‘বদলে যাওয়া ভূমি’ : অতিমারির পৃথিবীর আরেক উপাখ্যান

Looks like you've blocked notifications!

হারুন পাশার ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ যখন পড়ছিলাম, ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল অ্যারিস্টটলের ‘দ্য পোয়েটিকস’-এর কথা। সেখানে তিনি ট্র্যাজেডি নাটকের জন্য একটি টার্ম নিয়ে আলোকপাত করেছিলেন। সেটি হলো ক্যাথারসিস। তাঁর এই মেটাফরিক টার্মটি মানবমনে নায়ক বা নায়িকার পতন নিয়ে ভয় ও করুণার সৃষ্টি করে। ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ উপন্যাসের পাতায়-পাতায় আমি যখন পরিভ্রমণ করেছিলাম, আমার মনেও সেই ভয় ও দ্বিধা কাজ করেছিল। প্রথমত, এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা একটা ভয়াবহ মহামারির বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখে এসে থমকে গেছি। দ্বিতীয়ত, সেই বাস্তব অভিজ্ঞতার বিন্যাসে যখন সাহিত্যের শাখাগুলোতেও নতুন করে পুননির্র্মাণ হয় অভিজ্ঞতার কথা, তখন পাঠক যেন বাস্তবতাকেই আস্বাদন করেন।

সেই বিবেচনায় ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ এই অতিমারির পৃথিবীর আরেক নতুন উপাখ্যান। স্বদেশকে ডিঙিয়ে বিদেশ-বিঁভুইয়ে যে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে, তার স্পষ্ট ব্যঞ্জনা শুনতে পাই বইয়ের পাতায় কান পেতে। সেইসঙ্গে স্বদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় কোনো অনুষঙ্গই অচ্যুত থাকেনি ঘটনাপ্রবাহে, চরিত্র চিত্রণে, নানা আবহে। করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় নেতাদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও বয়ানের চিত্র এই উপন্যাসের পর্বগুলোয় উঠে এসেছে। এসব চরিত্র আমাদের চারপাশেই বিচরণ করছে। পাশা এসব চরিত্র নির্মাণ করেছেন নির্ভীকতার সঙ্গে শক্তিশালী ভাষায়। এটি একজন ঔপন্যাসিকের বড় শক্তি। সারা বিশ্ব যখন করোনা মহামারিতে সতর্ক হতে বলেছে, তখন এক শ্রেণির লেবাসধারী মানুষ সাধারণ মানুষকে বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই যে বিপদে ফেলার সংস্কৃতি তৈরি করেছে আমাদের সমাজে, এটির ভিত অনেক শক্ত। এসব নীরব অদেখা ভিত্তির খোঁজ কেবল কথাশিল্পীরাই আঁকতে পারেন নতুন সুর সমাজ বিনির্মাণের।

এই উপন্যাসে সামাজিক-অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংকটের পাশাপাশি উঠে এসেছে পারিবারিক নানা হালচাল ও ভেতরকার স্পষ্ট জলছবি। বাংলাদেশের সমাজচিত্রের এসব চিরন্তন চিত্রণ হারুন পাশার লেখনিশক্তিতে নতুন মাধুর্য পেয়েছে। পারিবারিক পরচর্চার নতুন খতিয়ান আবার পড়া হলো নতুন করে।

উপন্যাসের যে নির্মিতি, কাহিনি কিংবা ঘটনায় যে চরিত্র চিত্রণ, সেই বিন্যাসে সমাজের আসল রূপের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। যতটা কৌশলী হলে এসব চরিত্র চিত্রণে নির্মম ও পক্ষপাতমুক্ত থাকা যায়, তা স্পষ্ট করোনা উপাখ্যানের এই নান্দনিক কথাশিল্প ‘বদলে যাওয়া ভূমি’-তে।

‘বদলে যাওয়া ভূমি’ উপন্যাসের একক আলাদা বৈশিষ্ট্য আমার চোখে ধরা পড়েছে। পাঠক হিসেবে সহজ গদ্য আমাকে পরিপূর্ণ ঘটনার স্বাদ আস্বাদনে তাড়িত করেছে। বিশেষ করে চরিত্রগুলোর বয়ানে সমাজভাষা ক্রমশ আমাকে শেষাবধি আটকে রেখেছে। এটি ঔপন্যাসিকের কৌশল কিংবা শক্তিও হতে পারে।

পাশা এ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, লকডাউন শব্দগুলো সাহিত্যের বড় প্ল্যাটফর্ম কথাসাহিত্যে যুক্ত করলেন। তাঁর ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ মহামারি নিয়ে একটি অভিনব ও পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস।

করোনা নিয়ে রাজনীতি সর্বত্র। ওষুধ নিয়ে, হাসপাতালের ইকুয়েপমেন্ট কেনা নিয়ে, ভেন্টিলেটর নিয়ে, হাসপাতাল নিয়ে, টিকা নিয়ে। কোনটা নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল রাজনীতি করেনি? পাশার উপন্যাস সে হিসেবে সময়োপযোগী অনুসন্ধানী উপন্যাস। কারণ, উপন্যাসের চরিত্রগুলো, ঘটনার প্লট কাল্পনিক নয়। বাস্তব ও কল্পনার মিশেল, কোনো ফ্যান্টাসিও নয়। আপাদমস্তক বাস্তবতার প্রতিফলনে সমসাময়িক উপন্যাস।

কোয়ারেন্টিন-অবরুদ্ধ সময়ে বসে হারুন পাশা লিখেছেন তাঁর ‘বদলে যাওয়া ভূমি’। ‘বদলে যাওয়া ভূমি’-তে ইট-কাঠ-পাথরের নগরজীবনে বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতিও ধরা পড়েছে। উপন্যাসের দুই চরিত্র হিশাম আর সাব্বির আমাদের সমাজের একটা শ্রেণিকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের আলাপচারিতা, যুক্তিতর্ক, গল্পে অনেক বিষয় উঠে এসেছে। এই উপন্যাস সময়কে ধারণ করেছে সুনিপুণভাবে। এ উপন্যাসের প্লটের শুরু পাঠককে একরাশ মুগ্ধতায় নিয়ে যাবে। তাঁর বর্ণনা সহজ-সরল ও বর্ণনাধর্মী।

পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের নানা সঙ্গতি-অসঙ্গতি উঠে এসেছে এ উপন্যাসে। করোনাকালে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন, সম্পর্ক, প্রেম সবকিছুই ঘরবন্দি। মানুষের সুখ-দুঃখও ঘরবন্দি। কারও সঙ্গে দেখা হয় না, কেবল কথা হয় মুঠোফোনের ছোট্ট স্ক্রিনে। পৃথিবীতে যেন এক অদ্ভুত আঁধার এসেছে। ক্ষমতার লোভে সংকটাপন্ন পৃথিবীতে কেবলই বাড়ছে অন্ধত্ব। সেই অন্ধত্বকে পুঁজি করে একদল রাজনীতি করে, আরেক দল ফায়দা লোটে।

পাঠক, হারুন পাশার ‘বদলে যাওয়া ভূমি’ পড়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আর অবলোকন করুন করোনাকালের দহন, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রেম।

বদলে যাওয়া ভূমি

প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ

পৃষ্ঠা : ২৭২

মূল্য : ৫০০ টাকা