?
প্রেমের পরিধিপ্রস্থ তুমি জানো যদি
গোপনে বাজাও কেন বাঁশি নিরবধি?
ওহে মম রাধা, আমি তোমারই শ্যাম
তুমি বলো স্পর্শখেলা, আমি বলি প্রেম!
নিশিবনে নীরবে ফুটেছে নাভিতল
ডুবুরির বেশে খুঁজি তোমার অতল
চোখের ইশারা দিয়ে ভুলের ভ্রমর
হেসে ওঠে—বলে, প্রেম সত্যিই অমর
হৃদয় আগলে রাখি—কেটে যায় বেলা
আমি বলি প্রেম, তুমি বলো স্পর্শখেলা!
মাটিয়া বুরুজ
ঘোরলাগা শীতকাল দাঁড়িয়ে সমুখে
নীরবে পাতারা ঝরে, সুখে না কি দুঃখে?
ঝরে পড়বার আগে কাঁদে ফুলপাতা
আমি লিখি পাতাদের সব শোকগাঁথা!
ইট-চাপা ঘাসের ভিতর প্রাণ থাকে
হলদে পাতার থাকে অনন্ত বিস্মৃতি
চাপে-তাপে উড়ে যায় পাতার প্রাসাদ
ভাঙা-গড়া জীবনের প্রাকৃতিক রীতি?
দু’দিনের বাহাদুরি মাটিয়া বুরুজে
জীবনের আয়ুষ্মান আর নেই বাকি
ঝরে পড়বার আগে গেয়ে যাও গান
ভালোবাসা কোনোদিন দেয় না তো ফাঁকি!
আকস্মিক ঝড়ে উড়ে যাবে পাতাঘর
মাটির মাজারে খোঁজো না আপন-পর!