পাললিক মন

Looks like you've blocked notifications!

পদ্মা এখানে উন্মত্ত নয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নদীটা এখানে এসে কিছুটা শান্ত। সকালের আলো এখনো ফোটেনি। আবছা আঁধার ছড়িয়ে আছে আকাশ পেরিয়ে দিগন্তের সীমানা পর্যন্ত। পদ্মার ছোট ছোট ঢেউয়ের ঝাপটা তীরে এসে পড়ছে। শান্ত-নিবিড় চারপাশে অন্যরকম এক দ্যোতনা ছড়িয়ে দিয়েছে সেই শব্দ। কাছের বটগাছ থেকে দুই-একটা দোয়েলের শিস ভেসে আসছে। পৃথিবী তখনো জেগে ওঠার অপেক্ষায়। থেকে থেকে কোদালের শব্দ পাওয়া যায়। মাটি কাটছে মালতি। নদীর ধারের নরম মাটি কেটে নিয়ে ঝাঁপিতে রাখছে, বেশ বড় ঝাঁপিটা। একটু পর সেখানে আসবে পরাণ। মালতির মতো এত ভোরে তার ঘুম ভাঙে না। মাটিকাটা শেষ হলে দুজন মিলে ধরে ঝাঁপিটা নিয়ে তারা ফিরবে মালতিদের বাড়িতে।
 
মালতি রানি কুমারপাড়ার মেয়ে। বছর চারেক আগে স্কুলের পড়া শেষ করেছে। এরপর আর পড়াশোনা এগোয়নি। ওর বাবা হরিপদ দত্ত কুমার। একসময় গঞ্জে নিজের একটা দোকান ছিল। মাটির জিনিসপত্র বিক্রি করে খুব একটা সুবিধা না করতে পারলেও কোনোভাবে দিন চলে যেত। এক দুর্ঘটনায় হরিপদ তার চোখের আলো হারায়। তারপর থেকে আর কাজ করতে পারে না। চলাফেরায়ও অন্যের ওপর নির্ভরশীল। এদিকে সংসারে শুরু হয় অভাব। সংসারের হাল তখন ধরেছিল মালতির মা শ্যামা রানি। মাটির থালাবাটি, ব্যাংক এগুলো বিক্রি করে যা আয় হতো, তা দিয়ে চলত। হঠাৎ একদিন মারা যায় সেও। এরপর সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় মালতিকে। লেখাপড়া বন্ধ করে পুরোপুরি মন বসাতে হয় কাজে। মাটি কাটা, চাকা ঘুরিয়ে সেগুলো থেকে থালা-বাটি তৈরি, সবই তাকে করতে হয়। কিন্তু এত কিছুর পরও মালতির একটা শান্তির জায়গা আছে। পরাণ নামের একটা লোক তার পাশে আছে। গঞ্জের বাজারে একটা মুদি দোকান চালায় পরাণ। কাজের ফাঁকে যখনই সময় পায়, তখনই মালতিকে কাজে সাহায্য করে। পরাণ আর মালতি দুজন দুজনকে ভালোবাসে। পরাণের মাও জানে সে কথা। একটু গুছিয়ে নিতে পারলেই তাদের বিয়ে।
 
পদ্মার পাড় থেকে মাটিবোঝাই ঝাঁকা নিয়ে ফেরে মালতি আর পরাণ। সেগুলো উঠোনে রেখে বারান্দায় গিয়ে বসে দুজন। দুজনের সারা গায়ে মাটি। সেসব ঝারতে ঝারতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দুজন দুজনকে চুমু খায়। খুনসুটির ফাঁকে হাত মুখ-ধুয়ে মাটির বারান্দাটায় একটা পাটি বিছিয়ে নেয়। ঘরের ভেতর থেকে মালতি বাবাকে সেখানে এনে বসায়। তারপর সবাই মিলে মুড়ি, নারকেল আর গুড় দিয়ে সকালের নাশতা করে।
 
মালতির মনটা আজ ভালো। যেদিন ওর মনটা খুব ভালো থাকে, সেদিন সে একটা অন্যরকম কাজ করে। চাকায় হাঁড়ি-পাতিল, মাটির ব্যাংক না বানিয়ে হাতে ঠাকুরের মূর্তি বানায়। কৃষ্ণ ঠাকুর, গণেশ ঠাকুর, দেবী দুর্গাও। মাঝারি আকৃতির এই মূর্তিগুলো সে বিক্রি করে না, রেখে দেয়। তবে একই ঠাকুরের কয়েকটা মূর্তি হয়ে গেলে সেখান থেকে দুই-একটা চাইলে বিক্রি করে। আবার কখনো কেউ চাইলে এমনি এমনিও দিয়ে দেয়, যখন বুঝতে পারে টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই।
 

সেদিন গঞ্জ থেকে ছুটতে ছুটতে পরাণ এসে মালতিদের বাড়িতে হাজির। জোরে জোরে তাকে ডাকতে থাকে।
‘মালতি, মালতি কই তুই?’
