স্মরণ

রুদ্র পরিচয়

Looks like you've blocked notifications!

(আজ ২১ জুন, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯১ সালের এই দিনে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। সত্তরের দশকের এই কবি পরিচিত তারুণ্য ও দ্রোহের প্রতীক হিসেবে। তাঁর প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি। লেখক ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে কবির সহপাঠী ছিলেন।)

পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর আজ ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯১ সালের ২১ জুন তিনি আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে চিরবিদায় নেন। তাঁর জন্মতারিখ ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬। কবি রুদ্রের অকালমৃত্যু বাংলাদেশের জন্য একটি অতি বিয়োগান্তক ঘটনা। কারণ, জীবদ্দশায় তিনি ব্যক্তিগত জীবনে যেমন ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন, তেমনি তাঁর সাহিত্যকর্ম, বিশেষ করে কবিতা ছিল দেশপ্রেমের রাজনৈতিক চেতনায় ঋদ্ধ ও একটি আধুনিক ন্যায় সমাজের স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ।  

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাগেরহাটের তৎকালীন রামপাল উপজেলার (পরবর্তীকালে রামপাল ও মংলা দুই ভাগে বিভক্ত) সাহেবের মঠ গ্রামের বিখ্যাত শেখ পরিবারের বংশোদ্ভূত তিনি। তাঁর বাবা শেখ মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ ওই অঞ্চলের একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক ছিলেন। মংলা পোর্টের চিকিৎসক হিসেবে তিনি ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষভাবে সহায়তা করেন। এ কারণে তিনি পাকিস্তান সেনাদের দ্বারা আটক হন এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত যশোর জেলে কারাবাস করেন।

রুদ্রের নানা শেখ মুহম্মদ ইসমাইল ছিলেন মংলা অঞ্চলের একজন খ্যাতনামা ও ধনাঢ্য ব্যক্তিত্ব। এই পরিবারের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ছিল ব্যাপক। রুদ্রের জীবনেও নানাবাড়ির প্রভাব পড়েছিল। খুব দ্রুত বঞ্চিতের পাশে দাঁড়ানো বা দেশের অস্থির রাজনৈতিক বলয়ের নাগপাশ থেকে দেশের মানুষের মুক্তির চিন্তা সমভাবে রুদ্রের জীবনে উপস্থিত ছিল, যা তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ পড়াশোনা শুরু করেন মংলার মিঠাখালী গ্রামের পাঠশালা থেকে। পরে তিনি মংলার সেন্ট পলস স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করে সবশেষে ঢাকার ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল থেকে ১৯৭৩ সালে চারটি বিষয়ে লেটারসহ বিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ঢাকা কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান)সহ এমএ পাস করেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে যথাক্রমে ১৯৮০ ও ১৯৮৩ সালে।

শিক্ষিত, মেধাবী, মার্জিত ও কোমল মনের মানুষ ছিলেন কবি রুদ্র। রাজনৈতিকভাবে ছিলেন গভীর সচেতন। ’৭৫-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি যখন মৌলবাদী স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ওপর ক্রমে নির্ভরশীল হয়ে উঠছিল, তখন শত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও রুদ্র তাঁর অমর একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন’। এই লাইনটি আজো কত প্রাসঙ্গিক, পাঠকমাত্রেই তা উপলব্ধি করবেন। তাঁর এই কবিতার অপর একটি চরণ, ‘ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা’! আমাদের জাতীয় পতাকার এমন অবিস্মরণীয় চিত্রকল্প একজন অসধারণ সৃজনশীল কবির পক্ষেই রচনা করা সম্ভব।

তরুণ সমাজের কাছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাঁর কবিতা ও ব্যবহারগুণে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কবি রুদ্র তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা ও কাব্যচিন্তা মিলিয়ে নেতৃত্বের আসন নেন। সে সময়ে তাঁর চারপাশের বন্ধুদের কাছেও তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। তাঁকে ছাড়া কোনো আড্ডাও যেন অপূর্ণ ছিল। বন্ধুদের নিয়ে তিনি গঠন করেন ‘রাখাল’ নামে একটি সংগঠন। রাখালের মূল চেতনা বক্তব্য ছিল, ‘কবিতা ও রাজনীতি একই জীবনের দুই রকম উৎসারণ’।

পরবর্তীকালে জাতীয় কবিতা উৎসব অনুষ্ঠানেরও অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি।

যদিও তাঁর সৃজনশীল রচনার বয়স কম, তবুও তাঁর রচনাসংখ্যা নেহাত কম নয়। তাঁর জীবদ্দশায় মোট বই বেরিয়েছে সাতটি। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় রুদ্রের প্রথম কবিতার বই ‘উপদ্রুত উপকূল’। পরবর্তী ছয়টি কবিতার বই হলো—‘ফিরে চাই স্বর্ণ গ্রাম’ (১৯৮১), ‘মানুষের মানচিত্র’ (১৯৮৪), ‘ছোবল’ (১৯৮৬), ‘গল্প’ (১৯৮৭), ‘দিয়েছিলে সকল আকাশ’ (১৯৮৮) ও ‘মৌলিক মুখোশ’ (১৯৯০)। তাঁর মৃত্যুর পর পরই প্রকাশিত হয় ‘এক গ্লাস অন্ধকার’ (১৯৯২) ও একটি নাট্যকাব্য ‘বিষ বিরিক্ষের বীজ’ (১৯৯২)।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে বলা হয় প্রেম ও দ্রোহের কবি। কবিতায় বিদ্রোহ, রাজনীতি, প্রেম ও সামাজিক অসংগতি এলেও তিনি তাঁর কবিতার একটি বড় উপজীব্য করে তুলেছিলেন তাঁর নিজের এলাকা, রামপাল ও মংলা অঞ্চলের উপদ্রুত জনজীবন, সামাজিক অস্থিরতা ও প্রেম, যা হয়ে উঠেছিল এক গুরুত্বপূর্ণ কাব্য পটভূমি।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে মৃত্যুর কিছুকাল আগ পর্যন্ত রুদ্র মংলায় থাকতেন। তিনি বেশ কিছু গানও রচনা করেছেন। মংলা-রামপালের বেশ কয়েকজন স্থানীয় যুবককে নিয়ে তিনি ‘অন্তর বাজাও’ নামে একটি গানের দল গঠন করেছিলেন। বেশির ভাগ গানে তিনি নিজেই সুর দিয়েছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম ‘ভালো আছি ভালো থেকো’খ্যাত ‘আমার ভিতর-বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে’। গানগুলো দুই বাংলায় বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। এ ছাড়া তাঁর রচনাসামগ্রীও প্রকাশিত হয়েছে। রুদ্রের কবিতা নিয়ে অনেক লেখক-গবেষক কাজ করেছেন। আজ এই বিশেষ দিনে কবির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।