শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণ

পাঁজরে দাঁড়ের শব্দে জেগে ওঠে বোধ

Looks like you've blocked notifications!

আধুনিক বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী পঞ্চকবি হিসেবে স্বীকৃত শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, উৎপলকুমার বসু ও বিনয় মজুমদার। এঁদের মধ্যে সবশেষে প্রয়াত হলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। কবি শঙ্খ ঘোষকে চিহ্নিত করা হয় প্রতিবাদী বিশ্বের, নতুন স্বরায়ণের কবি হিসেবে। শুধু কবি নন, শঙ্খ ঘোষ বাংলা সাহিত্যের বহুমুখী প্রতিভার প্রতিনিধি। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, কিশোর উপন্যাসিক, সাহিত্য সমালোচক এবং রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। পঞ্চাশের কবি হলেও মানসিকতা ও জীবনদর্শনে তিনি তাঁর সময়ের অন্য কবিদের চেয়ে আলাদা। তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষা যেমন পৃথক, তেমনই কবিতায় অনায়াস প্রতিবাদও দুল্যমান। ছন্দের মোহময় কারুকার্যে কবিতাকে তিনি করে তুলেছেন সুচারু ও শৈল্পিক। কবির বিখ্যাত ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতাংশ লক্ষ করি—

‘একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

তোমার জন্যে গলির কোণে

ভাবি আমার মুখ দেখাব

মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।’

(মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে/ শঙ্খ ঘোষ)

কবিতায় সংহত আবেগের আত্মমগ্ন কবিতা রচনা করলেও শঙ্খ ঘোষকে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী কবি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কবির প্রতিবাদ কখনও মৃদু, কখনও ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে উচ্চকিত। তিনি সময়ের দগদগে ক্ষত চিহ্নিত করেই কবিতা রচনায় ব্রতী হয়েছেন। সমালোচক অশ্রুকুমার সিকদারের ভাষ্যে—১৯৪৭ সাল যেন বিভীষিকা। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া স্বাধীনতাকে কমিউনিস্ট পার্টি অলীক আর মিথ্যা বলে ঘোষণা করেছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা সত্ত্বেও এই স্বাধীনতা যে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে হয়েছিল সবকিছু এক নতুন আনন্দের দিকে চলেছে। শিশুরাষ্ট্রের শাসকদের কার্যকলাপে স্বাধীনতার মোহ অবশ্য অচিরেই ফিকে হতে শুরু করেছিল। কোচবিহারে খাদ্য-আন্দোলনের মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চালনার, কিশোরী হত্যার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষকে লিখতে হয়েছিল :

‘নিভন্ত এই চুল্লিতে তবে

একটু আগুন দে।

হাতের শিরায় শিখার মতন

মরার আনন্দে।’

(যমুনাবতী/ শঙ্খ ঘোষ)

কবিতাটি প্রতিবাদী কবিতাবিশ্বে এক ঝলক নতুন বাতাস হিসেবে আবির্ভূত হয়। তৃণমূল মানুষের যন্ত্রণা ও শোষকের আস্ফালন কবির হৃদয়ে নিদারুণ ক্ষত সৃষ্টি করায় কবির অন্তঃশীল প্রতিবাদী সত্তা জেগে ওঠে। ‘যমুনাবতী’ কবিতায় একদিকে উঠে এসেছে ব্যর্থ শাসক-শোষকের প্রতি কবির তীব্র ঘৃণা। আবার প্রাণস্পর্শী প্রতিবাদও লক্ষণীয়। শঙ্ঘ ঘোষের কবিতায় দুটি ধারা প্রবহমান। আলোচক ড. শিশির দাশের মতে, ‘একটি ব্যক্তিমুখী, এর নির্জনতা সন্ধানী ব্যক্তিসত্তার আত্মকথা, সংকেতময় ভাষায় ও প্রতিমায়, মৃদুকোমল ছন্দস্পর্শে অনুত্তেজিত কণ্ঠস্বরে এই কাব্যধারা বিশিষ্ট; অন্যধারাটি চারপাশের জগতের অসঙ্গতি, সমাজের বৈষম্য ও অমানবিকতার প্রতিক্রিয়ায় বিচলিত ও ক্রুদ্ধ এক ব্যক্তিমনের প্রতিবাদের ধারা, তা মূলত বিদ্রুপে ও ব্যঙ্গে, কখনো স্পষ্ট ও তীব্র, কখনো বেদনায় ও যন্ত্রণায় গভীর।’ শঙ্ঘ ঘোষের কবিতা পাঠে এ প্রপঞ্চগুলোই সচেতন পাঠকের কাছে স্পষ্ট হয়।