‘আমি ঘরে, বাপুরে খাওয়াই।’
‘একটু বাইরে আয় দেহি। কতা আছে।’
‘কইলাম না বাপুরে খাওয়াইতাছি। তুই ভিতরে আয়।’
‘আইতাছি খাড়া।’
ঘরের ভেতরে গিয়ে পরাণ বলে, ‘মালতি একটা খুশির খবর আছে।’
‘কী অইছে ?’
‘আমার ভিসা অইয়া গেছে। দশদিন পর ফ্লাইট।’
‘ভিসা অইছে মানে? তুই কই যাছ?’
বাবাকে তড়িঘড়ি করে খাইয়ে মালতি পরাণের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরাণের চোখে চোখ রাখে। ওর গলার স্বরটা কেমন যেন নিচু হয়ে আসে।
‘তুই আমারে ছাইড়া কই যাবি?’
‘গঞ্জে দোকান দেওনের পর থেইকা অল্প অল্প কইরা টেকা জমাইছি। শোন মালতি, এই গরিবি আমার ভালা লাগে না। টানাটানির জীবন আমি চাই না। আমি চাই তরে লইয়া সুখে-শান্তিতে থাকমু। তর কষ্ট আমার সহ্য অয় না। আমি সিঙ্গাপুর যাইতাছি। ওইহানে একটা কাম পাইছি। বিশ্বাস কর, আমি খালি বছর দুয়েক থাকমু। টেকা জমামু। তারপর সেই টেকা দিয়া গঞ্জের বাজারে বড় একটা শাড়ির দোকান দিমু। তরে ধুমধাম কইরা বিয়া কইরা বাড়িত নিয়া যামু। দোচালা একটা ঘর বানামু। আমি দোকান থেইকা ফিরা আইলে দুপুরে তর আতের গরম গরম সালম দিয়া ভাত খামু। রাইত অইলে তরে লইয়া পদ্মার পাড়ে যামু জোছনার বান দেখতে।’
‘তুই এইসব কতা তো আগে কস নাই! আমার তো কিছুই নাই তুই ছাড়া। এতদিন একলা একলা কি আমি টিকতে পারমু?’
‘চিন্তা করিস না মালতি। আমি যেহানেই যাই, তর লগে আছি। দুইডা বছর আরেকটু কষ্ট কর। এরপর আর তরে কষ্ট করতে দিমু না আমি।’
‘বাপুরে আমগো লগে রাখবি?’
‘নিমু তো। খুঁড়োর লাগি চিন্তা করিস না।’
‘তুই কি আসলেই বিদেশে যাইবি?’
