বায়ান্নর স্মৃতি
বেঁচে থাকার মধ্যে আমি আছি
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি, সেটা তো অনেক দিন আগের কথা। ১৯৪৮ সাল থেকে আমাদের আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে যখন প্রথম আন্দোলন শুরু হয়, আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখন আমি দিনাজপুরে ছিলাম। আমার স্কুলটার নাম ছিল মহারাজা গিরিজানাথ হাইস্কুল। যাই হোক, তার পরে আন্দোলন টানা বাড়তে থাকে। পরে রাজনীতিবিদরা ক্রমে এগিয়ে আসেন। এবং আমার মনে আছে, ঢাকা বার লাইব্রেরিতে একটা সভা হয়। সেখানে ভাষাসংগ্রাম কমিটি হয়; মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে। তার পরে এটা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এবং ছাত্রদের মধ্যে আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গেছি। এবং আমাদের সিনিয়র ছিলেন এ টি এম বারী। তার পরে ভাষা আন্দোলনে মতিন ভাই এলেন, পরে তিনি ভাষা মতিন নামে খ্যাত হলেন।
এই করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধীরে ধীরে আগাচ্ছি। তার পরে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন সে সময় তৈরি হতে শুরু করল। ছাত্র ইউনিয়ন তৈরি হলো। ছাত্রলীগ তার আগেই তৈরি হয়েছে। আন্দোলন ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত হলো, দানা বাঁধল এবং শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদরাও তা গ্রহণ করলেন। আওয়ামী লীগ ভাষা আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়াল। বঙ্গবন্ধু এর নেতৃত্ব দিলেন। এই করে করেই ভাষা আন্দোলন জেগে ওঠে। সে সময় মানে বায়ান্নর আন্দোলনের সময় তখন আমি ঢাকায় চলে এসেছি। আমরা যখন আন্দোলন করছিলাম, সেই সময়টায় বড় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চলছিল।
আমরা যখন মার্চ করে আসছিলাম আন্দোলন করতে করতে, এখনকার যে শহীদ মিনার সেই রাস্তাটা, এখন যে মেডিকেল কলেজ, সেখানে অনেকগুলো বইয়ের দোকান ছিল, চায়ের স্টল ছিল, তার পরে দেবদারু গাছ ছিল, কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। তারপরে অদূরে এখন যেটা আমরা বাংলা একাডেমি বলি, পুরোনো বিল্ডিং সেটার নাম ছিল তখন বর্ধমান হাউস। ওটা প্রাদেশিক গভর্নরদের প্রশাসনিক ভবন ছিল। তো, এই নিয়েই চলছিল। তার পরে আমরা হঠাৎ করেই মিছিল করে এগিয়ে আসছিলাম, আমাদের ইচ্ছেটা ছিল প্রাদেশিক যে সংসদ অধিবেশন চলছিল, তার সামনে একটা অবস্থান ধর্মঘট নেওয়া। এবং একটা চাপ সৃষ্টি করা, যাতে অধিবেশনের মধ্যে একটা প্রস্তাব পাস করা হয় বাংলা ভাষার পক্ষে। এই চাপ সৃষ্টি করার জন্যই আমরা মিছিল করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ করে আমাদের ওপরে এক ধরনের লাঠিচার্জ শুরু হলো। লাঠিচার্জ শুরু হলে আমরা সেটাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তার পরে হঠাৎ গুলিবর্ষণ করা হলো কোনোরকম সতর্ক করা ছাড়াই। এর ফলে আমরা কয়েকজন ছাত্র সেই সময় তাৎক্ষণিকভাবে আহত হলাম। ঠিক এখন যেটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেইটার কাছাকাছি মানে ইমার্জেন্সির কাছাকাছি ছিলাম। তো, হঠাৎ করেই চার-পাঁচজন ছেলে গুলিবিদ্ধ হলো। তার মধ্যে বরকত, রফিক, জব্বার আহত হলো। আমার ধরাধরি করে সবাইকে হাসপাতালে ইমার্জেন্সিতে নিলাম। নেওয়ার পরে চিকিৎসা দেওয়া হলো। শেষ পর্যন্ত কাউকে আর বাঁচানো গেল না।
শফিক পরের দিন আহত হয়েছিল। এটুকুই এখন আমার মনে আছে। হয়তো আমার পুরোনো লেখার মধ্যে এগুলো আছে। তো এর পরপরই আমরা এটার বিরোধিতা করে পরের দিন মনে হয় হরতাল ডাকলাম। নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত হলগুলোর মধ্যে চলে এলো। তিনটি হল প্রধানত এর নেতৃত্ব দিয়েছিল। একটা হলো সলিমুল্লাহ হল, আরেকটা হলো জগন্নাথ হল এবং ফজলুল হক হল। এই তিনটি হল নেতৃত্ব দিয়েছিল। তার মধ্যে আমার এখনো মনে আছে, মুহিত ভাই (বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত) ছিলেন, সেই সময় হলে অবস্থান করছিলেন তিনি। তারপর অন্যান্য নেতা, এই মুহূর্তে নামগুলো মনেও পড়ছে না। তার পরের দিন থেকেই তো আমাদের আন্দোলন আরো জোরালো হলো; কিন্তু পুলিশ খুব চড়াও হলো। শেষ পর্যন্ত আমরাও আত্মগোপনে চলে গেলাম। অনেকে ঢাকা ছেড়ে চলে গেল। তার পরে যখন পরিস্থিতি একটু শান্ত হলো, পরে আবার আমরা ধীরে ধীরে ঢাকায় ফিরে এলাম।
আমাদের সঙ্গে যাঁরা আন্দোলন করেছিলেন, তাঁদের অনেকে মারা গেছেন। আরো অনেকে মারা গেছেন। তাঁদের নাম আমার মনে পড়ছে না এখন। বেঁচে থাকার মধ্যে আমি আছি আর কে কে আছেন, তা-ও জানি না। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু তিনি তখন অতটা সক্রিয় ছিলেন না। তিনি পরবর্তীকালে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই সময় তমদ্দুন মজলিস বলে একটা সংগঠন ছিল, সেটা মোটামুটি ইসলামভিত্তিক, কিন্তু ওরা আবার ভাষার দাবিতে বাংলা ভাষার পক্ষে ছিলেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেই সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। হয়তো কোনো পদেও ছিলেন। ওই সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের এক শিক্ষক। তিনি ভাষা আন্দোলনের জন্য অনেক কিছু করেছেন, তাঁর নাম অধ্যাপক আবুল কাশেম। তিনি আমাদের পদার্থবিজ্ঞান পড়িয়েছেন। আরেকজনের কথা মনে পড়ল হঠাৎ, তিনি রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন। নুরুল হক ভূঁইয়া সাহেব। তিনি তমদ্দুন মজলিস যে ভাষা সংগ্রাম কমিটি ছিল, তার সেক্রেটারি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি এটুকুই মনে পড়ছে এখন।