শঙ্খ ঘোষের কবিতা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্র, পুলিশ-প্রশাসনিক ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব এমনটা নয়, ক্ষমতার অন্যান্য কেন্দ্রকেও তিনি তীক্ষ্ণ বাক্যশরে বিদ্ধ করেন। ‘চিরকালই যে প্রান্তিক মানুষ অত্যাচারিত হয়, তাঁদের রক্তে রচিত হয় নিত্যনতুন জালিয়ানওয়ালাবাগ’—এ-সত্যই বার বার কবির কবিতায় প্রাণস্পর্শী হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী চেতনার আন্তরিক প্রকাশ কবি শঙ্খ ঘোষকে স্বতন্ত্র করেছে। তিনি ক্ষমতার কাছে কখনও আত্মসমর্পণ করেননি, বরং ক্ষমতাতন্ত্রবিরোধী স্বরায়ণই যে প্রকৃত কবির কর্তব্য, তিনি তা বারবার অজস্র কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। বলাই বাহুল্য, পৃথক পর্যবেক্ষণশক্তি, সংবেদনশীল মানস এবং অনুভববেদ্য দৃষ্টিলোক থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ জীবন ও সমাজ-সংসার পর্যবেক্ষণ করেছেন। যে কারণে তার কবিতা জীবনঘনিষ্ঠ এবং একই সঙ্গে প্রবহমান সময়ঘনিষ্ঠও বটে। শঙ্খ ঘোষ তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা ও অনুভব নানা আঙ্গিকে কবিতায় প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে, চিত্রকল্প, প্রতীক, ছন্দ-অলংকার এবং মিথ-পুরাণের ব্যবহারে কবিতাকে করে তুলেছেন শিল্পঘনিষ্ঠ। এ প্রসঙ্গে কবির ছোট্ট একটি কবিতা লক্ষ করা যেতে পারে

‘প্রতিদিন ভোরের কাগজে

বর্বরতা শব্দ তার সনাতন অভিধার নিত্যনব প্রসারণ খোঁজে।’

(কাগজ : জলই পাষাণ হয়ে আছে)

সংবাদপত্রের একটি তথ্য দিয়ে কবিতাটি রচিত হয়েছে। একটি বাক্যের মধ্য দিয়ে তিনি অনেক কথা তুলে ধরেন পাঠকের সামনে। প্রতিদিন বিভীষিকাময় সংবাদের মধ্যে সময়ের জটিলতার ছাপ স্পষ্ট করেছেন তিনি। কখনও পুরোনো বা প্রচলিত শব্দ দিয়েও তিনি নতুনের আস্বাদের কবিতা সৃষ্টি করেন। নতুন শব্দ তৈরি না করলেও তিনি নতুন বোধ নির্মাণ করেন। ফলে তাঁর কবিতা সাধারণ শব্দের মাধ্যমে অসাধারণ ভাব প্রকাশের বাহক হয়ে ওঠে। কবির ভাষায়, ‘নতুন শব্দের সৃষ্টি নয়, শব্দের নতুন সৃষ্টিই কবির অভিপ্রায়।’

কবিতায় অলংকারের সফল প্রয়োগ প্রকৃত কবির ‘কল্পনা, মননশক্তি ও অভিজ্ঞতার শিল্পিত বহিঃপ্রকাশ’ হিসেবে শনাক্ত করেন কাব্যবোদ্ধারা। ছন্দের সুষম বন্ধনকে আরও প্রাণস্পর্শ করে তোলে অলংকারশৈলী। অলংকারের ব্যবহার কবিতাকে সুখপাঠ্য করার পাশাপাশি কবিতাকে করে তোলে ব্যঞ্জনাবহুল। কবি শঙ্ঘ ঘোষ কবিতায় অলংকার প্রয়োগে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। নানান অনুষঙ্গে কবির কবিতা থেকে অলংকার সৌকর্য সমৃদ্ধ কয়েকটি পঙক্তি তুলে ধরা যেতে পারে-

‘একমুঠো বাঁচবার মতো প্রাণ খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হই’ (খণ্ডিতা)

‘মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধুলোর মতো ছোটে

যে কথাটা বলব সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে’ (অন্যরাত)

