হৃদয় সাহচর্যের কবি জীবনানন্দ দাশ

Looks like you've blocked notifications!

১.কবিতামগ্ন অনেকের কাছেই হৃদয় সাহচর্যের কবি জীবনানন্দ দাশ। যিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানুষ বেঁচে থাকে’। তিনি প্রবলভাবে, গভীরতর অনুভবে বেঁচে আছেন তার পাঠকের হৃদয়ে। তিনি রূপসী বাংলার কবি, নির্জনতার কবি, বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবিও বলা হয় তাকে। তার কবিতার পংক্তিতে উঠে এসেছে চিরায়ত বাংলার অপরূপ রূপ। বলেছিলেন উপমাই কবিত্ব। বহুমুখী উপমায় বাংলার চিরায়ত রূপকে কে আঁকতে পেরেছেন তার চেয়ে বেশি? তিনি তার লেখনীর মধ্য দিয়ে বাংলার রূপ-সৌন্দর্যকে এত নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন, যার তুলনা তিনি নিজেই। তাই আপন সৃষ্টিতে তিনি হয়ে ওঠেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি, আমাদের প্রাণের কবি, জীবনের কবি।

জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শম্ভূনাথ পণ্ডিত   হাসপাতালে ২২ অক্টোবর রাত্রি ১১ টা ৩৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। রূপসী বাংলায় তখন শুরু হয়েছে কবির প্রিয় হেমন্ত ঋতুর আগমনী ধ্বনি, অন্যদিকে কাব্যজগতে বাজছে কবি প্রয়াণের, বিসর্জনের বিরহী সুর।

২.আমাদের বোধ ও মননে সমানভাবে বিচরণ করেন বলে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি জীবনানন্দ দাশ বর্তমান সময় বিবেচনায়ও আধুনিক কবি। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য। মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম কবিতে পরিণত হন। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসাবে তিনি সর্বসাধারণ্যে স্বীকৃত। বহুমাত্রিক অনন্য প্রতিভা জীবনানন্দ দাশ সৃষ্টি করেছিলেন স্বতন্ত্র কাব্যভঙ্গি। পাঠকচিত্তে প্রগাঢ় সারা জাগানো কবির জীবন কেটেছে চরম দারিদ্রের মধ্যে। কিন্তু সাহিত্য সাধনায় যতি টানেননি বলেই বাংলা কাব্য জগতে তার প্রভাব প্রবলভাবে উপস্থিত। তিনি প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। জীবনানন্দের কাব্যচর্চার শুরু অল্পবয়স থেকেই। মূলত কবি হলেও তিনি অসংখ্য ছোটগল্প, কয়েকটি  উপন্যাস ও প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরা পালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলি হচ্ছে- ধূসর পান্ডুলিপি (১৯৩৬), বনলতা সেন (১৯৪২), মহাপৃথিবী (১৯৪৪), সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮), রূপসী বাংলা (রচনাকাল ১৯৩৪, প্রকাশকাল ১৯৫৭), বেলা অবেলা কালবেলা (১৯৬১)। এছাড়াও বহু অগ্রন্থিত কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ঔপন্যাসিক ও গল্পকার হিসেবে জীবনানন্দের স্বতন্ত্র প্রতিভা ও নিভৃত সাধনার উন্মোচন ঘটে মৃত্যুর পরে প্রাপ্ত অসংখ্য পান্ডুলিপিতে। উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে মাল্যবান, সুতীর্থ, জলপাইহাটি, জীবনপ্রণালী, বাসমতীর উপাখ্যান ইত্যাদি। তার রচিত গল্পের সংখ্যা প্রায় দু’শতাধিক। কবিতার কথা (১৯৫৫) নামে তার একটি মননশীল ও নন্দনভাবনামূলক প্রবন্ধগ্রন্থ আছে।