‘অবুঝের মতো প্রশ্ন করিছ না মালতি।’
পরাণের বিদেশে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে। মালতির জন্য একটা মোবাইল ফোন কেনে সে। সেটা দিতেই কয়েকদিন পর পরাণ মালতিদের বাড়িতে আসে। মালতির বাবাকে পাশের একটা মাঠে রোদ পোহাতে নিয়ে গেছে পাড়ার ছেলেরা। মালতি ঘরেই ছিল। পরাণ ‘মালতি’ ‘মালতি’ ডাক দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে। খুঁড়োকে না দেখে সে মালতির খুব কাছে এগিয়ে যায়। তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে। মালতি পরাণকে সরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু পারে না। আরও শক্ত করে পরাণকে জড়িয়ে ধরে। পরাণ দরজায় খিল দেয়। শরীর-মনে দুজন এক হয়ে যায়।
 

পরাণ বিদেশ যাওয়ার দুই মাস গড়ায়। মাঝে মাঝে মালতির মোবাইল ফোনে কথা বলে। সামনের দিনগুলো কীভাবে সাজাবে তাই নিয়ে রাতবিরাতে কত কথা ওদের। এখন মালতিকে একা অনেক কাজ করতে হয়। তবু ওর মধ্যে সব সময়ই একটা তৃপ্তি কাজ করে। মনে মনে ভাবে, কষ্টের দিন জলদি ফুরাবে। এরই মধ্যে শরীরে পরিবর্তন দেখা দেয় মালতির। হঠাৎ এ পরিবর্তনে প্রথমে ভড়কে যায় মালতি। কয়েক ঘর পরে ওর বান্ধবী বিশাখাদের ঘর। একদিন বিশাখাকে নিয়ে কমিউনিটি হাসপাতালে যায় মালতি। সেখানকার ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করে জানায় মালতির গর্ভে সন্তান।
হাসপাতাল থেকে আসার পথে সরিষা ক্ষেত। বিশাখা ভয়ে মরে যাচ্ছে। বারবার মালতিকে বলে, ‘এইডা কী করলি? কেমনে করলি? কেমনে এহন কী করবি? মাইনসে কী কইবো? পরাণরে এহনও জানাস না ক্যান?’ মালতি সরিষা ক্ষেতের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাসতে থাকে। ভেতরে একটা চাপা উৎকণ্ঠা কাজ করলেও সেটাকে পাত্তা দেয় না। ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে পেটে হাত রেখে বলে, ‘দেখ বিশাখা, এহানে পরাণের গেদা ... আমাগো গেদা...।’ 
মালতি সেদিন রাতে ঘুমাতে পারে না। পরাণের মোবাইলে অনেকবার মিস কল দেয়, কিন্তু সেই কল আর বিদেশে থেকে ফেরত আসে না। এভাবে পরাণের ফোনের অপেক্ষাতেই রাতটা কেটে যায় ওর।
ভোর হতেই মালতি মূর্তি বানানোর ছোট্ট বেড়ার ঘরটায় যায়। বড় একদলা মাটি এনে পরম যত্নে একটা মূর্তি বানাতে শুরু কওে, একটা শিশুমূর্তি। মালতি একবার ওর পেটে হাত রাখে, আরেকবার মাটির দলাটায়। খুশিতে মাটি দিয়ে শিশুর আদল বানাতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর মালতি জোরে জোরে কথার আওয়াজ শুনতে পায়। শব্দগুলো ক্রমশ তাদের বাড়ির দিকেই আসতে থাকে। কুমারপাড়ার কয়েকজন বয়ঃজ্যেষ্ঠ ওদের ভিটায় হাজির। হঠাৎ তারা ডাকতে থাকে ... হরিপদ ... হরিপদ... মালতি... মালতি। শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে মালতি। মালতির বাবা হরিপদ তখন বারান্দাতেই ছিল।
‘ছি ছি ছি হরিপদ, তোমার যে আর কিছুই থাকলো না। চোখ গেছে, দোকান গেছে, বউ গেছে, ধন গেছে, এবার মানসম্মানও গেছে।’
হরিপদ উত্তর দেয়, ‘কেন কী হইছে?’
‘তোমার মালতি যে পোয়াতি, এইডা জানো?’
‘রাম রাম রাম এসব তোমরা কী কও?’
‘আমরা সব জাইনাই কইতাছি। দরকার হইলে মালতিরেই জিগাও?’
‘কিরে মালতি, এসব কী কয় সকলে?’
