‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’র চরিত্রগুলো সাধারণের জীবনের এক অনন্য চিত্র

Looks like you've blocked notifications!

লক্ষণ সেনের পালিয়ে যাওয়া আর মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের ঘটনা স্কুলের ইতিহাস পড়েই শেখা। তবে, তুর্কি আক্রমণের ‘এই এল রে ঐ এল যে’—এর সেই সময়ে বঙ্গের সাধারণ মানুষগুলো বা প্রাকৃতজনদের জীবন কেমন ছিল, তা স্কুলের ইতিহাস বইয়ে জানার সুযোগ হয়নি। শওকত আলী তাঁর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে বসন্তদাস, মিত্রানন্দ, মায়াবতী, শ্যামাঙ্গ, কৃষ্ণা, লীলাবতীদের চরিত্রগুলো ধরে সেন শাসনের পতনের সময়ে সাধারণের জীবনের এক অনন্য চিত্র তুলে ধরেছেন।

নদী বিধৌত বাংলার নদীতীরের অসংখ্য সাধারণ গ্রামের মতো একটি গ্রাম উজুবট। কলকাকলী, দৈনন্দিন কলহ আর মাটির কাছাকাছির জীবন ছিল উজুবট বাসীর। এরপর সময়ের পরিক্রমায় তাঁদের জীবন বদলে যাওয়ার যে গল্পটি শওকত আলী বলেছেন তা ওই সময়ের সব রাঢ় বরেন্দ্র বঙ্গ সমতটবাসী সব প্রাকৃতজনেরই যেন গল্প।

সামন্ত প্রভুদের অত্যাচারে অতীষ্ট মুক্তি প্রতীক্ষিত সাধারণ মানুষ। ভিক্ষু ও যবন বা বৌদ্ধ ও মুসলিমদের  সংগঠিত হতে থাকা, তুর্কিদের অর্তকিত আক্রমনের শঙ্কা—ছোট ছোট অসংখ্য ঘটনায় তুলে ধরেছেন লেখক। যুগে যুগে অত্যাচারীদের একই স্বরূপ দেখে অন্যতম মূল চরিত্র শ্যামাঙ্গর উপলব্ধি—‘তার মনে কেবলই প্রশ্ন, এরা কারা? একই স্থানে আঘাত হানে, একই গৃহে অগ্নি দেয়, একই পল্লীর মানুষকে হত্যা করে-অথচ দুটি ভিন্ন দল-এদের মধ্যে কি সত্যিই কোন পার্থক্য আছে?’ শ্যামাঙ্গর এই উপলবদ্ধি আজও চিরন্তন। পৃথিবী জুড়ে অত্যাচারীদের চরিত্র একই, তাদের আসলেই কোনো পার্থক্য নেই।

প্রাকৃতজন যুগে যুগে রক্ষায় নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করেছে। একটি ছো্ট্ট হাটে মিষ্টি বিক্রেতা এক বয়স্ক রমনীর একজন সামন্ত সৈন্যকে প্রতিরোধের ঘটনা, ছায়াবতী, বিভাবতী, কষ্ণাদের আত্মত্যাগ দিয়ে প্রাকৃতজনের প্রতিরোধের উপ্যাখানও সংযুক্ত করা হয়েছে।

মানুষের মঙ্গলময় স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশায় বসন্তদাস ও মিত্রানন্দের ভাবনা পাঠকের জন্য ভাবনার খোরাক তৈরি করে। ‘এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে—এর শেষ কোথায়? এমন উক্তির নিগঢ়ে মানুষের জন্য স্বস্তির জীবনের অনুসন্ধানের গল্পেরও দেখা মেলে এই উপন্যাসে।

ইতিহাসের পাতার সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে প্রাকৃতজনের গল্পটা শুধু পড়া নয়, হৃদয় দিয়ে অনুভব করার অবস্থাও তৈরি করে দিয়েছে শওকত আলীর এই অনন্য সৃষ্টি প্রদোষে প্রাকৃতজন। তবে, উপন্যাসের ভাষা আর অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহারের কারণে পাঠে কিছুটা বিঘ্ন তৈরি হতেই পারে।

শওকত আলীর লেখা ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন সমর মজুমদার। বইটি প্রকাশ করেছে দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। এর প্রথম প্রকাশ ১৯৮৪ (পঞ্চদশ মূদ্রণ: নভেম্বর ২০২০), যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯৭টি, দাম ২৭৫ টাকা।