৩.একটু বোধসম্পন্ন না হলে আসল জীবনানন্দকে আবিষ্কার করা যায় না, আনন্দ-বেদনার স্বরূপ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’র সেই সত্যিকারের কবি জীবনানন্দ দাশকে অনুকরণ করে আমার বলতে মন চায়, ‘সকলেই পাঠক নয়, কেউ কেউ পাঠক’। অনুধাবনের বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার পাঠক হয়ে উঠতে হয়। তাই তাকে বুঝতে পারলেই তার কবিতা আমাদের মনকে উদ্বেলিত করে। জীবনে রূপ ও সৌন্দর্যমন্ডিত  মানসিকতা গড়তে অনুপ্রেরণা জোগায়। আর এখানেই একজন কবির সার্থকতা। তিনি তেমনই একজন অনন্য কবি। কাব্যবোদ্ধাদের মতে, জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ ও মোহিতলালের কাব্যধারার প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। রবীন্দ্রনাথের নিবিড় প্রকৃতিচেতনা তার কবিতায় গভীর দ্যোতনা লাভ করেছে। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ তার কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়। বিশেষত, রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে যেভাবে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ ও অনুসূক্ষ্ম সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে খ্যাত হয়েছেন। তবে প্রকৃতির পাশাপাশি জীবনানন্দের শিল্পজগতে মূর্ত হয়েছে বিপন্ন মানবতার ছবি এবং আধুনিক নগরজীবনের অবক্ষয়, হতাশা, নিঃসঙ্গতা ও সংশয়বোধ।

৪.সমালোচকগণ স্বীকার করেছেন, জীবনানন্দ ছিলেন একজন কালসচেতন ও ইতিহাসচেতন কবি। তিনি ইতিহাসচেতনা দিয়ে অতীত ও বর্তমানকে অচেচ্ছদ্য সম্পর্কসূত্রে বেঁধেছেন। তার কবিস্বভাব ছিল অন্তর্মুখী, দৃষ্টিতে ছিল চেতনা থেকে নিশ্চেতনা ও পরাচেতনার শব্দরূপ আবিষ্কারের লক্ষ্য। আধুনিক কাব্যকলার বিচিত্র ইজম প্রয়োগ ও শব্দনিরীক্ষার ক্ষেত্রেও তার অনন্যতা বিস্ময়কর। বিশেষত কবিতায় উপমা প্রয়োগে জীবনানন্দের নৈপুণ্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দনযুক্ত করেন, যা পরবর্তী কবিদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। অন্যদিকে জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসে অভিব্যক্ত হয়েছে দাম্পত্যজীবনের সঙ্কট, নরনারীর মনস্তত্ত্ব ও যৌনসম্পর্কের জটিলতা এবং সমকালের আর্থসামাজিক কাঠামোর বিপর্যয়। তার প্রায় গল্প-উপন্যাস আত্মজৈবনিকতার প্রকাশ।

৫.জন্মদিনে বা প্রয়াণদিনে শুধু নয়, সারা বছরই তার কবিতার চরিত্ররা কথা বলে, মনে ভাবনা জাগায়, ক্ষণে ক্ষণে নানা রঙ হয়ে ধরা দেয়। বনলতা সেনই শুধু নয়, ঠিক যেন ঘাস-লতা, গাছ-পাতা, বক, শঙ্খচিল একান্তভাবে কাছে এসে বলে- মনে রেখো সৃষ্টিশীল মানুষের মৃত্যু নেই, কবিরা মরে না। তারা সবুজ পাতায় যেমন বেঁচে থাকে, তেমনি বেঁচে থাকে ঝরা পালকে, ঝরা পাতায়। জীবনের রঙ যখন পূর্ণতা পায় তখনও থাকেন কবি, আবার যখন শেষ হয় জীবনের সব লেনদেন তখনও জেগে থাকেন কবি। জাগরূক থাকেন, অম্লান থাকেন জীবনানন্দ দাশ। তারই চরণ স্মরণ করে বলি, ‘ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে; ফিরে এসো হৃদয়ে আমার’।