প্রয়াণ দিবস

হুমায়ুন আজাদ : প্রথাবিরোধী, বাকবিভূতির পণ্ডিত

Looks like you've blocked notifications!

ত্রিকালদর্শী কবি হুমায়ুন আজাদ। ত্রিকালদর্শী এ কারণেই যে, ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’র মতো সময়োপযোগী কবিতা তিনি রচনা করেছেন! হুমায়ুন আজাদকে ঘিরে সাহিত্যমহলে নানান কথা প্রচলিত আছে। তিনি ছিলেন ‘রগচটা’ এবং ‘ঠোঁটকাটা’। একজন কবি, যিনি ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পান; তিনি একটু ব্যতিক্রমী হতেই পারেন। শুধু কবিতা নয়, প্রবন্ধ কিংবা উপন্যাসেও হুমায়ুন আজাদ এমন কিছু অন্তর্গূঢ় ও অভিনব বিশ্লেষণ হাজির করেছেন, যা মূলত পাঠকের চিন্তাকোষের অন্ধকারাবৃত্ত অংশে ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী। তাঁর প্রবন্ধগুলোতে যে মননশীলতার স্বাক্ষর মেলে, সমকালীন সাহিত্যে তা বিরল বললেও অত্যুক্তি হয় না। এ ছাড়া যে কোনও পাঠক হুমায়ুন আজাদের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন শুধু তাঁর প্রবচনসমূহ পাঠের ভেতর দিয়ে।

কবির একটি প্রবচন হলো, ‘বাঙলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক। বাঙলার চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে পরিণত হয় সামরিক একনায়কের সেবাদাসে।’ প্রবচনটি তৎকালীন প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। চুয়াত্তরে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে পতিত হয় দেশ। এর ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পাল্টে যায় দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। ক্ষমতালোভীরা পট পরিবর্তনে শামিল হন। পরিবর্তিত এই দৃশ্যপটের সুস্থিত পরিণতি আছে প্রবচনটিতে। প্রবচনের মাধ্যমে এমন কিছু সত্য তিনি সামনে এনেছেন, যা ইতোপূর্বে কেউ বলারও সাহস করেননি। তাঁর প্রবচনগুচ্ছ এ দেশের পাঠকসমাজকে করে তুলেছে সচেতন; পাশাপাশি ভণ্ডদের করেছে ক্রুদ্ধ। আমাদের দেশে শাসক, সমাজের মোড়ল ও ধর্মান্ধদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সত্যি কথাটি বলার মতো খুবই নগণ্য সংখ্যক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন। বলাই বাহুল্য, হুমায়ুন আজাদ এঁদের মধ্যে অন্যতম। যে কারণে হুমায়ুন আজাদ হয়েছেন বিতর্কিত ও আলোচিত। কালক্রমে প্রথাবিরোধী লেখকের অভিধায়ও অভিষিক্ত হয়েছেন তিনি। ফলে এই সাহিত্যিককে ব্যতিক্রমী বাকবিভূতির উজ্জ্বলতম পণ্ডিত হিসেবেও বিবেচনা করা যায়।

হুমায়ুন আজাদ বহু বছর আগে যে কবিতা বা প্রবচন লিখেছেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি কবিতা, প্রবন্ধ কিংবা উপন্যাসে স্তূতির বিপরীতে প্রকৃত সত্যের প্রকোষ্ঠে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। হুমায়ুন আজাদের সাহিত্য পাঠে মনে হওয়া অযৌক্তিক নয় যে, প্রথাবিরোধিতাই ছিল কবির অন্যতম গভীর প্রণোদনা। সাহিত্যের সব শাখাতেই তিনি ছিলেন প্রথাবিরোধী এবং সমালোচনামুখর। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘কোনো সৃষ্টিশীল কর্ম যদি মানবিক তথা যৌক্তিক না হয়, তাহলে তা মূল্যহীন এবং অসার।’ ব্যতিক্রমী এমন উচ্চারণের জন্য হুমায়ুন আজাদ এ দেশের চিন্তাশীল তরুণদের একটি অংশের কাছেও হয়ে আছেন প্রবল প্রমিথিউস।

