ভিন্ন চোখে মহানায়ক-মহানায়িকা
হলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক বিলি ওয়াইল্ডার একসময় ‘রোমান হলিডে’র নায়িকা অড্রে হেপবার্ন সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘বিধাতা ওকে সৃষ্টি করে ওর দুই কপোলে চুম্বন করেছিলেন।’ এই প্রশস্তিটা রূপসী সুচিত্রারও প্রাপ্য। সুচিত্রা সেনের জয়যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৩ সালে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ মুক্তি পাওয়ার পর থেকে। অভিনয়-জীবনে তিনি হৃদয়হরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন লাখ লাখ পুরুষের। ফলে আমাদের দেশে, বিশেষ করে বাংলার মাটিতে যা হয়—তাঁর জীবনীকাররা, যেমন সাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ রায় (সুচিত্রার কথা) বাংলাদেশের পাবনার এই চিরন্তন নারীকে বসিয়েছেন প্রায় পূজার আসনে। সোমা চ্যাটার্জির মার্জিত, কিন্তু অতিকথন দুষ্ট সুচিত্রা-জীবনীতে সুচিত্রার স্বর্গীয় ও আলোকোজ্জ্বল সৌন্দর্য, রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, দরদি হৃদয় এবং সর্বোপরি নিগূঢ় আধ্যাত্মিকতার বর্ণনা—নিতান্তই হাস্যকর উচ্চ-প্রশংসা। স্তুতিবাদ ও মামুলি উক্তির আধিক্যে ঘোমটার আড়ালে গ্রামবাংলার নববিবাহিত কনে-বৌয়ের মতো ঢাকা পড়ে যায় আসল রমাই।
কলকাতার চলচ্চিত্রজগতে সুচিত্রা সেনের আত্মপ্রকাশকে বিচার করতে হবে উত্তর-স্বাধীনতাকালে ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতির নিরিখে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা অভিবাসী ও উদ্বাস্তুর তুমুল স্রোতে শহুরে ভদ্রলোক সমাজে পাশ্চাত্য মনোভাব তেমন করে দানা বাঁধতে পারেনি; বাঙালিদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ তখনো পুরুষ-দমিত গোষ্ঠীতন্ত্রের ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রাখে। ফলে আদর্শ নারীর গুণাবলি অপরিবর্তিত রয়ে যায় পুরুষশাসিত সমাজের ব্যবস্থা মতো—সহনশীলতা, আত্মোৎসর্গ এবং আত্মত্যাগের নিগড়ে। সৌভাগ্যক্রমে সুচিত্রার পরিচালকরা, যেমন অগ্রদূত (বিভূতি লাহা, ও সহযোগী), যাত্রিক, অজয় কর, নির্মল দে, প্রভৃতি এই আদর্শ নারীর চরিত্রেই সুচিত্রা সেনকে উপস্থাপন করলেন। যে ছবিটি সুচিত্রা সেনকে সাধারণের কাছে প্রসিদ্ধি আনল, সেটা হলো ‘অগ্নিপরীক্ষা’ (১৯৫৪)। ছবিটি চিরাচরিত নারীবিদ্বেষী গল্পের ওপর ভিত্তি করে, যেখানে স্বামীকে অর্পণ করা হলো সব রকমের সুযোগ-সুবিধা; রামায়ণের রামের মতো তাঁকে দেওয়া হলো হারানো স্ত্রীকে নানা কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার অধিকার। এভাবেই শুরু হলো সুচিত্রা সেনের ফিল্ম-ব্যক্তিত্ব, যেটি পরে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯৫৬ সালে ‘একটি রাত’ ছবিতে সুচিত্রা অভিনয় করলেন একটি সরলমতী ফ্লার্ট সান্ত্বনার ভূমিকায়। ভাগ্যচক্রে সান্ত্বনা তাঁর পূর্বপরিচিত সুশোভনের সঙ্গে গ্রামের এক পান্থনিবাসে রাত কাটাতে বাধ্য হলেন। সেখানে সান্ত্বনা মাঝেমধ্যে সুশোভনকে প্রেম-প্রেম ভাবভঙ্গি দেখালেও সুশোভন যখন ঘরের একটা মাত্র বিছানায় শোবার প্রস্তাব দিলেন, সান্ত্বনা সজোরে জানালেন ওটা অন্যায়, ‘এটা ও দেশ নয়, এটা বাংলাদেশ।’ বলা বাহুল্য সুচিত্রার বেশির ভাগ পছন্দসই চরিত্রই যৌন-অনুভূতি প্রকাশে অপারগ ধর্মধ্বজী নারীর।
উত্তম কুমার যে সময়ে মহানায়ক হন, সে সময়ে তাঁর প্রতি জনসাধারণের আকর্ষণের বড় কারণ ছিল লোকের চোখে তিনি আদর্শ শহুরে ভদ্রলোক। যেসব ছবিতে উনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতেন, চিত্রনাট্যকার আর পরিচালকদের প্রসাদে সেই চরিত্রগুলো ছিল আদর্শবান পুরুষের, যাঁরা নারীর আকর্ষণে বিচলিত হন না, কিন্তু নায়িকাদের ওপর শিশুর মতো নির্ভরশীল। এটি বিশেষ করে সত্য পঞ্চাশ ও ষাট দশকে—সুচিত্রা সেন নায়িকা হলে। অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), শাপমোচন (১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হলো দেরি (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭) রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাশা (১৯৬২), গৃহদাহ (১৯৬৭), হার মানা হার (১৯৭১), নবরাগ (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭২) এবং প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫) ছবিগুলোতে উত্তম কুমারের রোমান্টিক আবেদনের মূলে রয়েছে একটি অবিবাহিত রক্ষণশীল পুরুষ (‘আলো আমার আলো’-এর ব্যতিক্রম), যিনি যৌন ব্যাপারে উদাসীন, অর্থাৎ নিরীহ বাঙালি হিন্দু আদম (Adam)। এ ধরনের চরিত্রের যেটা প্রয়োজন, সেটা হলো তাকে দেখভাল করা, অসুস্থ হলে সেবা দিয়ে সুস্থ করা এবং পরিশেষে ধীরে ধীরে সূক্ষ্মভাবে প্রিয়ার নজরে আনা। উত্তমের এই চরিত্রের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের মুখের মর্মস্পর্শী ভাব, নিখুঁত সৌন্দর্যের ডালা এবং ভুবনমোহিনী হাসি দিয়ে সৃষ্টি হলো রোমান্টিক জুটির ম্যাজিক-মসলা, যা উদ্বেল করল সেই সময়ের (ঔপনিবেশিকোত্তর) বাংলা তথা ভারতীয় হৃদয়কে।
সুচিত্রা-উত্তম জুটির প্রধান বিশেষত্ব হলো ওঁদের পরস্পরের কথোপকথনের ধারা। এটাকে আমি বলি ‘রোমান্স অন এ টি-পট’। এখানে চা হলো প্রেমের তরল ওষুধ, যেটিকে আরো মধুরতর করা হয় যখন প্রথমজন বলেন, ‘আর চিনি লাগবে কি?’ অথবা ‘চিনি যথেষ্ট হয়েছে তো?’ আরেকটা পরিচিত দৃশ্য হলো, মধ্যরাতে নায়কের বেডরুমে নায়িকার আগমন এবং নায়িকার এই অসংগত আচরণে রুষ্ট হয়ে নায়কের ক্রোধপ্রকাশ। সম্ভবত এ ধরনের দৃশ্য প্রথম দেখা যায় প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘দেবদাস’ ছবিতে। কলকাতার শিক্ষিত বাঙালি বাবুর নিজের পুরুষত্ব সম্পর্কে ভীতি মূর্ত হয়ে ওঠে, যখন ছেলেবেলার সাথি পার্বতী গভীর রাত্রে ঘরে এসে হানা দেয় প্রেমিকের কাছে ধরা দিতে। প্রেমিকার এই আত্মসমর্পণে হতবুদ্ধি নপুংশকের প্রত্যুত্তর হলো মেয়েটির মাথায় ছিপের বাড়ি মারা! পার্বতীর কপালে রক্তের ধারাকে দেখানো হলো মাথার সিঁদুরের প্রতীক হিসেবে।
উত্তম কুমারের রুপালি পর্দার চরিত্র নারীদের প্রতি পুরুষদের এ ধরনের আচরণের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। ওঁর বেশির ভাগ রোমান্টিক ছবিতে দেখা যায় নারীর সৌন্দর্য ও আকর্ষণের প্রতি নিস্পৃহতা এবং প্রেমের কোনো প্রস্তাবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বিরূপভাব প্রদর্শন। ওঁর এই প্রায়-নারীবিদ্বেষী আচরণ, অতি-ন্যায়বান, অতি-রক্ষণশীল চরিত্রের জন্যেই উনি টলিউডের একজন অসাধারণ জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে ওঠেন, কারণ এগুলোই আদর্শ বাঙালি ভদ্রলোকের চরিত্রগুণ বলে ধরে নেওয়া হয়। অন্যদিকে, উত্তম কুমার বলিউডের নায়ক-চরিত্রে, যেখানে পুরুষসিংহ নায়ক নেচে-গেয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি।
বাস্তবে বাংলা ছবিতেও যেখানে নায়ক সতেজ সাহসী মিশুকে প্রেমিক পুরুষ, নিজের পুরুষত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে প্রেম নিবেদন করতে দ্বিধাগ্রস্ত নন—সেইসব চরিত্রে ওঁকে মানাত না। উনি চিরস্মরণীয় ওঁর চিত্তাকর্ষক চেহারা, মৃদুমন্দ্র স্বর, বাংলা কথা বলার ধরন ও নিখুঁত উচ্চারণ জন্য—যদিও ওঁর ইংরেজি উচ্চারণ দুষ্ট ও প্রায়ই হাস্যকর (জয়জয়ন্তী, ১৯৭১, আলো আমার আলো, নবরাগ)। মাঝ ৪০ থেকে ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত উত্তমের উচ্চারণ তার সুস্পষ্টতা হারাতে থাকে (গুজব উনি মদ্যপানে আসক্ত হয়েছিলেন, হয়তো সেই কারণে), ওঁর শরীরটাও আর টানটান ছিল না এবং পরচুলা যে পরতেন, সেটাও বোঝা যেত। উনি তখন অভিনয় করতেন হালকা হৃদয়ের বয়স্ক পুরুষের ভূমিকায় (ধন্যি মেয়ে, ১৯৭১, জয় জয়ন্তী, মৌচাক, ১৯৭৫), অথবা ভিলেনের চরিত্রে (বাঘবন্দি খেলা, ১৯৭৫, স্ত্রী, ১৯৭২, আলো আমার আলো, রাজা সাহেব, ১৯৮০), কিংবা আত্মঘাতী বিশ্বপ্রেমী (অগ্নিশ্বর, ১৯৭৫) হিসেবে।
সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করে যে অসামান্য সাফল্য উত্তম পেয়েছিলেন, সে রকম সাফল্য অন্য কোনো নায়িকার সঙ্গে পাননি। অন্য সুন্দরী ও প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী, যেমন—সুপ্রিয়া চৌধুরী (পূর্ব পদবি মুখার্জি) বা অপর্ণা সেনের (পূর্ব পদবি দাশগুপ্ত) বিপরীত রোলও ওঁকে তেমন সাফল্য দিতে পারেনি। সুচিত্রা সেনই উত্তমকে ম্যাটিনি আইডল করে তুলেছিলেন। সুচিত্রা না থাকলেও উত্তম কুমার নিশ্চয় সুদক্ষ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতেন—যদিও অভিনয়-জীবনের প্রথমে এক পরিচালক ওঁকে ফ্লপ মাস্টার জেনারেল নাম দিয়েছিলেন। রুপালি পর্দায় সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধেই উনি বাংলা সিনেমার সোনার ছেলে হয়ে ওঠার সুযোগ পান।