‘তুমি প্রেয়সীর মতো ব্যথা তুলে তর্জনী তুলে শাসন তুলেছ’(পিলসুজ)

শঙ্ঘ ঘোষের কবিতার বোধ বহুরৈখিক। তবে ভাষারীতি কথ্য। অর্থাৎ কবিতার ভাষা সরল হলেও ভাবটা জটিল এবং বহুমাত্রিক। মূলত সহজ শব্দের প্রয়োগনৈপুণ্যে তাঁর কবিতা স্বতন্ত্র ভাষারীতি পরিগ্রহ করে। কবিতার ভাষা প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন : ‘সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়... দৈনন্দিন কথাবার্তার চাল, তার শ্বাসপ্রশ্বাস, যথাসম্ভব তার কাছাকাছি থেকে বলা। এসবকে বলেছিলাম সহজ। কিন্তু তার থেকে যে অনুভূতিটা পৌঁছায় তাতে হয়তো অনেক জট-জটিলতা থাকতে পারে। আসলে, ভাষার বা কথার নানা রকমের তল তৈরি হতে থাকে তখন। একদিকে সহজ সীমায় সময়টাকে ধরে রাখতে পারে যে ভাষা, সে কিন্তু অন্যদিকে আবার গড়িয়ে যেতে পারে অনেক দূরে।’

মূলত কবি শঙ্খ ঘোষের ‘কাব্যকলার উৎকর্ষ ঘটে শিল্প ও নির্মাণকৌশলের সম্মিলনে। প্রতিভাকে যথাসাধ্য পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি কবিতায় প্রয়োগ করেন। কবি শঙ্খ ঘোষের মননশক্তি, কল্পনা, অভিজ্ঞান আর জীবনবোধ কাব্যের মূলশক্তিরূপে ভর করে এবং সেগুলোর প্রকাশের জন্য তিনি টেকনিকের আশ্রয় নেন।’ (শঙ্খ ঘোষের কবিতার শৈলী, শামীমা আক্তার)। এ ছাড়া ভাষার কারসাজি, শব্দের অনুশাসন থেকে স্পষ্ট হয় তাঁর কবিতা নির্মাণে একজন শিল্পীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন একজন সচেতন নির্মাতা। মার্জিত রুচির সঙ্গে ভাষার সহজ মিশ্রণে তিনি গড়ে তুলেছেন শিল্পঘনিষ্ঠ কবিতাভুবন। গবেষক তপোধীর ভট্টাচার্যের মতে, ‘রবীন্দ্রনাথ-পরবর্তী প্রজন্মে জীবন সম্পর্কে সংশয় ও অবসাদ যখন আধুনিকতার ক্ষয়িষ্ণু রূপ সর্বত্র প্রকট করে তুলছিল, সৃষ্টি ও মননের পথ হারিয়ে যাচ্ছিল আঁধিতে। পণ্যায়ন পুষ্ট বিকারের সঙ্গে আপস-রফায় আবিল হয়ে যাচ্ছিল বাংলা সাহিত্য। সেই সন্ধিক্ষণে যিনি প্রতিস্রাতের মূর্ত প্রতীক ও নির্ভীক নন্দন-যোদ্ধা হিসেবে আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন আজও, তিনি শঙ্খ ঘোষ।’ (শঙ্খ ঘোষ : সৃষ্টি ও নির্মাণ)। শঙ্ঘ ঘোষের কবিতা পাঠে এ উক্তির সত্যতা প্রতীয়মান হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশের পর বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র ভাষাভঙ্গির খোঁজে যে তরুণ কবিরা কৃত্তিবাস বা শতভিষা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নতুন এক কাব্যজগতের সৃষ্টি করেছিলেন, শঙ্খ ঘোষ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি ব্যক্তিজীবনে চুপচাপ থাকতে পছন্দ করলেও তাঁর রক্তের ভেতর একই সঙ্গে ছিল প্রেম ও বিদ্রোহ। যে ভাষায় কথা বলে অগণিত মানুষ, সেই ভাষাকে উপজীব্য করে তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের বাস্তবতায় ভিন্ন এক ব্যঞ্জনায় প্রেমের লহরি বাজিয়েছেন। ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ তুলে জাগিয়ে তুলেছেন মানুষের সুপ্ত বোধ। বাংলা কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক দীর্ঘদিন কবির কবিতা থেকে রসাস্বাদন করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করি।

লেখক : কবি