‘সাহিত্য সমাজের দর্পণ’ আর কবি-সাহিত্যিকেরা হলেন সমাজের প্রতিনিধি। ফলে একজন সৃজনশীল মানুষ গবেষণালব্ধ-সুদূরপ্রসারী, দৃষ্টিভঙ্গি-উপলব্ধির কারণে সমাজের দুষ্টক্ষত চিহ্নিত করতে সক্ষম হন। হুমায়ুন আজাদ এ ক্ষেত্রে ছিলেন প্রাগ্রসর। তিনি শুধু সামাজিক-রাষ্ট্রিক বিচ্যুতিই নয়, দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীর মুখোশ খুলে তাঁদের চিন্তা-চেতনার দুর্বলতা, ক্ষমতার প্রতি লোভ, রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিসহ নানান দিক চিহ্নিত করেছেন। তাঁর এ প্রক্রিয়াকে সামাজিক সচেতনা সৃষ্টির একটি অংশ ভেবে নিলেও সুবিধাভোগী শ্রেণি তা কখনও মেনে নিতে পারেনি। ফলে বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন কবির বিরুদ্ধে। সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেখনির কারণে বার বার তিনি সাম্প্রদায়িক অপশক্তির রোষানলে পড়েছেন, হামলারও শিকার হয়েছেন।

লক্ষ করা গেছে, হুমায়ুন আজাদ লেখনির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ করেছেন বাঙালি জাতিকে। এর সপক্ষে তাঁর জবাব হলো, তিনিও এই গোত্রের মানুষ, তাই এই জাতির কাছে তাঁর প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু বাঙালি যখন অনিবার্যভাবে পতনকেই বেছে নিচ্ছে, তখন তিনি হয়ে উঠেছেন সমালোচনামুখর। বিশুদ্ধ ও পবিত্র বাংলাদেশ গড়া এবং বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন ছিল তাঁর চোখে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে তিনি মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ গড়ার পক্ষে অনুকূল মনে করতেন। ফলে, এ কথা বলা অত্যুক্তি হয় না যে, চেতনার জগতে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম মানুষ, যিনি শ্রদ্ধার চেয়ে, প্রথার চেয়ে যুক্তিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাই হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যকর্ম যুক্তিনিষ্ঠ সৃজনশীলতাকেই সমৃদ্ধ করেছে।

হুমায়ুন আজাদ ষাটের সময়কালের হতাশা, দ্রোহ, ঘৃণা, বিবমিষা, প্রেম ইত্যাদি বিষয় উপজীব্য করে কবিতা লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩), জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০), সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫), যতোই গভীরে যাই মধু, যতোই ওপরে যাই নীল (১৯৮৭), আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮), পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪) ইত্যাদি। মৃত্যুর পর কবির কাব্যসমগ্র প্রকাশিত হয়। হুমায়ুন আজাদ ভাষাবিজ্ঞানের মতো দুরূহ কাজটি করেছেন অবলীলায়। একই সঙ্গে অনুবাদ ও উপন্যাস লিখেছেন অনায়াসে। যখন তিনি কবিতা বা উপন্যাস লিখেছেন, তখন তার মধ্যে শিল্পীসত্তা প্রকট হয়েছে। আবার যখন প্রবন্ধ লিখছেন তখন তার মননশীলতা ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকট হয়েছে। বিজ্ঞানমনস্কতা ও নির্মোহ চেতনার কারণে তাঁর লেখনির প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ ছুটে গেছে অভীষ্ট সিদ্ধির লক্ষ্যে। নিজের কবিতার গঠনরূপ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘যা পুরোপুরি বুঝে উঠবো না, বুকে ওষ্ঠে হৃৎপিণ্ডে রক্তে মেধায় সম্পূর্ণ পাবো না; আমি অনুপস্থিত হয়ে যাওয়ার পরও রহস্য রয়ে যাবে রক্তের কাছে, তার নাম কবিতা; যদিও আমি কবিতা লিখেছি, লিখেছি তার ভাষ্য, এবং আজো গদ্যের এ-পরাক্রান্ত কালে, কবিতা লিখতে চাই।’ উন্নত রচনার জন্য তিনি যেমন চোখ-কান খোলা রেখেছেন, তেমনিভাবে ব্রতী হয়েছেন একার সন্ন্যাসে।

