বাঙালি নারীর জাগরণ এবং সুফিয়া কামাল

Looks like you've blocked notifications!
নারী জাগরণের অগ্রদূত কবি সুফিয়া কামালের ১১০তম জন্মদিন আজ। ছবি : সংগৃহীত

বাংলা তথা বাঙালির সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে সুফিয়া কামাল এক ঐতিহাসিক চরিত্র। নারীর স্বাধিকারের আন্দোলনকে সুফিয়া কামাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নারীর জন্য সম্পূর্ণ আকাশের লক্ষ্যে সমস্ত ধরনের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে লড়াইকে স্থিত করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই আর ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াই—প্রতিটি সংগ্রামই যে বৃহত্তর আঙ্গিকে মানবমুক্তির পক্ষে যুদ্ধের এক-একটি ক্ষিপ্র হাতিয়ার, সুফিয়া কামাল তাঁর নিজের জীবন ও কর্মের ভেতর দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।

উনিশ শতকের দোলাচাল অতিক্রম করে বিশ শতকের বাঙালি নারীমানসকে ঘরের আগল ভেঙে সমাজবিকাশের প্রত্যক্ষ অংশীদার হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে যাঁদের অবদান অবিস্মরণীয়, তাঁদের প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব সুফিয়া কামাল। উনিশ শতকে ব্রিটিশের শাসন আর শোষণের মিশ্রিত নীতি আধুনিক মননে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। আর সেই প্রতিষ্ঠার ফসল হিসেবে উনিশ শতকের নবজাগরণের ফসল কার্যত একচেটিয়া ভোগ করেছে হিন্দু সম্প্রদায়। সেই জায়গা থেকে বাংলা তথা বাঙালির প্রাণ মুসলমান সম্প্রদায়কে এতটুকু বিচ্ছিন্নতার মানসিকতাসম্পন্ন হতে না দিয়ে আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং প্রতিবেশী হিন্দুসমাজের যথার্থ হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে তুলে ধরতে নবাব ফয়জুন্নেছা, মীর মশাররফ হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, বেগম রোকেয়া, নজরুল মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন প্রমুখ যে ঐতিহাসিক অবদান রেখে গেছেন, সেই পথের অগ্রপথিক সুফিয়া কামাল।

আজ সর্বত্র ধর্ম, ভাষা, জাতপাত, লিঙ্গ, রাজনীতির নামে যে বিদ্বেষ, নারীর মন থেকে সেই বিদ্বেষ দূর করাই ছিল সুফিয়ার জীবনের অন্যতম ব্রত এবং সেখানেই রয়েছে হিউম্যানিস্ট হিসেবে তাঁর সার্থকতা। দেশভাগের পর আবার ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে দাঙ্গাবিধ্বস্ত  নারীদের মনে আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আত্মনিয়োগ করে সুফিয়া প্রথম যে কাজটি করেছিলেন, সেটি হলো জাতীয় আন্দোলনের একটা পর্যায়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী লীলা নাগ (রায়) নেতৃত্বাধীন শ্রী সংঘ বিভাজিত পূর্ব পাকিস্তানে তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানজনিত কারণে যে উগ্র কমিউনিস্টবিরোধী অবস্থানকে মাথায় রেখে সেবা করেছে, সেই বিদ্বেষের জায়গা থেকে তাঁদের সরিয়ে আনা।

সুফিয়া কামাল কমিউনিস্ট ছিলেন না। ছিলেন আত্মনিবেদিত মানবতাবাদী। সত্যের পূজারি। এই পরিশীলিত মনন থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শ্রী সংঘে লোকদের কমিউনিস্ট-বিরোধিতা, এমনকি গুপ্তহত্যা ইত্যাদির কারণে অচিরেই সাম্প্রদায়িক শক্তি লাভবান হবে। ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু হিন্দুরা। সোমেন চন্দের হত্যাজনিত ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে অতীতের বিপ্লবী, যাঁরা তখন আরএসপি করেন এবং  শ্রী সংঘের কর্মীদের যৌথ কর্মকাণ্ড ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করেছিল, এই বোধে উপনীত থেকেই দেশভাগের পর যাতে কোনোভাবেই ধর্ম আর জাতপাত, রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিভেদের রূপ ধরে মাথা চাড়া দিতে না পারে, এ বিষয়ে পূর্ববঙ্গে প্রথম হাতেকলমে সক্রিয় ভূমিকা সুফিয়া কামাল নিয়েছিলেন।

নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া সমাজে নারীমুক্তি আসতে পারে না, আর নারীমুক্তি ব্যতীত সামগ্রিক অর্থে মানবমুক্তি অসম্ভব—এই বৈজ্ঞানিক সমাজবিকাশের চেতনাই ছিল সুফিয়া কামালের জীবনবেদ। তাই তিনি জীবনের শুরুর উপলব্ধিতেই জীবনসায়াহ্নে এসেও অত্যন্ত জোর গলায় বলেছিলেন—ঘর ভাঙার নারীবাদে আমি বিশ্বাস করি না। সে কারণেই সমাজের উঁচুতলার মানুষের ভেতরে শৌখিন মজদুরি করতে তাঁকে একটিবারের জন্যও আমরা দেখি না। ঈদের বাজারে লাখ টাকার লেহেঙ্গা কিনতে ব্যস্ত থাকা নারীর চাঁছাছোলা সমালোচনা সুফিয়া কামাল কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে চিরজীবন করেছেন কেবল অভুক্ত, অর্ধভুক্ত নারীর জন্য একটি আস্ত পরিধেয় জোগাড় করার তাগিদ থেকে। তাই জীবনের শেষ পর্বে এসে তিনি বলতে পেরেছিলেন—মেয়েদের জন্য আমি ইট বিছিয়ে পথ করে রেখেছি। এখন মেয়েরা নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারবে।

ধর্ম আর সমাজের যাবতীয় ভ্রুকুটির তোয়াক্কা না করে ১৯২৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের পার্ক সার্কাসের অধিবেশনে লাল পাড়ে শাড়ি, কপালে সিঁদুর পরে কংগ্রেস সভাপতি মোতিলাল নেহরুকে স্বাগত জানিয়েছিলেন সুফিয়া। আবার এই সুফিয়াই তেতাল্লিশের মন্বন্তরকালে স্বামী কামালউদ্দিন খানের কর্মস্থল বর্ধমানে থাকাকালীন মণিকুন্তলা সেনের ঘনিষ্ঠ সংযোগ গড়ে তোলেন। সেই সূত্র ধরেই এই সময়কালে তিনি তেতাল্লিশের মন্বন্তর প্রতিরোধে নারী আত্মরক্ষা সমিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। সৈয়দ শাহেদুল্লাহের পত্নী রাবেয়া খাতুন, সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহের পত্নী মকসুদা খাতুন প্রমুখের সঙ্গে বর্ধমান শহরে ক্ষুধাক্লিন্ন মানুষকে ত্রাণে আত্মনিয়োগ করেন। সেই সুফিয়াই আইয়ুব খানের মুখের ওপর তাঁকে ‘তবে তো আপনি জানোয়ারদের প্রেসিডেন্ট’ বলবার সাহস দেখিয়েছিলেন। কারণ, আইয়ুব বাংলাদেশের মানুষকে জানোয়ার বলে অপমান করে।

দেশ-কাল ব্যতিরেকে বলতে হয়, বিশ শতকে বাঙালি নারীদের ভেতরে ঘুষ আর ঘুসির কাছে আত্মসমর্পণ না করবার নিরিখে সুফিয়া কামাল হলেন সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়তে চেয়েছে, তা সে পাকিস্তান আমলেই হোক কিংবা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশেই হোক। সুফিয়া কামালকে একচুলও টলানো যায়নি।

বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শাহাদাতবরণের পর যখন বাংলাদেশের অতি সক্রিয় বঙ্গবন্ধুভক্তও নিশ্চুপ, তখন সুফিয়া কামাল কেবল এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কঠিন সমালোচনাই করেননি, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তির দাবিতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। বস্তুত খুনিচক্রের বিরুদ্ধে যখন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো পর্যন্ত পথে নামতে ভয় পাচ্ছে, তখন সেই নরমেদযজ্ঞের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতিরোধের সংকল্পে দৃঢ় হতে শিখিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল।