মাহবুব আজীজের দুটি দীর্ঘ কবিতা

Looks like you've blocked notifications!
জেইম বেস্টের পেইন্টিং অবলম্বনে

কবিতার সঙ্গে

 

কবিতারা ছড়িয়ে থাকে এখানে-ওখানে;

যেকোনো পরিস্থিতিতে; যুদ্ধ ও শান্তিতে—

আমি কবিতা কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে নিই প্রাণভরে।

কবিতারা ছড়িয়ে থাকে অবিন্যস্ত, বেপরোয়া;

কিছু কবিতা ব্রহ্মপুত্রের ওপারে বসবাস করে—

তাদের আজলা ভরে নিতে নদী পাড় হতে হয়!

বহুকাল পরে দেখা হলে— ওই কবিতারা

মুখ ফিরিয়ে রাখে। উপঢৌকনে তাদের রাগ

ভাঙ্গাতে হয়!  ছলে-বলে তাদের রাগ ভাঙ্গাই।

রাগ সাঙ্গ হলে পর ব্রহ্মপুত্রপাড়ের কবিতারা

আমাকে জড়িয়ে ধরে। শান্ত বালকের মতো

আমি ওদের ভেতরে ডুব দিই; সাঁতরে চলি।

 

কিছু কবিতা লতাগুল্মময় আশ্চর্য সব স্থানে

লুকিয়ে থাকে; ওখানে আকাশে উপুড় হয়ে

মেঘেরা শুয়ে থাকে— নিবিড় ঘাসে সুনশান!

ওই মেঘের ভেতরে— ওই লতাগুল্মের ভেতর

মৃদুমদির কবিতাদের আমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি—

কবিতাদের চোখ, নিখুঁত চিবুকের গাঢ় ছায়া;

নিবিড় আচ্ছন্ন করে চেতনা—আমি তাদের

কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে নিতে থাকি দু’হাতভরে।

 

কিছু কবিতা প্রতিদিনকার দিনরাত্রির

গায়ে লেপ্টে থাকে। কড়ি ও কোমলের আবর্তে

ওদের ভুলেই থাকি বেশিরভাগ সময়—

কবিতারা ঠিকই কাজলকালো চোখে আমাকে

ইশারা দিতে থাকে— ভুলপথ থেকে উঠে

এসে আমি তাদের জড়িয়ে ধরি,

আলতো চুম্বন করি। মন-প্রাণ যা আছে—

সব সপে দিয়ে কবিতাদের পায়ের কাছে

বসে থাকি। একশ’ বছরের তৃষ্ণার্ত মুখ

রাখি কবিতার বুকে।

 

কবিতারা তখন দৌঁড়ে পালায়; আর আমি

কবিতার ছায়াগুলো, মায়াগুলো, পাগলামীগুলো

কুঁড়োতে থাকি। কুঁড়োতে থাকি।

 

নিঃসঙ্গতার মতো একা

হুহু বাতাস বয়ে বয়ে যায় সুতীব্র শীষে—

ক্লান্ত বৃক্ষগুলো অযুতকোটি বছরব্যাপী

একলা দাঁড়িয়ে। দয়িতা কি আত্মজাকেও

জড়িয়ে ধরবার সাধ্যরহিত। নিঃশব্দ— যেন

যুগ যুগান্তরের ব্যথা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে অনড়।

বৃক্ষ তবে প্রবাহমান নিঃসঙ্গতার আরেক নাম!

 

পাহাড়ও তাই। উঁচু উঁচু—আরও উঁচু, আরো—

নিঃশব্দ, নিথর—যেন শতবর্ষের নীরবতা কবুল

করে নিঃসঙ্গ প্রতীক্ষারত। শত-সহস্র বছর একাকী

মূক দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় নিতান্ত একলা—

চিরস্তব্ধ পাহাড় নিঃসঙ্গতার গাঢ় প্রতীক!

 

নিবিড় আকাশ—

একাকী বয়ে চলে দেশ থেকে দেশান্তরে;

আকাশের বয়ে যেতে পাসপোর্ট কি ভিসা

নিষ্প্রয়োজন! কিংবা আকাশ দাঁড়িয়ে থাকে

অনড়-নিশ্চল!— বিজ্ঞান যা-খুশি বলুক—

আকাশের বলার কিছু নাই—অথবা, আমরা

যাকে আকাশ বলি; আদৌ আকাশ বলেই

কিছু নাই! শূন্যতার আদিঅন্তহীন আকার

তবে আমাদের কাছে আকাশ নামে পরিচিত!

প্রবাহমান নিঃসঙ্গতার চিরায়ত এক রূপ—

আকাশ!

 

আরেক একা— সমুদ্র; তার জায়া-পতি

পুত্র-কন্যা নাই। পুরাণ যাই বলে— বলুক

আমরা জানি—সমুদ্র আবহমানকালধরে

প্রবাহমান। সে-ও একা—আদি, অকৃত্রিম

নিঃসঙ্গ... সমুদ্রের কল্লোলিত চলন তার

একার আর্তনাদ।  প্রবাহমান নিঃসঙ্গ সমুদ্র

একলা একা বয়ে চলে আদি-অন্তহীন।

 

এইতো জীবনচক্রের অকৃত্রিম সত্য—

প্রবাহমান নিঃসঙ্গতা। আদি-অন্তহীন

নিঃসঙ্গতা। মানুষও নিঃসঙ্গ পুরোপুরি;

পুরনো সে সত্য— কোথা থেকে এসেছি

আর কোথায় চলেছি; জানি না আমরা;

কিছুই জানি না। আদি অন্তহীন এক

প্রকোষ্ঠ ছেড়ে মানুষ আমরা আবির্ভূত

নানা পরিচয়ে। দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম

সব ছাপিয়ে মানুষের শুরু আর শেষের

গল্প এক ও অভিন্ন মানুষ আমরা—

কিছুই জানি না। কিছুই জানি না। ।

 

প্রবাহমান আরেক অনিবার্য নিঃসঙ্গতার

নাম তাই— মানুষ। একলা এসেছি।

একলা যেতে হবে—বহু তত্ত্ব, তথ্য, উপাত্ত,

গবেষণা— মত-পথ-যুক্তিতর্ক-গপ্পো—

সব ছাপিয়ে এই-ই সব থেকে নিষ্ঠুর সত্য।

 

বহমান অমেয় বাতাসের মতো

অবিরাম দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষের মতো

চিরমূক পাহাড়ের মতো

আজন্ম একা বয়ে চলা সমুদ্রের মতো

সীমিত আয়ুর মানুষও চিরপ্রবাহমান—

একাকী, আদি ও অন্তহীন—

—নিঃসঙ্গতার মতো একা!