মালতি এগিয়ে এসে উত্তর দেয়, ‘বাবা কথা সত্য। আমি পোয়াতি।’
‘এইসব কী কছ তুই মালতি? তুই কেমনে এত নষ্ট হইয়া গেলি!’
‘না বাবা আমি নষ্ট হইয়া যাই নাই, কোনো অন্যায়ও করি নাই।’
‘এইসব তুই কী কস? তর তো এহনও বিয়া অয় নাই। কে তর এই অবস্থা করলো?’
মুরব্বিরা সবাই বললো, ‘হ ক, নষ্টা ছেমরি। কার লগে ফস্টিনস্টি কইরা পেট বানাইছোছ ?’
‘খবরদার পচা কথা কইবেন না। এইটা আমার ভালোবাসার পাওয়া।’
‘তবে রে দুশ্চরিত্রা...। আকাম কইরা আবার বড় বড় কথা কছ। ভালোবাসার কতা কছ। ক তোর পেডের গেদার বাপ কে?’
‘আমার গেদার বাপ পরাণ।’
‘পরাণ তো বিদেশে? ও জানে এইসব কথা?’
‘জানতে কতক্ষণ।’
‘আমরা এইসব বুঝি না। পরাণ যতক্ষণ না আইয়া কইবো হের কারণে তুই পোয়াতি হইছস, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তর কতা বিশ্বাস করুম না। পরাণরে ক দেশে আইতে। অর মায়ে কি তার ছেলের এইসব কীর্তির কতা জানে? কোনো জারজ গেদার জন্ম এই কুমারপাড়ায় অইবো না। ছি ছি ছি কী কাণ্ড’, বলতে বলতে মুরব্বিরা চলে যায়।
হরিপদ দত্ত প্রথমে মালতিকে অনেকক্ষণ বকাঝকা করে। তারপর সব বুঝতে পেরে ওকে বুকে টেনে নেয়। মালতির চোখ গড়িয়ে স্রোতের বেগে অশ্রুধারা বয়ে যায়। বাবাকে বারবার বলতে থাকে, ‘বাপু আমারে ক্ষেমা কইরে দাও। আমার ছোট্ট একটা ভুল হইছে, কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো বাপু আমি কোনো পাপ করি নাই।’
সেদিন সন্ধ্যায় পরাণের ফোন আসে। ফোন ধরেই পরাণ মালতিকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে মালতি, এইসব কী হুনতাছি? মাইনসে যা কইতাছে তা কি সত্য?’
‘কী হুনছোছ তুই?’
‘তুই বলে পোয়াতি?’
‘যা হুনছোছ সব সত্য।’
‘আমারে মানইসের কাছ থেইক্যা কেন হুনতে অইলো মালতি? তুই কেন কইলি না?’
‘আমি তরে বহুবার মিস কল দিছি। তর কোনো সাড়াশব্দ পাইনাই।’
‘তুই একদম চিন্তা করবি না মালতি। আমি মায়েরে সব কইছি। পয়লা রাগ করছিল। পরে সব মাইনা নিছে। আমার টেকা লাগবো না। আগে তুই। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আইসা পরমু।’
‘কিন্তু পাড়ার সব মুরব্বিরা তো আমাগোরে আইসা শাসাইয়া গেছে।’
‘আমি মায়েরে আর কাকারে দিয়া সব থামাইতাছি। তুই অস্থির হইছ না।’
কিছুুদিনের জন্য সব শান্ত হলো। এদিকে এক মাস-দুমাস করে আরও চার মাস কেটে গেল। পরাণ আসছে না। ফোন করে আসব, আসছি করে। নানা সমস্যার কথা বলে। তবে প্রতি মাসে মালতিকে কিছু টাকা পাঠায়। সেই টাকা মালতি এখন সংসার খরচের কাজে লাগায়। এদিকে ওর গর্ভে দিনে দিনে বড় হচ্ছে পরাণের সন্তান। মালতি সময় পেলেই মূর্তি বানানোর ঘরে যায়। পেটে হাত রেখে কী কী যেন সব বলে। তারপর শিশুমূর্তিটার গায়ে আঁচড় কাটে। চোখ বুজে মনছবি দেখে। তারপর ওর চোখ দেয়, নাক দেয়, ঠোঁট দেয়। পরম যত্নে ওকে গড়ে তোলে। কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় খবর আসে পরাণ ফ্লাইট ধরেছে। নানা সমস্যা কাটাতেই ওর সময় লেগেছে। সকালে হঠাৎ কুমারপাড়ার মুরব্বিরা দলবল নিয়ে আবার মালতিদের বাড়ি হানা দেয়। এবার তাদের সঙ্গে পুরোহিত মশাইও আছেন।
‘কই, নষ্টা মালতি কই ?’