হুমায়ুন আজাদের সাহিত্যকর্ম পাঠে এটা উপলব্ধ হয় যে, তিনি মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজকে সুন্দর-সদৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। মিথ্যা থেকে মানুষকে সত্যের পথে আনতে চেয়েছেন। ধর্মান্ধতা, অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতাসহ যাবতীয় অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?’ কবিতায় তিনি লেখেন, ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়?/ তেমন যোগ্য সমাধি কই?/ মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো/ অথবা সুনীল-সাগর-জল-/ সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!/ তাইতো রাখি না এ লাশ/ আজ মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,/ হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই’। তিনি তাঁর জীবনদর্শন দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং দেশের সমগ্র কাঠামোকে। সর্বোপরি তিনি বেশ ভালোভাবে বুঝেছিলেন, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে; একে নিয়ে আর স্বপ্ন দেখার কিছু নেই। এ জন্য তিনি রাজনীতিবিদ ও মৌলবাদীদের দায়ী করেছিলেন। বিদ্যমান সমাজ-কাঠামোয় আস্থা রাখতে পারেনি হুমায়ুন আজাদ। তিনি এর প্রবল বিরোধিতা করতেন। ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’ কবিতায় তিনি বলেন, ‘আমাদের যা কিছু ছিল ভাল, তার সবটায় প্রায়/ নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে, এখনো যে দু এক/ ফোঁটা ভাল পড়ে আছে অগোচরে তাও/ শিগগিরই তাদের কবলে পড়বে, নষ্ট হবে।’ সমাজের অন্তর্নিহিত কিন্তু প্রকাশ্য সমস্যাবলীর দিকে তাকালে হুমায়ুন আজাদের উপলব্ধির সত্যই যেন দৃশ্যমান হয়।

কবি হুমায়ুন আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। ছিলেন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন এবং জ্ঞানী। বিজ্ঞানের বিভিন্ন টার্ম তাঁর মাথায় ছিল। সঙ্গত কারণে ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞানের উপস্থিতি ঘটেছে তাঁর কবিতা এবং প্রবন্ধে। ‘শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থ পাঠে তাঁর মননশীলতার স্বাক্ষর মেলে। বলাই বাহুল্য, ভাষার শক্তিই লেখকের শক্তি। হুমায়ুন আজাদের ভাব এবং ভাষা দুটোই স্বকীয়। তাঁর চিন্তার স্বকীয়তাই ভাষার নিজস্বতা সৃষ্টি করেছে। প্রবন্ধগুলোতে তাঁর মেদহীন ভাষার সন্ধান মেলে।

হুমায়ুন আজাদ আমৃত্যু সাম্প্রদায়িকতা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। রাষ্ট্রের-সমাজের প্রচল ও ক্ষয়িষ্ণু কাঠামোতে আঘাত করেছেন। অনিয়মের কাছে কখনও মাথা নত করেননি। হাস্যরসাত্মক ভঙ্গি ও অকপটে অন্যায্য তুলে ধরে বিরোধিতা করা এবং লক্ষ্য ও সংকল্পে অটল থাকাই ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি চারপাশের অসংগতির বিরুদ্ধে কলম ধরার পাশাপাশি বাংলা ভাষা-সাহিত্যের প্রথা ভেঙে নতুনভাবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। ফলে বলা দোষের হয় না যে, বাংলা সাহিত্য এবং স্বকীয় ভাষার ক্ষেত্রেও হুমায়ুন আজাদের ভূমিকা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখে নিজের ফ্ল্যাটে ব্যতিক্রমী চিন্তার এই লেখককে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আজ ১২ আগস্ট এই সাহিত্যমনীষীর ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধা।