প্রয়াণ দিবস

শামসুর রাহমান : জীবনজুড়ে কবিতা

Looks like you've blocked notifications!

আধুনিক কবিতার ইতিহাস পরিবর্তন ও বাঁক বদলের ইতিহাস। বাংলা কবিতাও এ ধারার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। হাজার বছরের বাংলা কবিতা নানান বাঁক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আধুনিকতা পরিগ্রহ করে বর্তমান পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। তবে বাংলাদেশের কবিতায় সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন, আটান্নর সামরিক শাসন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষণীয়। এসব আন্দোলন-সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিবর্তন ঘটে। পরিবর্তিত হয় সাহিত্যের ভাষা এবং বিষয়বস্তুতে। নিরন্তর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতা হয়ে ওঠে আরও জীবনমুখী এবং বর্ধিষ্ণু। পঞ্চাশের কবি শামসুর রাহমানও (১৯২৯-২০০৬) এই ধারার সহযাত্রী। কবির প্রথম দিকের কবিতায় মৌলিক প্রেরণা হিসেবে তিরিশের কবি জীবনানন্দের দর্শন ও ছাপ উপলব্ধ হলেও অচিরেই তিনি স্বমহিমায় আবির্ভূত হন। পরিবর্তনের মধ্যে থেকেও বাংলা কবিতাকে তিনি শুদ্ধতম ধারায় এগিয়ে নেন। সৃষ্টি করেন স্বকীয় ধারা। কালক্রমে হয়ে ওঠেন পঞ্চাশের সময়পর্বের বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি।

শামসুর রাহমান আধুনিক বাংলা কবিতার বিশাল একটা পরিধি গড়ে তুলেছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর রচনা বর্তমান প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে পারছে না—তরুণ কবি-লেখক মহলে এমন একটি কথা প্রায়শই উচ্চারিত হয়। উচ্চারিত হয়, পঞ্চাশের বিনয় মজুমদার, শঙ্খ ঘোষ, আল মাহমুদরা তরুণ কবিদের কাছে যতটা পঠিত, শামসুর রাহমান ঠিক ততটা পঠিত নন। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, এমন কোন প্রপঞ্চ শামসুর রাহমানের কবিতায় অনুপস্থিত যে, মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে তিনি পাঠকপ্রিয়তা হারাবেন? না কি শামসুর রাহমানের কবিতার মর্ম কিংবা রসাস্বাদনে ব্যর্থ কবিযশোপ্রার্থী কিংবা পাঠকরা উদ্দেশ্য প্রণোভাবেই এমন কথা রটাচ্ছেন? শামসুর রাহমানের সৃষ্টিসম্ভারে দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, তাঁর বিপুল সংখ্যক কবিতার মধ্যে কৃত্রিমতার আশ্রয় সামান্য। সমাজ-রাষ্ট্রের নানবিধ অভিজ্ঞতা আত্মস্থ করেই তিনি কবিতা রচনা করেছেন। এ কারণে কবিকে ‘অভিজ্ঞতাবাদী কবি’ বলাও দোষের হতে পারে না।

‘পঞ্চাশের দশকের কবিরা অভিজ্ঞতাপ্রবণ হতে শুরু করেন। সুনীল-শক্তির কবিতা এমনই। এ সময় মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গের কবিদের মধ্যে আল মাহমুদও অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন, কিন্তু তিনি লোক থেকে লোকান্তরে যাত্রা করেন। ইতিহাস চেতনার নামে তিনিও অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়েছেন। এ দিক থেকে বলা যায় শামসুর রাহমানের কবিতা অভিনব। তিনি অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়েছেন কম। দৈনন্দিন জীবনে অতিক্রান্ত সময়ের নানা উপাদান এবং যাপিত জীবনের নানা উপকরণই তার কবিতার বিষয়বস্তু। গার্হস্থ্য উপকরণ সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন কবিতায়। এ সব দিয়েই কবিকে চেনা যায়। আবার উল্টোভাবে বললে এ কবির কবিতা চিনতে হলে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন জানতে হবে। শামসুর রাহমানের কবিতা বিচার করতে কোনও তত্ত্ব লাগে না।’ গবেষক কাজী মুহম্মদ আশরাফের মতানুসারে শামসুর রাহমানের কবিতার সমীপে উপনীত হলে এই উপলব্ধির সত্যতা মেলে। লক্ষণীয় যে, সময়-পরিক্রমায় বাংলা কবিতায়-পরিসরে তিনি নিজস্ব একটি ভাষাভঙ্গি রপ্ত করেছিলেন। এক সময়ের ‘বিবরবাসী অন্তর্জীবনে সমর্পিত’ কবি, ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছেন ‘বহির্জীবনের প্রতি মনোযোগী এবং রাজনীতি-মনস্ক’। কাব্যচর্চার শুরুর দিকে শামসুর রাহমান রাজনীতি থেকে কবিতাকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যখন প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন চতুর্দিকে কড়া পাহারা বসিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমার কাব্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশ না ঘটে।’ অথচ এই কবিই পরবর্তীকালে রাজনীতি থেকে, গণসংগ্রাম থেকে সংগ্রহ করেছেন তাঁর কবিতার বিচিত্র উপাদান এবং উল্লেখযোগ্য রসদ। কালক্রমে তাঁর কবিতা সামাজিক দায় পরিগ্রহ করে বেড়ে উঠতে থাকে। কবিতায় রাজনীতি ও সমাজ অবিচ্ছেদ্য প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে।

কবি শামসুর রাহমান খুব কাছ থেকে দেখেছেন ভাষা নিয়ে রাজনীতি। ‘প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে উপলব্ধি করেছেন সে বেদনার যাতনা। মানুষের স্বাভাবিক বৃত্তি, মৌলিক অধিকার আর সহজভাবে চলতে থাকা জীবনে আছড়ে-পড়া অনাকাঙ্ক্ষিত অভিঘাত ঘা দিয়েছে কবির কোমল হৃদয়ে; তিনি প্রায়-দিশেহারা হয়েছেন মাতৃভাষার চরম দুর্দশার সময়ে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে কবি ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতার মাধ্যমে নিজের ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।

‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?

উনিশ শো’ বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি

বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।

সে-ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হ’লে আমার সত্তার দিকে

কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।

এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউড়ের পৌষমাস!

তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো,

বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।’

স্বদেশ ও নিজের ভাষার প্রতি সতত শ্রদ্ধাশীল এই কবি ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখেন বিখ্যাত কবিতা ‘আসাদের শার্ট’। এভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচনা করেন ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’। শামসুর রাহমান বিশ্বাস করতেন, ‘ভাষার স্বাধীনতা আর কবিতার মুক্তিই মানবজীবনের সকল ব্যাপ্তি-প্রাপ্তির মূল উৎসভূমি’; আর এই চেতনার চিন্তাভাষ্য সাজিয়েছেন তিনি ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায়। শেষাংশ তুলে ধরছি—

‘স্বাধীনতা তুমি

খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,

খুকীর অমন তুলতুলে গালে

রৌদ্রের খেলা।

স্বাধীনতা তুমি

বাগানের ঘর, কোকিলের গান,

বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা,

যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।’

‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় কবি স্বাধীনতাকে নানা চিত্রকল্পে নামাঙ্কিত করতে চেয়েছেন। ‘বীরত্বযুক্ততা, রাজনৈতিক সম্পৃক্তি, গ্রাম্য-অনুষঙ্গ, পাখির গান-ঘর-বাগানের আশ্রয়-আকর্ষণ আর স্বস্তিতে সৃজনলেপনের কবিতাখাতার প্রসঙ্গাদি স্থান পেয়েছে তাঁর কল্পনারাজিতে।’ এসব কবিতা ‘মজলুম আদিব’ ছদ্মনামে ছাপা হতো স্বাধীন বাংলার ও কলকাতার কাগজে। সাংবাদিকতা জীবন বেছে নেওয়ায় শামসুর রাহমানকে অনেক সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয় লিখতে হয়েছে। এ জন্য তিনি চক্ষুষ্মান, সিন্দবাদ, নেপথ্যে, লিপিকার, জনান্তিকে ইত্যাদি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। তিনি ছিলেন গণতন্ত্রমনা। একনায়কতন্ত্র, স্বৈরশাসন, সামরিক শাসন, মৌলবাদ ও প্রগতিবিরোধী সব রকমের মতাদর্শের তিনি ছিলেন ঘোরবিরোধী।

সাধারণ কবিতা লেখার পাশাপাশি শামসুর রাহমান নিরীক্ষাধর্মী কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন সনেট ও গদ্যসনেট। ‘কবিতার নিরন্তর বৈচিত্র্যময় বিষয়বস্তুর চয়ন ও তাতে আধুনিকতার বীজ বপনে ঐকান্তিক নিষ্ঠা, মননশীল চিন্তার অনুশীলন, সংবেদনশীলতা ও দেশি-বিদেশি ইতিহাস-পুরাণ সাঙ্গীকরণে’ (কাবেদুল ইসলাম) শামসুর রাহমান ছিলেন তৎপর। তাঁর গদ্যসনেট সনেটীয় বিধি-নিয়মের মানদণ্ডে কতটুকু শিল্পসম্মত বা উত্তীর্ণ তা নিয়ে গবেষকরা দ্বিধান্বিত হলেও এ কথা বলা বাহুল্য নয়, গদ্যকবিতা হিসেবে এগুলোর আস্বাদ্যতা অলঙ্ঘনীয়। প্রচলিত ধারার কবিতার মতোই গদ্যসনেটে তাঁর চিরাচরিত চারিত্র্য ও দার্ঢ্য সুপ্রতিষ্ঠিত। গবেষক ফজলুল হক সৈকতের মতে, ‘জাতির বিপর্যয়, দুঃশাসন, অবরুদ্ধ জীবনের যন্ত্রণা শামসুর রাহমানের বোধ আর দায়গ্রহণের মানসিক শীতল-উর্বর ভূমিতে গড়েছে কবিতাসৃজনের শান্ত পরিসর। তিনি মানুষের কল্যাণ আর সুস্থির অবস্থান ভাবনার কবি; শান্তি আর স্বস্তি নির্মাণের নিবিড় ভাষ্যকার। কবিতাযাত্রায় তাঁর কোনও ক্লান্তি নেই, আছে সুখলাগা-দোললাগা উপলব্ধির আভাস; আর ওই অনুভব কবিতাপাঠকের হৃদয়-দরজায় পৌঁছে দেবার প্রচেষ্টা-শিহরণ।’ তাঁর কবিতা পাঠে এই উপলব্ধির সত্যতা পাওয়া যায়।

শামসুর রাহমানের ৬৭টি কবিতাগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, ৬টি প্রবন্ধ, ১টি গল্প, ৬টি অনুবাদ, ১৪টি ছড়ার বইসহ স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনী জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে। কবির অনেক কবিতা গান হয়েছে, গল্প-উপন্যাস নাটক ও চলচ্চিত্র হয়েছে, অনেক পঙক্তি হয়েছে শিল্পস্লোগান। তাঁর অনেক কবিতা বিদেশি ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সুতরাং শামসুর রাহমানের কবিতা বর্তমান প্রজন্মকে কিছুই দিতে পারছে না, এ ধরনের অনুযোগ বালখিল্যতার প্রকাশ বলেই প্রতীয়মান হয়। কবিকে বুঝতে হলে, তাঁকে পাঠে নেওয়াই যৌক্তিক।