‘আপনারা আবার আইছেন। কী চান আপনেরা?’
‘তোর বহুত কথা হুনছি। আর না। পরাণ কই? হেয় আহে না কেন?’
‘কাইল আমার লগে কথা অইছে। হেয় রওনা দিছে।’
‘থাম নষ্টা মাইয়্যা। আর মিছা কথা কইছ না। আমরা সব বুইঝা ফালাইছি। তরা এই কুমারপাড়ারে অপবিত্র করতে চাস। এইসব অইবো না। অই সবাই মিলা মালতিরে আর অর বাপেরে পাড়ার বাইরে দিয়া আয়। অগো এইহানে কোনো জায়গা নাই। জারজ গেদা এহানে জন্মাইতে পারবো না।’
‘এইসব কী কন? আমারে বিশ্বাস করেন, মা কালীর দিব্যি সে বিদেশ থেইকা আইসাছে। আপনেরা এমন কাম কইরেন না। আমার শরীরটা বালা না।
‘আইজ তোর কোনো কতা হুনুম না। চল।’
চুল ধরে হিঁচড়ে হিঁচড়ে মালতিকে পাড়ার বাইরে নিয়ে যেতে লাগল সবাই। সঙ্গে ওর অন্ধ বাবাকেও। এর মধ্যে অতি উৎসাহী কয়েকজন মালতিকে নষ্টা নষ্টা বলে ওর পেটে কয়েকটা ঘুসিও দিল। পদ্মাপাড়ের শান্ত-সুনিবিড় কুমারপাড়ার মানুষগুলো কত অশান্ত হয়ে ওঠে তার সাক্ষী হয় সেখানকার মাটি। কুমারপাড়া ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে একটা গাছের নিচে ওরা ফেলে রেখে যায় মালতি আর তার বাবাকে। কেউ খেয়াল করেনি, ততক্ষণে রক্তে ভেসে গেছে মালতির দেহ। তার কিছুক্ষণ পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে মালতি। অন্ধ হরিপদ মালতিকে কোলে নিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে।
সেদিন বিকেলে বাড়ি ফেরে পরাণ। গাছের নিচে গিয়ে সে পায় মৃত মালতিকে। সঙ্গে আরেকটা ছোট্ট লাশ পায় একটু দূরে। মালতির গর্ভে থাকা পরাণের ছয় মাসের অপরিণত শিশুটিকে। পরাণ লাশগুলো নিয়ে কুমারপাড়ায় ফিরে আসে। সবার দরজায় তখন খিল। পরাণ মালতিদের উঠানে লাশ দুটো রেখে চারদিকে তাকায়, তারপর গিয়ে ঢোকে মূর্তি বানানোর ঘরে। ঠাকুরদের মূর্তির মাঝখানে দেখতে পায় একটা শিশুমূর্তি। নিষ্পাপ, স্নিগ্ধতায় ভরা চোখ। পরাণ সেটাকে হাতে তুলে চিৎকার করে বলে, তোমরা এতগুলান ঠাকুর মিলে আমার মালতি আর বাচ্চাডারে বাঁচাইতে পারলা না!
 
রাত তিনটা। পদ্মাপাড়ের শ্মশানে আগুন জ্বলছে। মালতির লাশের পাশে সৎকার হচ্ছে ছোট্ট শিশুটিরও। কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে পরাণ। তার হাতে মালতির হাতে গড়া শিশুমূর্তিটি।